পিঠে হুক গেঁথে চরকির মত মানুষ ঘোরার কথা শুনেছি। এবার পহেলা গিয়েছিলাম সেই চড়ক দেখতে। বাংলাদেশের নানান জায়গায় চড়ক পূজা হয়। চড়ক পূজা চৈত সংক্রান্তি বা পহেলা বৈশাখে অনেক জায়গায় অনুষ্ঠিত হলেও পিঠে হুক গেঁথে মানুষ ঘোরে দেশের মাত্র কয়েকটি জায়গায়। এরকম একটি স্থান নবীনগরের নলাম গ্রাম। ওখানে চড়কে মানুষ ঘোরে।
নলামের অনুষ্ঠানটি দেখার জন্য এবার আমরা নবীনগর গিয়েছিলাম। পার্বনের আগের দিন লম্বা শক্ত গাছটি এনে যথাস্থানে রাখা হয়। পহেলা বৈশাখের দিন সকালে শক্ত করে গাছটি পোঁতা হয়। পোঁতার সময় বিভিন্ন ‘মন্ত্রতন্ত্র’ করা হয়।
পার্বনটির প্রস্তুতি পর্ব অনেক দীর্ঘ হলেও মুল অনুষ্ঠান মাত্র দশ পনেরো মিনিটের। হুকে বিদ্ধ সন্ন্যাসী এবং তার গুরুর উপস্তিতিতে ছোট্ট করে চড়ক পূজাটি অনুষ্ঠিত হয়, এরপর হয় ঘোরার পর্ব এবং এটিই চড়ক পূজার মূল আকর্ষণ।
পিঠে হুক বিদ্ধ করে ত্রিশ-চল্লিশ ফুট উপরে ঘুরছে একজন ‘সন্ন্যাসী’। ওনার হাতে রয়েছে একটি ছোট্ট ত্রিশুল, পুটলিতে রয়েছে বাতাসা। মাঝে মাঝে তিনি মুঠি করে নিচে বাতাসা ছিটিয়ে দিচ্ছেন। নিচ থেকে “বলোরে ভাই সন্ন্যাসী” বলে ধ্বনি দেওয়া হচ্ছে।
হুক খোলার বিষয়টি আরো বেশি যন্ত্রণাদায়ক। একই মন্দিরে গুরুর উপস্থিতিতে হুক খেলা হচ্ছে।
নিঃসন্দেহে এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি প্রথা। গতবছরই এই নলামে ঘটেছিল দুর্ঘটনা। পাশের ছোট্ট গাছে বাড়ি লেগে ঘুর্নণরত সন্ন্যাসী আহত হয়েছিলেন। মাত্র কয়েক পাক জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘুরলেই মাথা ঘোরে সেক্ষেত্রে বিশ ত্রিশ ফুট উপরে হুকে বিঁধে ঝুলে জোরে জোরে ঘুরলে এমনিতেই ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। এবার উপরিউক্ত সন্ন্যাসীকে ঘোরানো হল ত্রিশ চল্লিশ পাক, এরপর আমরা কয়েকজন তাকে নামাতে বললাম। ঘুরাতে ঘুরাতে এমনই জোস চলে আসে যে কর্মী এবং দর্শক কারোরই হুঁস থাকে না এইসময়।
ভালো মন্দ যেমনই হোক প্রথা প্রথাই, স্থানীয়রা চায় না এ অনুষ্ঠানটি বন্ধ হোক, তারা চায় এটি যেন আরো নিরাপদভাবে অনুষ্ঠিত হয়। যদিও অনেকের ভিন্নমতও রয়েছে, তারা বলছে, বিষয়টি মানবিক নয়।
চড়ক পূজা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি লোকোৎসব। এই উৎসবটি মূলত শিবের এক ধরনের পূজা, যেটি শিবের নানা নাম যেমন চড়ক পূজা, বালা পূজা ও নীল পূজা বলেও পরিচিত, কেউ কেউ এটিকে চৈত পূজাও বলে।
এটি বাঙ্গালী হিন্দুদের বেশ পুরাতন একটি পার্বন। ব্রিটিশ আমলে আরো ভয়ঙ্করভাবে চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হত। তবে বিভিন্ন সময়ে অনেক দুর্ঘটনা ঘটায় ধিরে ধিরে পার্বনটির কলেবর কমে আসে।
প্রথা অনুযায়ী আগের দিন চড়ক গাছটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। গাছটি পূজারিদের কাছে “বুড়োশিব” নামে পরিচিত।একজন পতিত ব্রাক্ষ্মণ এ পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হিসেবে নানান ধরনের ভয়ঙ্কর কর্ম যেমন- জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুঁড়ির ওপর লাফানো, বাণফোঁড়া, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা, ঘোরা ইত্যাদি করা হয়।
ভূতপ্রেত তাড়ানো এবং পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন সমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ, এটিও সেরকম একটি প্রথা। এ ধরনের পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে ভক্ত বা সন্ন্যাসীকে (চড়ক গাছে যে ঘোরে তাকে সন্ন্যাসী বলা হয়) লোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে, অথবা পিঠে হুক লাগিয়ে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়।
কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা গায়ে ফুঁড়ে দেয়া হয়। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এ ধরনের প্রথা বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এখনো তা প্রচলিত আছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন, টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, গাজীপুর, নবীনগরের নলাম, যশোর জেলার কয়েকটি স্থানে এবং কখনো কখনো পুরনো ঢাকার শাঁখারী বাজারেও প্রথাটি এখনো অনুষ্ঠিত হয়।
ছবি ও ভিডিও: ফলোআপ নিউজ