গত তিনদিন ধরে পকেটে বিশ টাকা নিয়ে ঘুরছি। টাকা না থাকলেও আমার কোনো কাজ এবং জীবন থেমে থাকে না। টাকা না থাকলে শুধু মাছ মাংশ খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, তখন ডিম দুধ ডাল খাই শুধু। সবজিটাও বাদ পড়ে। কারণ, মুদির দোকানে সবজি মাছ মাংশ পাওয়া যায় না। বিপদ হয় এই সময় কোনো অতিথি আসলে।
কালকে সেরকম একটা কাণ্ড ঘটল। নিকট আত্মীয় বাসায় এসেছেন, যত্নে ত্রুটি করা যাবে না। প্রথমে ঘরে যা আছে, চা বিস্কুট ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করা হল, এরপর দুপুরে খেতে বলা। তখন বাজে বেলা বারোটা। যত্ন করছি অনেক, ওনারাও কোনোভাবেই থাকতে রাজি হচ্ছেন না, অবশেষে বললাম, তাহলে আমি বাজারে যাই।
ব্যাগ নিয়ে রওনা হলাম। ভাবছি, যদি সত্যিই না থাকবেন, তাহলে এবার বাজারে যাওয়া দেখে বলবেন, “না না, বাজারে যাওয়ার দরকার নেই, আমরা থাকতে পারছি না আসলে।”
কিছু বললেন না ওনারা। আমি বিশ টাকা পকেটে নিয়ে প্রথমে গেলাম একটা মুদির দোকানে। যে দোকান থেকে সবসময় জিনিস কিনি সে দোকানে নয়, কারণ, গত কালকেই অনেক কিছু এনেছি ওনার দোকান থেকে, এ অবস্থায় আজকেই আবার বিলাসী দ্রব্য কিনতে গেলে ভালো কথা হবে না।
অন্য একটি দোকানে গেলাম। ঐ দিন ২১শে ফ্রেব্রয়ারি ছিল, মানে সরকারি ছুটি, সুযোগটা নিলাম। প্রথমে দোকানদারের সাতে কুশল বিনিময় করে বললাম, ভালোই একটা বিপদে পড়েছি, ব্যাংকে গিয়ে দেখি ব্যাংক বন্ধ (পাশে অগ্রণী ব্যাংকের একটা শাখা আছে), এখন টাকা তুলবই বা কী করে, বাজার করার তাহলে কী হবে!
আমার আপদমস্তক তাকিয়ে দোকানদার বললেন, কী নেবেন, আমার কাছ থেকে নেন, টাকা তুলে পরে দিয়ে দেবেন! আমি বললাম, বেশিদিন এই এলাকাই আসি নাই, হুট করে কারো কাছ থেকে বাকীতে জিনিস চাইব!
তবে সত্য হচ্ছে, এলাকায় আসার প্রথম সপ্তাহ থেকেই আমি বাকীতে জিনিস কিনি। উনি এক গাল হাসি দিয়ে বললেন, আপনার সাথে সমস্যা হবে না। [আমাকে উনি কী চিনল তা তিনিই জানেন] । সুযোগ পেয়ে ধুমায়ে কিনলাম। ১৩৬০ টাকা বিল করে ব্যাগ বোঝাই করলাম।
এখন কাঁচা বাজার করতে হবে। যেহেতু পোলাউ মাংস খাওয়ানো হবে, তাই মাছ না কিনলেও হবে। আলু মুদির দোকান থেকেই কিনেছি, দই স্প্রািইট -এসবও কিনতে পেরেছি ঐ একই দোকান থেকে, কফিও কিনেছি। এখন মাংস কিনেলেই হয়। তা আবার দেশি মুরগী কিনতে হবে, না হলে মান সম্মান সন্দেহবাতিকগ্রস্থ স্বামীর হঠাৎ আক্রমণে নববধুর কাচের চুড়ি ভেঙে পড়ার মত ভেঙে পড়বে।
বিশাল ব্যাগ পাশে রেখে মুরগীর দোকানদাররে বললাম, মামা কেমন আছেন, যদিও তার সাথে কথা এই প্রথম। বললেন, ভালো আছি। চা খাওয়াতেই চাইলাম, পাশে চায়ের দোকান একটা আছে যদিও সেখানে চা খাওয়ার পরিবেশ খুব একটা না।
দুপুর বেলায় ক্রেতার ভিড় নেই তাই দোকানীকে এটা ওটা বলছি। উনি জিজ্ঞেস করলেন, “হঠাৎ কেন চা খাওয়াতে চাইলাম?” বললাম, আসলে অনেক কিনে পকেটের টাকা সব শেষ, এখন মুরগী না কিনলে তো অতিথি আপ্যায়ন হবে না, তাই আপনাকে একটু খাতির করছি, বাকীতে মুরগী চাইব কিনা, না হলে তো বাসায় গিয়ে টাকা নিয়ে আসতে হয় আবার।
সরলতার এ ভাণ লোকটিকে মুগ্ধ করল। পাশাপাশি একজন “ভদ্রলোকের ছ্যবালামিতে” তিনি কিছুটা মজাও পাইলেন নিশ্চয়ই, ভাব নেওয়ার একটা সুযোগ তৈরি করে দেওয়াও সম্ভব হয়েছে।
কোনো কথা না বলে উনি দুটো মরগী কাটার অর্ডার দিলেন তার সহকারিকে। আমি ওনার অাস্থা অর্জন করার জন্য ২০ টাকা থেকে ১১ টাকা দিয়ে একটা বেনসন সিগারেট কিনে ধরালাম।
মুরগী তৈরি হল। এবার রিক্সা করতে হবে। কিন্তু পকেটে আছে আট টাকা। ইচ্ছে করেই সিগারেটের দোকান থেকে চারটে দুই টাকার নোট নিয়েছি। খুচরো এক টাকা রেখে এসে বলেছি, থাক, পরে সমন্বয় করবেন। এ ধরনের উদারতা এবং বোকামী মানুষ পছন্দ করে। বিশেষ করে ওরা। এতে ঐ ছোট্ট পরিবেশে আমার সম্পর্কে একটা ‘পজেটিভ ইমেজ’ তৈরি হবে।
রিক্সায় উঠলাম। বাসার কাছে এসে পাশের দোকান পর্যন্ত কথাটা পৌঁছায় ঠিক এতটা জোরে রিক্সালাকে বললাম, ৫০০ টাকা খুচরো হবে, ও বলল, ‘না’, এবার আমি আরো জোরে বললাম, তোমরা তো কোনো সময় ৫০০ টাকা খুচরো করতে পারো না।
কী আর করা, পাশের দোকান থেকে ২০ টাকা নিয়ে রিক্সা ভাড়া মিটালাম। রিক্সা থেকে নেমে ব্যাগ নিয়ে উঠলাম ৪ তলায়। দেখি, আমার মহামান্য অতিথিরা তখন চলে যাবেন যাবেন করছেন। অর্থাৎ, আমি বাজারে যাওয়াতে ওনারা নিশ্চিত হয়েছেন যে ওনাদের যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখন অন্য কোনো বাসায় গুরুত্ব যাচাই করতে রওনা হলেন।