কৃষক ও কৃষির উন্নয়নেই মূলত প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি)। ব্যাংকটি থেকে কৃষকদের ঋণপ্রাপ্তির অধিকারও তাই বেশি। যদিও কৃষিঋণ থেকে সরে এসে আমদানি-রফতানিসহ বাণিজ্যিক ঋণেই ২০০৮ সালের পর বেশি ঝুঁকে পড়ে বিশেষায়িত ব্যাংকটি। কৃষকদের বঞ্চিত করে ঋণ দেয়া হয় ধনী ব্যবসায়ীদের। ওই ঋণের বড় অংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে, যা বাড়িয়ে দিচ্ছে ব্যাংকটির লোকসানের অংক।
কৃষি ব্যাংকের এ পতনে উদ্বিগ্ন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। বিশেষায়িত ব্যাংকটি বন্ধ করে দেয়ার কথাও বলছেন তাদের কেউ কেউ। আর এ অবস্থা থেকে বাঁচতে সরকারের কাছে নতুন করে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা মূলধন চেয়েছে কৃষি ব্যাংক। যদিও ব্যাংকটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গত সাত বছরে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি মূলধন জোগান দিয়েছে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর শেষে কৃষি ব্যাংকের বিতরণকৃত ১৭ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৪ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে পড়েছে। খেলাপি ঋণের অর্ধেকই রয়েছে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে; যারা কৃষি নয়, ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
কৃষি ব্যাংকের খেলাপিদের মধ্যে সবার শীর্ষে রয়েছেন ফেয়ার ইয়ার্ন প্রসেসিং লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মো. জসিম আহমেদ। ২০১০ সালে কারওয়ান বাজার শাখা থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে ৩২১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ঋণ দেয় ব্যাংকটি। বড় অংকের এ ঋণ বিতরণের পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে কোনো অর্থ আদায় হয়নি।
কৃষি ব্যাংক থেকে ১৩৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে কেয়া ইয়ার্ন মিলস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী আব্দুল খালেক পাঠানের নামে অনুমোদনকৃত বড় অংকের এ ঋণ দেয়া হয় ব্যাংকটির কারওয়ান বাজার শাখা থেকে। ওই ঋণও আদায় করতে পারেনি কৃষি ব্যাংক। বিষয়টি এখন আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।
একইভাবে ব্যাংকটির চট্টগ্রাম ষোলশহর শাখা আনিকা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলীর নামে ১০১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ঋণ অনুমোদন করে। আনিকা এন্টারপ্রাইজকে দেয়া এ ঋণও আদায় করতে পারেনি ব্যাংকটি। পুরো ঋণই মন্দমানে খেলাপি হয়ে গেছে।
কৃষি ব্যাংকের বনানী করপোরেট শাখা থেকে ১১৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ঋণের নামে লোপাট করেছেন মো. ওয়াহিদুর রহমান নামে গাড়ি ব্যবসায়ী। ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজের নামে ৫১ কোটি ৬০ লাখ, অটো ডিফাইনের নামে ৩২ কোটি ৯২ লাখ ও ফিয়াজ ট্রেডিংয়ের নামে নেয়া ৩২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ঋণের পুরোটাই এখন খেলাপি। এ নিয়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে কৃষি ব্যাংক। রহমান ট্রেডিংয়ের কাছে কৃষি ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ ৬২ কোটি ৭২ লাখ ও মনো ব্যাগ লিমিটেডের কাছে ৫২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এসব ঋণও মন্দমানে খেলাপি হয়ে গেছে।
ব্যাংকটির শীর্ষ খেলাপিদের মধ্যে আব্বাস ট্রেডিংয়ের কাছে ৩১ কোটি, মনো ফিড মিলস লিমিটেডের কাছে ৩৩ কোটি, এনএ করপোরেশনের কাছে ২৬ কোটিসহ শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছেই কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। শীর্ষ এসব খেলাপি গ্রাহকের মধ্যে চট্টগ্রামভিত্তিক ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরাও রয়েছেন।
লক্ষ্য থেকে সরে বড় ব্যবসায়ীদের দেয়া এসব ঋণই মূলত আর্থিক বিপর্যয়ে ফেলে দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত কৃষি ব্যাংককে। ২০১২ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির লোকসান বছরে ২০০ কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এর পর থেকে তা লাগামহীনভাবে বাড়ছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে কৃষি ব্যাংকের লোকসান দাঁড়ায় ৩৮৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪৯৫ কোটি, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৩৪ কোটি ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬০৫ কোটি টাকা লোকসান দেয় কৃষি ব্যাংক। আর চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধেই ব্যাংকটির লোকসানের পরিমাণ ৩৮৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অব্যাহত লোকসানের কারণে ৭ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে কৃষি ব্যাংক, যা পূরণে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে এরই মধ্যে আবেদন করেছে তারা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. ইসমাইল বণিক বার্তাকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে সরকারের দায়িত্ব হলো মূলধন জোগান দেয়া। বিভিন্ন সময় সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে কৃষি ব্যাংক গ্রাহকদের সুদহার কমিয়েছে ও সুদ মওকুফ করেছে। কিন্তু সরকার তার বিপরীতে ব্যাংককে কোনো ভর্তুকি দেয়নি। ফলে সরকারের কাছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা সুদ মওকুফ বাবদ দাবি করা হয়েছে। সরকার এ টাকা দিলে আমাদের মূলধনের পরিমাণ বাড়বে। এছাড়া খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংকের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আশা করছি, চলতি বছর শেষে বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের কৃষি খাতের সম্প্রসারণ ও কৃষকদের ভাগ্যবদলে কাজ করে আসছিল বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। কিন্তু সাবেক চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোখতার হোসেনের হাত ধরে ২০০৮ সাল থেকে পুরোদমে বাণিজ্যিক ব্যাংকিংয়ে নামে কৃষি ব্যাংক। কৃষিঋণ থেকে সরে এসে বড় অংকের ঋণ দেয়া হয় ব্যবসায়ীদের, যা খেলাপি হয়ে পড়ে।
ব্যাংকটিতে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বছরের পর বছর ধরে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা দুর্নীতিবাজদের লালন করেছেন। ফলে কৃষি ব্যাংকের ভেতরে দুর্নীতিবাজদের একটি বলয় সৃষ্টি হয়েছে। এ বলয় ভাঙতে না পারলে ব্যাংকটির ভবিষ্যত্ আরো অন্ধকারে যাবে।
সমস্যা জর্জরিত হলেও দশকের পর দশক ধরে কৃষি ব্যাংক এগুলোর সমাধান করছে না বলে জানান ব্যাংকটি পরিদর্শনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, কৃষি ব্যাংকের অসমন্বিত আন্তঃব্যাংক হিসাবের পরিমাণ তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এগুলোর কোনো সমাধান করছে না ব্যাংকটি। ব্যাংকটির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। দুর্নীতি করেও তারা নির্বিঘ্নে অবসরে চলে যাচ্ছেন। এভাবে একটি ব্যাংক চলতে পারে না। মূলধন জোগান না দিয়ে কৃষি ব্যাংক বন্ধ করে দেয়ার সময় এসেছে।
কৃষি ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখাপাত্র শুভঙ্কর সাহা। তিনি বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সচেষ্ট রয়েছে।
সংবাদটি বণিক বার্তা হতে নেওয়া।