রাজধানীর পান্থপথের ফ্ল্যাট ছিল শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়নের ঠিকানা। শ্বশুরের কাছ থেকে উপহার পাওয়া এ ফ্ল্যাটে ছলে-বলে-কৌশলে শিক্ষার্থীদের ঘৃণিত এ কাজে বাধ্য করে আসছিলেন আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহফুজুর রশিদ ফেরদৌস।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর এবং ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক বিভাগের সহযোগী এ অধ্যাপকের বিরুদ্ধে বেশ কছর ধরে মৌখিক ও লিখিত অভিযোগ করে আসছিলেন নিপীড়নের শিকার শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকের দাপটে সব মিলিয়ে যাচ্ছিল। নিপীড়নের শিকার ছাত্রীদের বেদনা অব্যক্তই থেকে যায়। তবে শেষ রক্ষা হল না দাপুটে শিক্ষক মাহফুজুর রশিদ ফেরদৌসের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবার নিয়ে হলি ফ্যামিল রেড ক্রিসেন্ট এলাকার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন যৌন হয়রানির দায়ে অভিযুক্ত মাহফুজ। আরেকটি ফ্ল্যাট রাজধানীর পান্থপথ আবাসিক এলাকায়। প্যরাডাইস সুইটসের পাশে শ্বশুরের কাছ থেকে উপহার পাওয়া ওই ফ্ল্যাটে শিক্ষার্থীদের ব্ল্যাকমেইল করে এনে জোরপূর্বক যৌন হয়রানি করে আসছিলেন।
মাহফুজের ব্ল্যাকমেইল করার পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পড়া বোঝানোর নামে শিক্ষার্থীদের ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতেন। দ্বিমত করলে শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়া হত। ফলাফল সেমিস্টার ড্রপ আউট।
প্রাথমিক এ প্রস্তাবে শিক্ষার্থী সায় না দিলে অর্থাৎ পান্থপথের ফ্ল্যাটে যেতে অস্বীকৃতি জানালে বশে আনতে শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন মাহফুজুর রশিদ ফেরদৌস। চেষ্টা করতেন শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের ম্যানেজ করতে।
ভুক্তভোগীরা জানান, বাসায় ফোন দিয়ে বলতেন, আপনার মেয়ে তো পড়াশোনা কিছু পারে না। পরীক্ষায় পাশও করতে পারবে না। খাখামা টাকা-পয়সা নষ্ট করছেন। দেখি ছেলেদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়।
স্বাভাবিকভাবেই এ কথা শুনে শিক্ষকের সহযোহিতা চাইতেন অভিভাবক। তখন তিনি (শিক্ষক) বলতেন, ক্লাসের পরে আমার ফ্ল্যাটে আসতে বলবেন। আমি পড়া বুঝিয়ে দেব। পরিবারগুলোকে এমনভাবে ম্যানেজ করতেন যেন শিক্ষার্থী ওই ফ্ল্যাটে যেতে না চাইলেও তাকে জোর করে পাঠানো হয়।
এভাবে পরিবারকে ম্যানেজ করে শিক্ষার্থীকে তার পরিবার থেকে আলাদা করতেন। শিক্ষার্থীরা পরিবারকে বোঝাতে সক্ষম হননি যে, মাহফুজুর রশিদ শিক্ষক নন, তিনি লম্পট।
ব্ল্যাকমেইলের পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা আরো জানান, ফ্ল্যাটে ডেকে কৌশলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে তিনি (শিক্ষক) তার অফিসিয়াল নম্বরে আজেবাজে ম্যাসেজ পাঠিয়ে রাখতেন, যা দিয়ে পরবর্তীতে তাদের ফাঁদে ফেলতেন।
ছাত্রীদের ইনবক্সে পাঠানো অশ্লীল বার্তা ও ছবি
এসব কৌশল অবলম্বন করে মাহফুজুর রশিদ শিক্ষার্থীদের বাধ্য করতেন পান্থপথের ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতে। সেখানে নিয়ে যৌন নিপিড়ন এবং শারীরিক নির্যাতন করতেন। এ কৌশলে অসংখ্য ছাত্রীর সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছেন লম্পট ওই শিক্ষক। যার স্বাক্ষী পান্থপথের সেই ফ্ল্যাট।
কথা না শুনলে ভার্সিটিতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর চরিত্র নিয়ে কুৎসা রটানোর হুমকিও দেয়া হতো।
তাদের দেয়া তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে বহুবার লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। জোরপূর্বক অভিযোগ তুলে নিতে বাধ্য করা এবং নিজেদের মধ্যে সমাধান করে নেয়ার জন্য চাপ দিতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
পরিবারকে হারিয়েছেন আগেই, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়কে, সেমিস্টার ড্রপের ভয়াবহতা, শিক্ষার্থীদের মোবাইল থেকে তার মোবাইলে পাঠিয়ে রাখা আজেবাজে ম্যাসেজ, ভার্সিটিতে সহপাঠীদের কাছে নিজের সম্মান হারানোর ভয়— এসব কারণে মাহবুব রশিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খোলার সাহস পাননি ভুক্তভোগীরা। দিশেহারা হয়ে অনেকে সুইসাইডের চেষ্টা করেছেন বলেও জানিয়েছেন যৌন হয়রানির শিকার শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের মোবাইলে নিজের ন্যুড পিক পাঠানো ছিল ওই শিক্ষকের কাছে অতি সহজ একটা ব্যাপার। আজেবাজে টেক্সটিং, যা হরহামেশাই পাঠানো হত।
অবশেষে সব ভয়, লজ্জা ভেঙে সতীর্থদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিবাদ গড়ে তোলেন ভুক্তভোগীরা। সবাই একসঙ্গে গত শনিবার থামিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম। শুরু হয় আন্দোলন। তীব্র আন্দোলনের তোপে মুখ খুলতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। ক্যাম্পাসের চৌহদ্দিতে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করা হয় মাহফুজকে। অভিযোগ পাঠানো হয়, হাইকোর্ট কর্তৃক যৌন নির্যাতন ও যৌন হয়রানি বন্ধে গঠিত কমিটিতে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অভিযুক্ত শিক্ষকের সাময়িক বরখাস্তের শাস্তিকে প্রত্যাখ্যান করে চার দফা দাবি মেনে নিতে বিকেল ৩টা পর্যন্ত আলটিমেটাম দেন কর্তৃপক্ষকে। বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে দাবি না মানায় পরবর্তী কর্মসূচি অনুযায়ী সোমবারও ক্লাস বর্জন করে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা।