বর্তমান মুসলিম বিশ্বে সহজেই প্রতারণা করা যায়, যদি কেউ দু’টি শব্দের একটিও ব্যবহার করে। আর অশিক্ষিত, সাধারণ শিক্ষিত লোকজন এই শব্দের মাহাত্ব্যের (বুঝুক চাই না বুঝুক) কারণে প্রতারণার শিকার হওয়ার জন্য একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। শব্দ দু’টি হল: ‘বৈজ্ঞানিক’ ও ‘ইসলাম’ । এ শব্দ দুটিকে পুঁজি করে সারাবিশ্বে সহজেই ব্যাপক প্রতারণা চলছে। আর মানুষও প্রতারিত হবার জন্য মনে হয় উঠে পড়ে লেগেছে। আমাদের দেশও এর বাইরে নয়। আর তাইতো আমাদের দেশে প্রতারক চক্র এই শব্দ দুটির প্রয়োগে অভিনব কায়দায় সাধারণ মানুষের সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে।
আমাদের দেশে বিজ্ঞান বিষয়টি এখনও সেরকম প্রতিষ্ঠিত বা জনপ্রিয় হতে না পারলেও ‘বৈজ্ঞানিক’ শব্দটি কিন্তু বেশ প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয়ও বটে। এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করেই কেউ ‘বৈজ্ঞানিক’ পদ্ধতিতে মাত্র সাতদিনে ইংলিশ শিখিয়ে দিচ্ছে। কেউবা ১ মাসে শুদ্ধ উচ্চারণে কুরআন পড়া শিখিয়ে দিচ্ছে। কেউ ‘বৈজ্ঞানিক’ পদ্ধতিতে ভাগ্য গণনা করে ভবিষ্যত বলে দিচ্ছে আবার কেউ ‘বৈজ্ঞানিক’ পদ্ধতিতে জীবনে সুখ আনবার ট্রেনিং দিচ্ছে। চারপাশে অবৈজ্ঞানিক সব ব্যাপার স্যাপারকে দিব্যি ‘বৈজ্ঞানিক’ শব্দটির মোড়কে ঢেকে ফেলে অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারচ্ছন্ন মানুষকে সহজেই বিভ্রান্ত করে ‘তা’ হাতে গছিয়ে দিচ্ছে। ‘বৈজ্ঞানিক’ শব্দটির চেয়েও আমাদের দেশের আরেকটি অধিক জনপ্রিয় শব্দ হল ‘ইসলাম’। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার এ দেশের মানুষ অনেক আগে থেকেই ধর্মভীরু। এই ধর্মভীরুতার সুযোগ নিয়ে অনেকেই যে কোন কিছুর গায়ে ‘ইসলাম, ইসলামিক বা হালাল এইসব শব্দ জুড়ে দিয়ে নিজেদের ফায়দা লুটে নিচ্ছে। এজন্য বাজারে ‘হালাল বা ইসলামিক’ পণ্য বেশ দেখা যায়। সুদের ব্যবসা করেও ‘ইসলামী ব্যাংক বা ইসলামী ব্যাংকিং’ এখন জনপ্রিয় ব্যংকিং ব্যবস্থা। লোকজনও হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এসবের পাশাপাশি দেখা যায় ‘ইসলাম’ লেবেল সাটানো বিভিন্ন জ্যোতিষী ও পীরদের অবাধ প্রতারণা ব্যবসার দৌরাত্ম্য। এদেশের মানুষ তথাকথিত ধর্মভীরু, ধর্মান্ধ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন হওয়ায় যে কোন ব্যবসা বা মতবাদ, তা ইসলামের সাথে যতই সাংঘর্ষিকই হোক না কেন, ইসলামিকভাবে প্যাকেট করে বাজারজাত করে তাতে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া যায় নিশ্চিতভাবে। ফলশ্রুতিতে এখন শূন্য (ক্ষেত্রবিশেষে মাইনাস) জ্ঞান নিয়েও যে টপিক নিয়ে উদ্দাম আলোচনায় মত্ত হওয়া যায়, তা হল ‘ইসলাম’। জেনে, বুঝে, দল নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে ‘ইসলাম’ পালন এখন নিতান্তই ক্ষুদ্র, ব্যক্তিগত উদ্যোগের মাঝে সীমাবদ্ধ। আর সেই সাথে যে কোন ধরনের বিভ্রান্ত মতবাদ প্রচার করার জন্য বাংলাদেশ এখন সর্বশ্রেষ্ঠ ‘ক্ষেত্র’। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে প্রতারকচক্র সাধারণত দু’টি শব্দের যে কোন একটি-র ব্যবহারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তবে এই প্রক্রিয়ায় একসাথে দু’টি শব্দের যৌগ লেবেল এটে চমক দেখানো মহাপ্রতারণায় কৌশলে প্রতিষ্ঠিত একমাত্র ব্যক্তি হল শহীদ আল বোখারী ওরফে মহাজাতক। মহাজাতক প্রতারণার জগতে এখন এক অনন্য ‘আদর্শ’। সে বিজ্ঞান এবং ইসলামের ভুয়া তথ্য সংযোজনের মাধ্যমে এক জগাখিচুড়ির আধুনিক ‘সুফিবাদ’-কে ‘কোয়ান্টাম মেথড’ নাম দিয়ে বাজারজাত করে ব্যবসায়িকভাবে বেশ সফল। বোধ বুদ্ধিহীন সাধারণ শিক্ষিত মানুষজন মহাজাতকের ফর্মুলার ফাঁদে পড়ছে নিয়মিত। তার এই প্রতারণার ফাঁদে লোকজন যাতে আরো বেশি বেশি পা দেয়, এরজন্য সে অন্যান্য প্রতারকদের (যেমন লিটন দেওয়ান, কুতুববাগী, দেওয়ানবাগী প্রমুখ) মতই দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে কৌশলে ব্যবহার করছে। আর ঐসব বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান না থাকায় ‘অন্ধের হাতি দেখা’-র মতই মহাজাতকের প্রতারণার গুণগান করছেন। ডেসটিনি-র ক্ষেত্রেও দেশের বিশিষ্ট অনেক ব্যক্তিই এরকমই অন্ধের মত গুণগান করেছিলেন। দুঃখজনক বিষয়টি হল এসব বিশিষ্ট ব্যক্তির গুণগানের কারণে সাধারণ মানুষ সহজেই আকৃষ্ট হয়ে এই মহাপ্রতারকের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব উজাড় করে দিচ্ছে (আল্লাহ তা’আলা এসব বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বোধশক্তি দান করুন)।
মহাপ্রতারক মহাজাতকের প্রতারণার বিশদ এক কিস্তিতে এক সংখ্যায় লিখে শেষ করা অসম্ভব। আর তাই কয়েক কিস্তি পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরতে হবে। মহাপ্রতারণার বিশদ এই প্রতিবেদন তৈরিতে অনেক ব্যক্তি, আলেমে দ্বীন, বৈজ্ঞানিক, কুরআন, হাদীছসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-এর সহযোগিতা গ্রহণ করতে হয়েছে। মহান আল্লাহ তা’আলা ছাড়াও অন্য সকলের নিকটেই কৃতজ্ঞ।
একসময়ের স্বল্প আয়ের অতি সাধারণ এক গণক (জ্যোতিষী) মহাজাতক গণক বিদ্যা দিয়ে পত্রিকার জন্য রাশিফল লিখেই দিনাতিপাত করছিল। মেডিটেশনের Concept তার চোখ খুলে দেয়। এদেশে মেডিটেশন নামক অর্থহীন এই ধারাটি সর্বপ্রথম নিয়ে আসেন মাহী কাজী নামের এক ভদ্রলোক। তার আনীত মেডিটেশন পদ্ধতির নাম ছিল Silva Method, আর এর প্রতিষ্ঠাতা হল স্প্যানিশ বংশোদ্ভুত Mexico-i Jose Silva. মহাজাতকসহ এদেশের বহু ব্যক্তি মাহী কাজীর নিকট Silva Method-র প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রাজুয়েট-এর সার্টিফিকেটও গ্রহণ করে। বহু তারকাখ্যতিসম্পন্ন ব্যক্তি Silva গ্রাজুয়েট। মহাজাতক মূলত Silva Method-র এই রমরমা বাজার দেখে অনুপ্রাণিত হয় যে, এদেশে বিজ্ঞান-এর নামে অনেক কিছুই সম্ভব। আর সাথে যদি ইসলাম জুড়ে দেয়া যায় তাহলে তো কথাই নেই। মূলত: সুফীবাদের ধ্যান তত্ত্ব + ইসলামের নামে কুরআনের কিছু আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা + কিছু জাল হাদীস + জ্যোতিষ শাস্ত্র = ব্যস হয়ে গেল বোকা, মানসিকভাবে বিপন্ন মানুষদের ফাঁদে ফেলার এক মোক্ষম ফর্মুলা ‘কোয়ান্টাম মেথড’ তথা ‘Living of Science’। আর দলে দলে নির্বোধ, সাধারণ শিক্ষিত, হতাশাগ্রস্ত, মানসিকভাবে বিপন্ন মানুষেরা মহাজাতকের মহাপ্রতারণার ফাঁদে পা দেওয়া শুরু করল। আর মহাজাতকও অর্থ-সম্পদ বিত্ত-বৈভবের মালিক হতে লাগল। মহাজাতকের এই ফর্মুলা হিট হওয়ার পর সে তার নামকে অমর ও ঈশ্বরতূল্য করতে পীরেদের মত করেই বাবা, মুর্শিদ কেবলার বদলে ‘গুরুজী’ উপাধি নিয়ে অনুসারীদের (নাকি শিক্ষিক গোলামদের!) মাঝে নিজ আসন মজবুত করে নিল। শুধু তার নয় তার স্ত্রীর ক্ষেত্রেও মর্যাদাসম্পন্ন উপাধি-র প্রচলন করেছে, তার স্ত্রীকে মাতাজী বা মাদাম বলা বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি সে অর্থ-আয়ের নিরবিচ্ছিন্ন নানা উপায় অবলম্বন করেছে। মাটির ব্যাংক, যাকাত ফান্ড, আইসিটি ট্রেনিং, সদকা হিলিং, লামা সাফারী ইত্যাদির মাধ্যমে। মহাজাতকের মহাধোকাবাজির আয় হল মূলত মেডিটেশন কোর্সের (শিষ্য তৈরি বা গোলাম তৈরি!) নামে। ৪ দিনের এই কোর্সের জন্য নিচ্ছে ৯৫০০ টাকা করে। এই মেডিটেশন বা দীক্ষা কোর্সের মাধ্যমেই চটকাদার সত্যমিথ্যা, বানানো কথা বলে টাকাও নিচ্ছে আবার গোলামও পাচ্ছে ফ্রি! সবটাই লাভে লাভ। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, মহাজাতকের অনুসারীরা একটা কথা বলে যে, মহাজাতক কত ভাল ভাল কাজ করছেন। যেমন, রক্তদান, অনাথ শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা, থাকা খাওয়া পোশাক সবকিছুই করছেন তাহলে এটা খারাপ কিভাবে হয়? এ প্রসঙ্গে একটাই কথা বলা যায় যে, কোন ব্যক্তি ডাকাতি করে অর্থোপোজন করে এতিমখানা, মসজিদ, মাদ্রাসা করেছে। তাহলে কি ঐ ব্যক্তির ‘ডাকাতি’ কারাটা জায়েজ হয়ে গেছে!
আবার মহাজাতকের ফর্মূলায়, শিরক, বিদা’আত, কুফর-এর ছড়াছড়ি রয়েছে এমনকি তার ‘সাফল্যের চাবিকাঠি, কোয়ান্টাম মেথড’ গ্রন্থের একাধিক স্থানে তার ‘নাস্তিক’ মন-মানসিকতার পরিচয়ও পাওয়া যায় অথচ ধুরন্ধর মহাজাতক তার ‘প্রার্থনা’ বাক্য সাজিয়েছে সুরা ফাতিহাসহ কুরআনের অন্যান্য সুরা-দোয়া ও হাদীছের দোয়া থেকে। কখনো কেউ মহাজাতকের ভন্ডামির প্রমাণভিত্তিক কথা বললে মহাজাতক তার শিষ্যদের নিকট তাকে ‘মুর্খ’ অভিহিত করে এড়িয়ে যায়। প্রথমেই মহাজাতকের তথাকথিত ‘Science of Living’ অর্থাৎ ‘জীবনযাপনের বিজ্ঞান’ বা কোয়ান্টাম মেথড-এর বিজ্ঞানভিত্তিক কয়েকটি প্রতারণামূলক বক্তব্য উল্লেখ করা হল।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও কোয়ান্টাম মেথড
* এ ব্যাপারে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ভাষ্য হচ্ছে-
এই “কোয়ান্টাম” নামটি এসেছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স থেকেই।
কোয়ান্টাম শব্দটি নেয়া হয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স থেকে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আগে বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রিত হতো নিউটনিয়ান মেকানিক্স দিয়ে। আমরা জানি, বিজ্ঞানী নিউটন এবং ম্যাক্সওয়েলের সূত্র অনুসরণ করে পদার্থবিজ্ঞান ঊনবিংশ শতাব্দির শেষভাগে এক সুশৃঙ্খল বিশ্বদৃষ্টি উপস্থাপন করে। এই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সবকিছুই ছিলো এক
নিয়মের অধীন, সবকিছুই হিসেব করে বলে দেয়া যেত। সেখানে বিজ্ঞানীর কোনো ভূমিকা থাকলো না। বিজ্ঞানী
ছিলেন একজন দর্শকমাত্র আর পুরো প্রক্রিয়া হচ্ছে দর্শক-মন নিরপেক্ষ। অর্থাৎ মনের কোনো ভূমিক া আর
থাকলো না। বিজ্ঞান থেকে মন নির্বাসিত হলো এবং বস্তুবাদের বিকাশ ঘটলো (কোয়ান্টাম হাজারো জবাব-পর্ব ১।। মেডিটেশন মহাজাতক; প্রথম প্রকাশ -১৫ জুন, ২০১২। পৃষ্ঠা-১৫)।
পরমাণু পর্যন্ত নিউটনিয়ান মেকানিক্স ভালোভাবেই সবকিছুর ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হচ্ছিলো। কিন্তু বিজ্ঞান যখন
পরমাণুর গভীরে বা সাব- এটমিক লেভেলে ঢুকলো তখন দেখা গেল একটা সাব-এটমিক পার্টিকেল-পার্টিকেল
ফর্মে আছে, না এনার্জি ফর্মে আছে তা হিসেব করে বলা যাচ্ছে না, দেখে বলতে হচ্ছে। যেকোনো সময় এটা পার্টিকেল ফর্মে থাকতে পারে, যেকোনো সময় এটা এনার্জি ফর্মে থাকতে পারে। এটাই হলো
ওয়ার্নার হেইজেনবার্গের আনসারটেইনিটি প্রিন্সিপল। বিজ্ঞানে তখন আবার দর্শকের আগমন ঘটলো (কোয়ান্টাম হাজারো জবাব-পর্ব ১।। মেডিটেশন মহাজাতক; প্রথম প্রকাশ -১৫ জুন, ২০১২। পৃষ্ঠা-১৫)।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স বিংশ শতাব্দিতে এসে বিজ্ঞান থেকে নির্বাসিত মনকে আবার বিজ্ঞানে পুনর্বাসিত করে।
যেহেতু কোয়ান্টাম মেকানিক্স বিজ্ঞান থেকে নির্বাসিত মনকে বিজ্ঞান পুনর্বাসিত করে, তাই চেতনার শক্তিকে,
মনের বিশাল ক্ষমতাকে নিজের ও মানবতার কল্যাণে ব্যবহারের সহজ ও পরীক্ষিত এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটির
নামকরণ করা হয়েছে কোয়ান্টাম মেথড(কোয়ান্টাম হাজারো জবাব-পর্ব ১।। মেডিটেশন মহাজাতক; প্রথম প্রকাশ -১৫ জুন, ২০১২। পৃষ্ঠা-১৫)।
মন ও চেতনার ক্ষমতা সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গির সার-সংক্ষেপ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ইউজিন উইগনার তাঁর ‘Remarks on the Mind-Body Question’ নিবন্ধে চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন অধিকাংশ পদার্থ বিজ্ঞানীই এই সত্যকে মেনে নিয়েছেন যে, চিন্তা অর্থাৎ মনই হচ্ছে মূল। ‘চেতনার উল্লেখ ছাড়া কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর নিয়মকে পুরোপুুরি সঙ্গতিপূর্ণভাবে গঠন করা সম্ভব নয়।’
নিবন্ধের উপসংহারে বিজ্ঞানী উইগনার বলেছেন, ‘বিশ্বের বৈজ্ঞানিক গবেষণা শেষ পর্যন্ত চেতনাকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।’ [সাফল্যের চাবিকাঠি কোয়ান্টাম মেথড-মহাজাতক, পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণ-জানুয়ারি,২০০০। পৃষ্ঠা-১৩]
** কোয়ান্টাম মেথড কি? মহাজাতকের ভাষ্যমতে এককথায় ‘Science of Living’ আশ্রম ও খানকার চৌহদ্দি থেকে বের করে ধ্যানকে ‘গণমানুষের আত্মউন্নয়ন ও ব্যক্তিত্বের বিকাশে’ প্রয়োগ করাই তাদের উদ্দেশ্য। ধ্যানচর্চার মাধ্যমে প্রাচ্যের সাধনা আর আধুনিক বিজ্ঞানের নির্যাসে সঞ্জীবিত কোয়ান্টাম মেথড মেডিটেশন প্রক্রিয়া। সাধকদের সাধনা ও মনোবিজ্ঞানের প্রক্রিয়ার সমন্বয়ের ফলে সহজে মেডিটেটিভ লেভেলে পৌছে আত্মনিমগ্ন হওয়া যায়। সোজা কথায় ধ্যান চর্চার মাধ্যমে জীবনযাপনের বিজ্ঞান এটি।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের এই ‘কোয়ান্টাম’ নামটি নেয়া হয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স থেকে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স কি? কোয়ান্টাম মেকানিক্স এক জটিল বিষয়। অনেক জ্ঞানী ব্যক্তিও এই থিওরি বুঝতে পারে না। আর তাই এর কঠিনত্ব নিয়ে রসিক বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান বলেছিলেন, I Think I Can safely say that nobody quantum mechanics. একটা সময় ছিল যখন পদার্থ বিজ্ঞান ছিল মূল বিজ্ঞান। আর পদার্থ বিজ্ঞানের মূল বিষয়গুলো এসেছিল আইজ্যাক নিউটনের সূত্র ধরে। সেটাকে বলা হত কাসিক্যাল মেকানিক্স। সবকিছু সেসব সূত্র ধরেই চলছিল। একসময় ধারণা করা হল যে, পদার্থবিদ্যার সবকিছুই আবিস্কার হয়ে গেছে। নতুন আর কিছুই আবিস্কার করার নেই। পুরো পদার্থবিদ্যা জগতে নেমে এলো স্থবিরতা। পদার্থবিদ্যা বাদ দিয়ে লোকজন জীববিজ্ঞান, রসায়ন-এইসব বিষয় নিয়ে মেতে উঠল। পদার্থবিদ্যার যখন এই অবস্থা তখন হঠাৎ দেখা গেল যে পদার্থবিদ্যার বেশ কিছু জিনিস কাসিকাল মেকানিক্স দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। যেমন ইলেক্ট্রনের আচরণ। আর সেরকম এক সময়ই ম্যাক্সপ্লাংক কোয়ান্টাম মেকানিক্স নামে এক বিদ্যা তৈরি করে ফেললেন। এর মধ্যে হাইজেনবার্গ তার বিখ্যাত ‘অনিশ্চয়তার সূত্র’টি দিয়ে দিলেন। তিনি বললেন যে, বস্তুর গতি ও অবস্থান কখনোই একসাথে বের করা যাবে না। কিছু অনিশ্চয়তা থাকবেই। এই অনিশ্চয়তা কতটুকু তাও তিনি বের করে দিলেন। আইনস্টাইন সে সময় খুব বিরক্ত হলেন। তিনি বললেন, সব বস্তু যেহেতু প্রকৃতির মাঝে রয়েছে তাই প্রকৃতি সব বস্তুর বেগ ও অবস্থান জানে। প্রকৃতিতে কোন অনিশ্চয়তা নেই। কাজেই আমাদের কোন অনিশ্চয়তা নেই। এ সময়ই আইনস্টাইন তার বিখ্যাত উক্তিটি করেন, “ঈশ্বর পাশা খোলেন না (God does not play dice)”। তিনি উঠে পড়ে লাগলেন ‘অনিশ্চয়তার সূত্র’ ভুল প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু তা করতে গিয়ে তিনি থিওরিটিকে আরো পাকাপোক্ত করে ফেলেন। নিলস বোর তাকে দেখিয়ে দেন যে কিভাবে অনিশ্চয়তা কাজ করছে। আইনস্টাইন বাধ্য হয়ে সুত্রটির যথার্থতা স্বীকার করলেও, তিনি কোয়ান্টাম থিওরি নিয়ে কখনোই পুরোপুরি নিঃসন্দেহে হতে পারেননি।
আইনস্টাইনের মত কোয়ান্টাম থিওরি বাতিল প্রমাণ করার জন্য কাজ করছিলেন বিজ্ঞানী শ্রোডিঙ্গার। তিনি নিজে যদিও কোয়ান্টাম ফিজিক্সের জনকদের একজন (এবং তরঙ্গ সমীকরণ বা Wave Equation এর আবিষ্কারক), তারপরও পদার্থবিদ্যায় সম্ভাবনা (probability) ও অনিশ্চয়তার ব্যাপার তিনি বিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি এক কল্পিত এক্সপেরিমেন্টের কথা বললেন। সেই এক্সপেরিমেন্টে একটি বিড়াল আছে একটি বাক্সের মধ্যে, যে বাক্সে রয়েছে এক বোতল বিষাক্ত গ্যাস, বোতলের উপর একটা হাতুরি, হাতুড়িটা আবার একটা গিগার কাউন্টারের (যা দিয়ে তেজষ্ক্রিয়তা মাপ হয়) সাথে যুক্ত, কাউন্টারটির পাশেই রয়েছে একটুকরো তেজষ্ক্রিয় ইউরেনিয়াম। ধরা যাক, ৫০% সম্ভাবনা যে ইউরেনিয়াম অ্যাটম এক সেকেন্ড পর ভেঙ্গে যাবে। সাথে সাথেই গিগার কাউন্টারটি সচল হবে, ফলে হাতুরি আছড়ে পড়বে বোতলে, শুরু হবে বিষক্রিয়া। এখন এই ঘটনার ফলে বাক্সেও ভেতর বিড়ালটি বেঁচে আছে কি মারা গেছে – এ প্রশ্নের সাধারন কোন উত্তর নেই, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিড়ালটি বেঁচেও আছে আবার মারাও গেছে – এই দুই অবস্থাতেই বিদ্যমান। অর্থাৎ একটি বিড়ালের দুটি Wave function থাকবে। বাক্স না খোলা পর্যন্ত আমরা বলতে পারছিনা যে বিড়ালটি জীবিত না মৃত। বাক্স খুললেই কেবল তা জানা সম্ভব, আর তখনই বিড়ালের Wave function collapse করবে। শ্রোডিঙ্গারের কাছে ব্যাপারটি খুবই হাস্যকর ছিল। তিনি বললেন, আমরা যখন দেখব তখনই বিড়ালের ভাগ্য নির্ধারিত হবে, তার আগে না -এ কেমন কথা?
এবার নোবেলবিজয়ী পদার্থবিদ ইউজিন উইগনার এগিয়ে এলেন শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল সমস্যাার সমাধানে। তিনি বললেন যে, ‘‘চেতনাই বস্তুর অবস্থানের নিয়ন্তা (Consciousness determines the existense)’’। কার চেতনা? যে ঘটনাটি দেখছে তার চেতনা, অর্থাৎ Observer এর চেতনা । ব্যাপারটা অনেকটা এরকম -যদি Observer এর মধ্যে চেতনা থাকে তবেই ওয়েভ ফাংশন কলাপ্সের বিষয়টা চলে আসে । সমস্যা দেখা দিল যখন চেতনাকে সংজ্ঞায়িত করতে যাওয়া হল তখন। কারণ পদার্থবিদ্যায় চেতনার কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। পদার্থবিদ্যা চেতনা নিয়ে কাজ করেনা, এটা মনোবিজ্ঞানের বিষয়। বেশিরভাগ ভৌত বিজ্ঞানীরা আবার মনোবিজ্ঞানকে পাত্তা দেন না(http://articles.latimes.com/2012/jul/13/news/la-ol-blowback-pscyhology-science-20120713) | কারণ তাদের মতে মনোবিজ্ঞানে কোন কিছুরই সেরকম কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। যেমন ধরুণ – ‘‘সুখ”। আপনি কিভাবে সুখকে সংজ্ঞায়িত করবেন? কারণ এই জিনিসটা নিয়ে একেকজনের অনুভূতি একেক রকম -এর কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। তাছাড়া এর কোন পরিমাপও নেই । এক কেজি সুখ বা দুুই মিটার সুখ – এভাবে কি সুখকে মাপা যায়? সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা ও পরিমাপ ছাড়া বিজ্ঞান কাজ করেনা। যার ফলে দেখা যায় যে মনোবিজ্ঞান সত্যিকারের বিজ্ঞান কিনা সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝে প্রায়ই তর্ক-বিতর্ক চলে।
যাই হোক, আগের কথায় ফেরত আসি। চেতনাকে যখন সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা যাচ্ছেনা, তখন বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করলেন যে চেতনা ব্যাপারটা নেই এমন থিওরি দিতে এবং তারা সমস্যার একাধিক সমাধানও করে ফেললেন। এই ওয়েভ ফাংশন কলাপ্সের বিষয়টা বেশ বিছু কোয়ান্টাম ইন্টারপ্রেটেশন থেকে এসেছে, এর মধ্যে কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রেটেশন খুব বিখ্যাত। কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রেটেশনে এই ওয়েভ ফাংশন কলাপ্সের কথা বলা আছে ঠিকই কিন্তু ঠিক কি বা কে ‘‘অবজার্ভার’’ হিসেবে বিবেচিত হবে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা নেই। সুতরাং তিনি শুধুমাত্র ‘‘কনসাস অবজার্ভার (Conscious observer )” ইন্টারপ্রেটেশনটি বেছে নিয়েছেন। অন্যদিকে নীলস বোরসহ অনেকেই ওয়েভ ফাংশন কলাপ্সকে শুধু প্রতীকী উপস্থাপনা বলে আখ্যায়িত করেছেন । (http://plato.stanford.edu/entries/qm-copenhagen/)।শেষমেষ ইউজিন উইগনার নিজেই চেতনার ব্যাপারস্যাপার থেকে সরে দাঁড়ান (Michael Esfeld,(1999) Essay Review: Wigner’s View of Physical Reality Studies in History and Philosophy of Modern Physics 30B, pp, 145-154 Elsevier Science Ltd.)|
এদিকে জার্মান পদার্থবিদ ডিটিয়ার বেন বিড়াল সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে বলেন যে, জীবিত বিড়ালের ওয়েভ ফাংশন আর মৃত বিড়ালের ওয়েভ ফাংশন আলাদা থাকবে, একটির সাথে অন্যটির কোন যোগ থাকবেনা। ফলে কোন অবজার্ভারের দরকার পড়বেনা। হিউ এভার্ট লিখলেন যে, শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল একই সাথে জীবিত ও মৃত, কারণ জগৎ দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে, এক জগতে বিড়াল মৃত অন্য জগতে বিড়াল জীবিত। জগৎ দুটি একই জায়গায় একই সময়ে হলেও তারা সম্পূর্ণ আলাদা। জগৎ যদি ভাগই হয় তবে দুটো ভাগে কেন ভাগ হবে? আরো বেশি ভাগেই ভাগ হয়ে যাক! তৈরি হল মাল্টিভার্স থিওরি, যেখানে একইসাথে একাধিক জগৎ নিয়ে আলোচনা করা হয়।
এই হচ্ছে অতি সংক্ষেপে অতি সহজ ভাষায় কোয়ান্টাম মেকানিক্স । কোয়ন্টাম মেকানিক্স ঠিকমত বুঝতে বা বুঝাতে হলে অংকের সাহায্য নিতেই হবে। এখানে অংক প্রয়োগের সে সুযোগ নেই বলে কোয়ান্টাম থিওরিকে অতি সরল লাগলেও লাগতে পারে।
*** যদিও কোয়ান্টাম মেকানিক্স কি বা এটা কি ধরনের থিওরির কথা বলে-এসব ব্যাপারে কোন আলোচনা করেনি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। তবে দেখা যাচ্ছে যে কোয়ান্টাম মেকানিক্সে যেহেতু চেতনার বা মনের একটা কনসেপ্ট ঢুকেছিল সে জন্য কোয়ান্টাম মেডিটেশনকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে তুলনা করা হচ্ছে, এবং এ কারণেই এই ধ্যানচর্চার নামকরণ করা হয়েছে-কোয়ান্টাম মেডিটেশন। এটা ছাড়া কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে এর কোনই সম্পর্ক নেই, অর্থাৎ অনিশ্চয়তার সূত্র বা মাল্টিভার্স থিওরি বা অন্য কোন কিছুর সাথে এর কোনই যোগযোগ নেই।
ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, বিজ্ঞানী ইউজিন উইগনারের হাত ধরেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সে “চেতনা” জিনিসটার আগমন ঘটে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই চেতনার ব্যাপারটি থেকে ইউজিন উইগনার নিজেই সরে দাঁড়ান। [Michael Esfeld, (1999), Essay Review; Wigner’s view of Physical Reality, Studies in History and Philosophy of Modern Physics, 30B, pp. 145-154, Elsevier Science Ltd.] শুধু তাই নয়, শ্রোডিঙ্গারের থট এক্সেপেরিমেন্টে ওয়েভ ফাংশন কলাপ্সে কনসাস অবজারভারের ভূমিকার প্রয়োজনই নেই এমনটা পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করা হয়েছে। দেখানো হয়েছে বাক্সে রাখা গিগার কাউন্টারই যথেষ্ট ওয়েভ ফাংশন কলাপ্স করাতে সেখানে দর্শক বা চেতনা বা মন দরকার পড়বে না। [R.H.S. Carpenter, Andrew J. Anderson; The death of Schrödinger’s cat and of consciousness-based quantum wave-function collapse; Annales de la Foundation Louis de Broglie, Volume 31, no 1. pp-45, 2006.] তাছাড়া, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আরেকটি বহুল পরিচিত ইন্টারপ্রেটেশন হচ্ছে মেনি-ওয়ার্ল্ড ইন্টারপ্রেটেশন বা মাল্টিভার্স ইন্টারপ্রেটেশন। এই ইন্টারপ্রেটেশনে ওয়েভ ফাংশন আদৌও কলাপ্স হয়না বলা হয়েছে। এই ইন্টারপ্রেটেশনের পক্ষে অনেক বিখ্যাত পদার্থবিদকেই দেখা যায়, তাদের মধ্যে আছেন স্টিফেন হকিং, ভাইনবার্গ প্রমুখ। [http://en.wikipedia.org/wiki/Many-worlds_interpretation]| আরও আছে অবজেক্টিভ কলাপ্স থিওরি, এ থিওরিতে বলা হয়েছে চেতনা নয় বরং বিড়াল নিজেই নিজেকে পর্যবেক্ষণ করছে। এর অর্থ হল বিড়াল একটা নিশ্বাস নিলো, অতিক্ষুদ্র হলেও তার ভর বাড়ল সুতরাং ওয়েভ ফাংশন কলাপ্স। নিঃশ্বাস ছাড়ল? সাথে সাথে ওয়েভ ফাংশন কলাপ্স। তাপমাত্রা পরিবর্তন হল? সাথে সাথে কলাপ্স। অর্থাৎ কোন মন বা চেতনা সম্পন্ন দর্শকের বাক্স খুলে বিড়াল দেখার আগেই ওয়েভ ফাংশন কলাপ্স হয়ে বসে আছে । [http://en.wiwkipedia.org.wiki/Objective_collapse_theories] তো আমরা দেখতে পাচ্ছি, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন যে দাবি করছে যে, চেতনাই কোয়ান্টাম থিওরির সবকিছু, আসলে ব্যাপার সেটা না। উপরন্তু এই চেতনা জিনিসটা ভৌতবিজ্ঞানের কিছু না হওয়াতে এবং একে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না দেখেই কোয়ান্টাম বিশ্বে চেতনাকে বাদ দেবার জন্য অনেক থিওরি তৈরি ও প্রমাণিত হয়। চেতনা নামের জিনিসটা ছাড়াই বেশ ভালোভাবেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সবকিছু চলছে।
** অবশ্য কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন শুধু চেতনাই না, মানুষের মনকে ইলেক্ট্রনের সাথেও তুলনা করেছে। মন কিভাবে ইলেক্ট্রনের সাথে তুলনীয় হতে পারে সেটা অবশ্য বোধগম্য নয়। তাদের কথানুযায়ী-তাছাড়া কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে, পরমাণুর ভেতরে নিউকিয়াসকে ঘিরে একটি ইলেকট্রন যখন তার কক্ষপথে ঘোরে, তখন ঘুরতে ঘুরতে আস্তে আস্তে কেন্দ্রের দিকে নামতে শুরু করে। এরই একপর্যায়ে সে একটা উচ্চতর কক্ষপথে লাফ দেয়। খুব দ্রুত ঘটা এ উচ্চস্তরে উত্তরণ বা উত্থানকে বলা হয় কোয়ান্টাম লিপ বা কোয়ান্টাম উল্লস্ফন। তেমনি একজন মানুষ যখন ধ্যান করে, আত্মনিমগ্নতার গভীরে চলে যায়, তখন তার মধ্যেও একটা উপলব্ধির স্ফূরণ ঘটে, যা তাকে আগের চেয়ে উন্নততর মানসিক ও আত্মিক স্তরে নিয়ে যায়। কোয়ান্টাম লিপের মতো তার চেতনার জগতেও একটা উল্লস্ফন হয়। কোয়ান্টাম মেথড নামকরণের এটাও একটা কারণ। [কোয়ান্টাম হাজারো প্রশ্নের জবাব-পর্ব ১।। মেডিটেশন-মহাজাতক প্রথম প্রকাশ-১৫ জুন, ২০১২। পৃষ্ঠা-১৬।]
*** ভালকথা, যে ইলেক্ট্রন উচ্চতর শক্তিস্তরে লাফ দেয়, যাকে এখানে উত্থানের সাথে তুলনা করা হয়েছে। পরের লাইনগুলোতে যে বলা হয়েছে তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে, ধ্যানেও নাকি লোকজনের এইরকম আত্মিক উত্থান ঘটে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে, ইলেক্ট্রন শুধু উচ্চ শক্তিস্তরেই লাফ দেয় না বরং নিম্ন শক্তিস্তরেও লাফ দেয়।[http://en.wiwkipedia.org.wiwki/Energy_level] ইলেক্ট্রনের উচ্চস্তরে লাফানোকে উত্থান বলা হলে, নিম্নস্তরে লাফানোকে নিশ্চয়ই পতন বলা হবে। তো সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা কি দাঁড়ায়? ধ্যানে লোকজনের আত্মিক পতনও ঘটে?
সোজা কথা, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে কোয়ান্টাম মেথডের কোন সম্পর্কই নেই। ইনফ্যাক্ট বিজ্ঞানের সাথেই এর কোন সম্পর্ক নেই। শুধুমাত্র চটকদার নাম নেবার জন্য “কোয়ান্টাম” শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন দাবি করে যাচ্ছে যে এটা নাকি বিজ্ঞান? তাই আমরা কোয়ান্টামকে বলি জীবনযাপনের বিজ্ঞান, সফল জীবনের বিজ্ঞান। [কোয়ান্টাম হাজারো প্রশ্নের জবাব-পর্ব ১।। মেডিটেশন-মহাজাতক প্রথম প্রকাশ-১৫ জুন, ২০১২। পৃষ্ঠা-১৬।]
** কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের লোগোতেও লেখা আছে- ‘Science of Living’। কিন্তু এখানে বিজ্ঞানের কোন্ ব্যাপারটা আসলো, যার কারণে একে বিজ্ঞান বলা যাবে! সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে তো বৈজ্ঞানিক উপায়ে কিছু হচ্ছে না, কোন গবেষণা হচ্ছে না। কেবল মেডিটেশন হচ্ছে। তাহলে কি বলা যাবে যে ধ্যান করাটা বিজ্ঞান? কিন্তু কেন? ধ্যানকে তো মাপজোখ করা যাচ্ছে না। কোন গাণিতিক সূত্র দিয়ে একে সংজ্ঞায়িত করা যাচ্ছে না। তবে কেন কোয়ান্টাম মেথড বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিক কিছু একটা হবে? মহাপ্রতারক মহাজাতক এভাবেই বিজ্ঞানের নামে লোক ঠকাচ্ছে।
কোয়ান্টাম মেথড ও টেলিপ্যাথি
** টেলিপ্যাথি কি? সংক্ষেপে, এ হলো কোনো রকম মাধ্যম ছাড়া দূরবর্তী কোন স্থান থেকে চিন্তার ট্রান্সমিশন। অর্থাৎ মানুষের ভেতর যে চিন্তা খেলা করছে তা আরেকজনের কাছে কোন মাধ্যম (কাগজ, বই, চিঠি, ফোন ইত্যাদি) ছাড়াই পাঠিয়ে দেয়া, যেভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার কে একজন আরেকজনের কথাকে অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়। বিভিন্ন সায়েন্স ফিকশনে এই ব্যাপারটার অস্তিত্ব থাকলেও সত্যিকারের বিজ্ঞানে কিন্তু এর কোন স্বীকৃতিই নেই। [http://en.wiwkipedia.org/wiki/Extrasensory_perception], [Gracely, Ph.D., ED J.. (1998). “Why Extraordinary Claims Demand EXtraordinary Proof”.], [a b c d The Conscious Universe : The Scientific Truth of Phychic Phenomena by Dean I. Radin Harper Edge, ISBN 0-06-251502-0], [Robert Todd Carroll. “ESP (extrasensory perception)”. Skeptic’s Dictionary!. Retrieved 2007-06-23.]
টেলিপ্যাথকে গুরুত্ব দেন মনোবিজ্ঞানীদের একটি বিশেষ দল যাদেরকে বলা হয় প্যারাসাইকোলজিস্ট। প্যারাসাইকোলজি [http://en.wiwkipedia.org/wiki/Parapsychology#Criticism_anb_contrfoversy] অনুসারে টেলিপ্যাথি হলো এক প্রকার অতীন্দ্রিয় অনুভূতি, একস্ট্রা সেনসরি পারসেপশন বা সংক্ষেপে ইএসপি [http://en.wiwkipedia.org/wiki/Extrasensory_perception]।
প্যারাসাইকোলজিস্টরা চিন্তাকে তরঙ্গ (frequency) হিসেবে দেখেন। তারা মনে করেন যে, যখনই কেউ চিন্তা করে তখন সে আসলে তরঙ্গ তৈরি করে। আর মানুষ ঐ তরঙ্গের প্রেরকযন্ত্র (ট্রান্সমিটার) ও গ্রাহকযন্ত্র (রিসিভার) হিসেবে কাজ করতে সক্ষম। কাজেই, ফ্রিকোয়েন্সি মিললে একজনের ভাবনা আর একজনের কাছে পৌঁছে যাবে। অনেকটা রেডিও, টিভি বা মোবাইল ফোনের মত। রেডিও স্টেশন থেকে আসলে বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি পাঠানো হয়, কারো হাতের রেডিওটি তখন সেই ফ্রিকোয়েন্সি রিসিভ করলে আপনি সে স্টেশনটির পাঠানোর যে কোন বার্তা শুনতে পারবে। যাই হোক, এই ধরনের চিন্তা তরঙ্গের কোনো অস্তিত্ব আজ পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। আর মানুষের মাথা যে এরকম কোন রিসিভার নয়, তার বড় প্রমাণ মানুষ নিজে। কারণ, প্রতি মুহূর্তে মানুষের চারপাশে বিস্তর তথ্য মাইক্রোওয়েভে বা রেডিওওয়েভে এদিক ওদিক যাচ্ছে। অথচ মানুষের মাথার রিসিভারের এন্টেনা এ সবের কিছুই ধরতে পারছে না।
* তবে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন দাবি করে যে এরকম টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ করা সম্ভব [কোয়ান্টাম হাজারো প্রশ্নের জবাব- পর্ব ১।। মেডিটেশন-মহাজাতক, প্রথম প্রকাশ-১৫ জুন, ২০১২। পৃষ্ঠা-১৮৯]। শুধু তাইনা তাদের মতে মানুষের ব্রেন হচ্ছে চিন্তার ট্রান্সমিটার ও রিসিভার [সাফল্যের চাবিকাঠি কোয়ান্টাম মেথড-মহাজাতক; পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণ-জানুয়ারী, ২০০০। পৃষ্ঠা-৫৭]। এর একটা অদ্ভুত ব্যাখ্যাও দেয়া হয়েছে-
* প্রতিটি মন হচ্ছে বিশ্বমন নামক এক সুপার সুপার সুপার কম্পিউটাররূপী মহাজাগতিক জ্ঞানভান্ডারের (Cosmic information super highway) এক একটি টার্মিনাল। সুপার কম্পিউটারের যতগুলো টার্মিনালই থাকুক না কেন, যে কোন টার্মিনাল থেকে ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ে বা সুপার কম্পিউটারের কেন্দ্রের সাথে যেমন যোগাযোগ করা যায়, তেমনি মন ধ্যানের স্তরে বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সি সৃষ্টি হলে বিশ্বমনরূপী মহাজাগতিক জ্ঞানভান্ডারের সাথে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত তথ্য লাভ করে। [সাফল্যের চাবিকাঠি কোয়ান্টাম মেথড- মহাজাতক; পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণ-জানুয়ারী, ২০০০। পৃষ্ঠা-২৪৫]।
** Cosmic information super highway জিনিসটা কোথায় আছে বা কিভাবে আছে তার কোন ব্যাখ্যা নেই বইটিতে। শুধু যে বইটিতে ব্যাখ্যা নেই তা না, মহাজ্ঞানী Google ও এর সঠিক কোন হদিস দিতে পারেনি। তবে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে এই ধরণের একটা কম্পিউটার রয়েছে, তারপরও আমরা বেশ সমস্যায় পড়ব। সমস্যাটা হবে এই কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে। মানুষের চিন্তার ফ্রিকোয়েন্সি কত সেটা নিয়ে কোন ব্যাখ্যা নেই বইটিতে। তবে ব্রেন ওয়েভের কথা বলা হয়েছে [সাফল্যের চাবিকাঠি কোয়ান্টাম মেথড-মহাজাতক; পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণ-জানুয়ারী, ২০০০। পৃষ্ঠা-৫৭], যা আদতে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের বিভিন্ন নিউরাল অ্যাক্টিভিটির কাজ করার ছন্দকে প্রকাশ করে [http://en.wikipedia.org/wiki/Neural_oscillations], এর সাথে চিন্তা তরঙ্গের কোন সম্পর্ক নেই। তাছাড়া ব্রেইনওয়েভের যে ফ্রিকোয়েন্সি উল্লেখ করা আছে (সর্বোচ্চ ২৭ হার্জ বা তার বেশি, সর্বনিম্ন ০.৫ হার্জ) তা দিয়ে তারছাড়া (রিৎবষবংং) যোগাযোগ একেবারেই সম্ভব না। সফলভাবে ওয়্যারলেস যোগাযোগের জন্য সর্বনিম্ন যে ফ্রিকোয়েন্সি দরকার তা হল ৩০০০০ হার্জ [http://en.wikipedia.org/wiwki/Radio_frequency]। এর চেয়ে কম হলে যোগাযোগ করা খুবই কষ্ট হয়ে পড়বে। যার কারণে এর চেয়ে নিচে কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে যোগাযোগ করার কোন চেষ্টা করা হয় না। তাছাড়া যখন যোগাযোগের জন্য কোন সিগনাল পাঠানো হয়। তখন সেটাকে মডুলেশন নামে একটা পদ্ধতির মাধ্যমে পাঠানো হয়। মানুষের গলার স্বরের ফ্রিকোয়েন্সি মোটামুটি ৪০০০ হার্জ। এটা খুব দুর্বল ফ্রিকোয়েন্সি বিধায় একে একটা শক্তিশালী ফ্রিকোয়েন্সির উপর চাপিয়ে পাঠানো হয়। এই পদ্ধতিটির নামই হচ্ছে মডুলেশন। মোবাইল ফোন বা রেডিও-সব কিছুই এই পদ্ধতিটি মেনে চলে। যে কারণে আমাদের খালি গলার আওয়াজ খুব অল্প দূরত্ব পর্যন্ত শোনা গেলেও, রেডিও বা ফোনে সেটাকে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া বা তার চেয়েও দূরত্বে শোনা যায়। মডুলেশনের কয়েকটি বহুলব্যবহৃত ভাগের নাম অবশ্য সবারই জানা-অ্যাম্পিøচিউড মডুলেশন (এএম) ও ফ্রিকোয়েন্সি মডুলেশন (এফএম)। এএম রেডিও বা এফএম রেডিওতে এসব মডুলেশন ব্যবহার করা হয়। তাই এর চেয়ে কম ফ্রিকোয়ন্সিতে কেউ কোন মাধ্যম ছাড়া যোগাযোগ করছে, তাও আবার মডুলেশন পদ্ধতি ছাড়া-এই অযৌক্তিক ব্যাপারটা বিজ্ঞান কখনোই মেনে নিতে পারে না।
অবশ্য বইটিতে টেলিফ্যাথির সফল প্রয়োগের একটা উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে-
* অ্যাপোলো-১৪-এর নভোচারী এডগার মিচেল চন্দ্র পৃষ্ঠ থেকে ভূ-নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে হিউস্টনের সাথে টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ স্থাপন করেন। এই যোগাযোগ এত সফল হয়েছিল যে, নভোচারী মিচেল ভূপৃষ্ঠে ফিরে এসে গড়ে তোলেন এক নতুন প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউট অব নিইটিক সাইন্সেস। [সাফল্যের চাবিকাঠি কোয়ান্টাম মেথড- মহাজাতক; পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণ-জানুয়ারী, ২০০০। পৃষ্ঠা-২৪৫]।
** এডগার মিচেলের এই কাহিনী যে ধাপ্পা সেটা বৈজ্ঞানিকভাবে বহু আগেই প্রমাণিত হয়ে গেছে [http://www.skepdic.com/edgarmitchell.html]। অথচ এই ধাপ্পা কাহিনীটিকেই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন টেলিপ্যাথির প্রমাণিত উদাহরণ হিসেবে দেখাচ্ছে। সত্যিকারের বিজ্ঞানের কাছে টেলিপ্যাথি হচ্ছে অপবিজ্ঞান।
চুম্বক পানি
** চুম্বক এবং পানি- দুটোকেই আলাদাভাবে বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে পারলেও, চুম্বকায়িত পানির কোন বৈজ্ঞানিক অস্তিত্ব নেই। তবে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে এই অবৈজ্ঞানিক জিনিসটার বেশ কদর আছে। কদরের উদাহরণ-
* পানীয়ের রাজা চুম্বক পানি। নিয়মিত চুম্বক পানি পানে হজম শক্তি ও ক্ষুধা বাড়ে, এসিডিটি হ্রাস পায়, আলসার ও মূত্রাশয়ের ব্যাধি নিরাময় হয়, গলব্লাডার ও কিডনিতে পাথরসহ দেহে অপ্রয়োজনীয় কোনো কিছু জমাট বাঁধতে পারে না। [আলোকিত জীবনের হাজার সূত্র কোয়ান্টাম কণিকা-মহাজাতক, পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণ-১৯ জানুয়ারি ২০১১। পৃষ্ঠা-৪৬]।
** প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক যে কেন চুম্বকায়িত পানির কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই? তার আগে দেখা যাক যে চুম্বক নিয়ে বিজ্ঞান কি বলে। বিজ্ঞান বলে যে চুম্বকের চুম্বকত্বের কারণে চুম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। এই চুম্বক ক্ষেত্র অদৃশ্য কিন্তু এর মাধ্যমেই চুম্বকের প্রায় সব ধর্ম প্রকাশ পায়; এটা একটি বল যা তার চারপাশের ফেরোচৌম্বক পদার্থকে আকর্ষণ করে এবং অন্য চুম্বককে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করে। চুম্বককে আকর্ষণ করতে হলে অন্য পদার্থকে অবশ্যই ফেরোচৌম্বক (Ferromagnetic) হতে হবে [http://en.wikipedia.org/wiki/Magnet]। লোহা ফেরোচৌম্বক হলেও পানিকে নিয়ে হচ্ছে সমস্যা। এটি মোটেও ফেরোচৌম্বক নয়, যার কারণে চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ করতে পারলেও পানিকে পারে না। ফেরোচৌম্বক পদার্থে ছোট ছোট ম্যাগনেটিক ডোমেইন থাকে। এসব ডোমেইন বিভিন্নদিকে মুখ করে থাকে। বিভিন্ন দিকে মুখ করে রাখার কারণে এতে চৌম্বকত্ত্ব থাকে না। কিন্তু ফেরোচৌম্বক পদার্থটিকে কোন চৌম্বক ক্ষেত্রে রাখলে ম্যাগনেটিক ডোমেইনগুলো উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু বরাবর একইদিকে মুখ করে থাকে। ফলে পদার্থটি তখন চৌম্বকত্ত্ব দেখায় [http://en.wikipedia.org/wiki/Ferromagnetism]। কিন্তু পানি ডায়াচৌম্বক (উরধসধমহবঃরপ) পদার্থ হবার কারণে চৌম্বকত্বের এই ধর্ম দেখায় না। শুধু তাইনা, পানির ম্যাগনেটিক সাসেপ্টিবিলিটি খুবই নগন্য, প্রায় নেগেঠিভ ০.৯১। যার ফলে বলা যায় যে এর মাঝে কোন চৌম্বকত্ব নেই। যতটুকু আছে সেটা একেবারেই না থাকার সমান। [http://en.wikipedia.org/wiki/Diamagnetic]
** অবশ্য কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ভাষ্যমতে চুম্বকপানির পুরো প্রসেসটি বেশ সোজা, শুধু চুম্বকপানি ভর্তি বোতলে সাধারণ পানি রিফিল করলেই নতুন পানি চুম্বকপানি হয়ে যাবে-
* এক বোতল চুম্বক পানি থেকে এক গ্লাস খেয়ে স্বাভাবিক এক গ্লাস পানি পুনরায় বোতলে ঢেলে রাখুন। চুম্বক পানির স্পর্শে নতুন পানিও চুম্বকায়িত হবে। এভাবে ৬ মাস অনায়াসে চালাতে পারবেন। [আলোকিত জীবনের হাজার সূত্র কোয়ান্টাম কণিকা-মহাজাতক; পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণ-১৯ জানুয়ারি ২০১১। পৃষ্ঠা-৫৮] ** যেখানে বোতলে প্রথমবার রাখা পানির নিজেরই চৌম্বকত্ব নেই, সেখানে সে কিভাবে পরেরবার যোগ করা পানিকে চৌম্বক করে ফেলবে? আরো বড় কথা হল যে, বিজ্ঞান থেকেই প্রমাণ হয় যে চুম্বক দিয়ে পানির কোন গুণাগুণই পাল্টাচ্ছেনা, তাহলে চুম্বক পানি আর সাধারণ পানির মধ্যে পার্থক্য কি থাকল? আসলেই কোন পার্থক্য নেই। চুম্বকপানির নামে আসলে যা রয়েছে তা একদম সাধারণ পানি। মানুষের বিশ্বাস ও অজ্ঞতাকে পুঁজি করে চুম্বকপানির নামে সাধারণ পানি চালিয়ে দেবার এইসব ব্যাপার বেশ পুরনো [http://www.chem1.com/CQ/magscams.html] ।
*** তো সায়েন্স অফ লিভিং বা জীবন যাপনের বিজ্ঞান নিয়ে যে মহাচিটার মহাজাতক-এর কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন কাজ করার কথা বলছে, তারা আসলে বিজ্ঞানের কোন কিছুই অনুসরণ করছে না। কোয়ান্টাম, কসমিক, সুপারহাইওয়ে, টেলিপ্যাথি, চুম্বক-পানি ইত্যাদি কিছু সায়েন্স ও সায়েন্স-ফিকশন টার্ম টেনে নিয়ে এসে অবৈজ্ঞানিক কোন কিছুকে বৈজ্ঞানিক বলে দাবি করার প্রয়াস অনেক পুরনো। সেজন্যই বলছিলাম যে বাংলাদেশে ‘বৈজ্ঞানিক’ বেশ জনপ্রিয় একটি শব্দ। লোকজন বিজ্ঞান বুঝুক আর না বুঝুক, বিজ্ঞানের প্রতি তাদের চরম শ্রদ্ধা রয়েছে। তারা মনে করে কোন কিছুতে ‘বিজ্ঞান’ শব্দটি থাকলে সেখানে ভুল কোন কিছুই থাকতেই পারে না। তাই চরম অবৈজ্ঞানিক ব্যাপারেও ‘বৈজ্ঞানিক’ বা ‘বিজ্ঞান’ শব্দ বসিয়ে নিলে লোকজন তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। যার কারণে বিজ্ঞানের ধারে কাছে না ঘেঁষে অপবিজ্ঞানকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা কোয়ান্টাম মেথডকে লোকজন বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিনিয়ত ভুল করে যাচ্ছে। আর মহাপ্রতারক মহাজাতকও অর্থ-বিত্ত-বৈভব, এর মালিক হচ্ছে সরলমতি মানুষদেরকে ঠকিয়ে।