বগুড়ার মহাস্থান সবজির হাট। ২৫ ডিসেম্বর বেলা একটা। দুই মণ ফুলকপি নিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন রনি ইসলাম। মুরাদপুর গ্রামের তরুণ কৃষক রনি।
কী চিন্তা করছেন, জানতে চাইতেই রনি উঠে দাঁড়ান। হতাশ কণ্ঠে জানালেন, এবারের মৌসুমে এক বিঘার বেশি জমিতে
ফুলকপির চাষ করেছিলেন। ফলনও ভালোই হয়েছে। কিন্তু পাইকাররা আজ দামই হাঁকছেন না। একজন ১২০ টাকা মণ দরের কথা বলে আধা ঘণ্টা আগে চলে গেছেন। রনি বলেন, ‘ওই ক্রেতা ফিরে আসবেন কি না বসে বসে সেই চিন্তাই করছি।’
এইটুকু কথা বলতেই ভিড় জমে যায়। সাংবাদিক বুঝতে পেরে বাদিয়াছড়া গ্রামের মাঝবয়সী কৃষক জমশেদ আলী তুলে ধরেন ফুলকপি চাষের খরচের কথা। বলেন, এক বিঘায় চারা কিনতে খরচ ৫ হাজার টাকা। ট্রাক্টর খরচ ২ হাজার টাকা, আর সার-সেচ, নিড়ানি খরচ ১২ হাজার টাকা। বিঘায় ফুলকপি হয় ৬০-৭০ মণ।
জমশেদ আলীর কথা অনুযায়ী বিঘায় ৬০ মণ এবং প্রতি মণে ৪০টি করে ফুলকপি ধরলে প্রতিটির দাম পড়ে ৮ টাকা ৩৩ পয়সা। এর মধ্যে অবশ্য জমশেদ আলীর নিজের খাটুনির খরচ বাদ। অথচ কষ্টে ফলানো সেই ফুলকপি তিনি ৩ টাকাতেও বিক্রি করতে পারছেন না।
আজকে না হয় দাম কম, কয়েক দিন আগে তো বেশি দামেই বিক্রি করেছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে জমশেদ আলী বলেন, ‘ঢাকায় যখন একটি ফুলকপির দাম ৫০ টাকা, তখনো আমরা ১২ টাকার বেশি দর পাইনি।’
ভাগকোলা গ্রামের ৬০ বছর বয়সী কৃষক সোলায়মান আলী বলেন, ‘খেতত থ্যাকে ফুলকপি তুলে হাটত লিয়ে আসনো, এক দিন আগেও বেচনো ৩৫০-৪০০ ট্যাকা মণ। আজক্যা বেকুব মনে গেচি। আজক্যা বেচিচ্চি ১২০ ট্যাকা মণ।’
কথা হয় আলুচাষিদের সঙ্গে। নতুন আলুর বিশাল স্তূপ নিয়ে বসে আছেন ছকিমউদ্দিন। আজকের বাজার কী—জিজ্ঞাসা করতেই জানালেন, দেশি লাল আলু ৪৫০-৫৫০ টাকা মণ। আর সাদা আলুর মণ ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা।
অর্জুনপুর গ্রামের কৃষক জাহিদুল ইসলাম জানান, গত শনিবার তিনি ৭০০ টাকা মণ দরে লাল আলু বিক্রি করেছেন। এক দিনে কমে গেছে মণে ১৫০ টাকা। আর প্রতি বিঘায় আলু চাষে খরচ তাঁর ১০ হাজার টাকা।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মুলাচাষিদের। দক্ষিণভাগ গ্রামের আবদুল আজিজ জানান, ৪০ টাকা মণেও তিনি মুলা বিক্রি করতে পারছেন না। অথচ জমি থেকে তোলার পর প্রতি মণে মুলা ধোয়ার খরচই দিতে হয় ৪০ টাকা, আর পরিবহন খরচ ২৫ টাকা।
এ ছাড়া বেগুন ৩০০ টাকা, সিম ৬০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
পাইকাররা সিন্ডিকেট করে বাজারের এই পরিস্থিতি করেছেন বলে অভিযোগ সৈয়দ দামগাড়া গ্রামের কৃষক ছকিমউদ্দিনের। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের সমিতি আছে, পরিবহন মালিকদের সমিতি আছে, নেই শুধু কৃষকদের। ধান আবাদ করে দাম পাই না। সবজিতেও একই অবস্থা। এখন চাষাবাদ বাদ দিলে খাব কী?
কৃষকেরা জানান, দাম কমানোর জন্য পাইকাররা সব সময়ই অজুহাত দাঁড় করান। কখনো বলেন, জ্যামের কারণে সবজি বগুড়ার বাইরে যেতে পারছে না। কখনো বলেন ব্যাংক তিন দিন বন্ধ। এবার বলছেন পোশাক কারখানা বন্ধ, তাই সবজির দাম কম।
কৃষক ও পাইকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহাস্থান বাজারে সবজি আসে বগুড়ার সব উপজেলার পাশাপশি জয়পুরহাট, গাইবান্ধা ও নওগাঁ থেকে। আর দিনে ৫০টি ট্রাকে করে এসব সবজি যায় চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেট, নরসিংদী ও কিশোরগঞ্জে। এ বাজারে ছোট-বড় আড়ত আছে ১০০টি।
কৃষকদের তোলা সিন্ডিকেটের কথা একেবারে অস্বীকার করেননি মহাস্থান কাঁচা ও পাকামাল আড়ত ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম। নিজের আড়তে বসে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, একশ্রেণির ফড়িয়ার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আছে, তবে আড়তদারদের বিরুদ্ধে নয়। আড়তদারেরা শুধু কমিশনভোগী।
পরিবহন ব্যবসায়ীরা জানান, বগুড়া থেকে চট্টগ্রামে সবজি পাঠানোর খরচ পড়ে প্রতি কেজিতে ৩ টাকা। আর ঢাকায় পাঠানোর খরচ ২ টাকা। প্রতি ট্রাকে সবজি পাঠানো হয় ১৫ টন (১৫ হাজার কেজি)। ট্রাকভাড়া ২০ হাজার টাকা।
শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায় সবজি পাঠালেও প্রতি কেজিতে ৪ টাকার বেশি পরিবহন খরচ পড়বে না।’
ঢাকায় সবজির দাম
ঢাকায় নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, রাজধানীর বাজারেও আগের তুলনায় সবজির দাম কমেছে। তবে এখনো বগুড়ার তুলনায় ঢাকায় ফুলকপি, আলু, শিমসহ সবজির দাম বহুগুণ বেশি। গতকাল ঢাকার কারওয়ান বাজারে আকারভেদে প্রতিটি ফুলকপি ২০ থেকে ৩০ টাকা, নতুন আলু কেজিপ্রতি ২৫ টাকা, মুলা কেজিপ্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকা, শিম জাতভেদে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, গোল বেগুন ৪০ থেকে ৫০ টাকা ও লম্বা বেগুন ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন বিক্রেতারা। রাজধানীর কাজীপাড়া বাজারে গতকাল ফুলকপি প্রতিটি ২৫-৪০ টাকা, নতুন আলু ৩০ টাকা, মুলা ২৫ টাকা, শিম মানভেদে ৩০-৪০ টাকা ও বেগুন ৪০-৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
কারওয়ান বাজারে ট্রাক থেকে সবজি কিনে তা আড়তে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করেন মো. শাহাব উদ্দিন। জানতে চাইলে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি গতকাল প্রতিটি ৭ টাকা দরে বেশ কিছু ফুলকপি কিনেছেন। দিনভর তা আকার ও মানভেদে ৪ থেকে ১৫ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। আর আড়ত থেকে এই ফুলকপি খুচরা বাজারে গিয়ে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কেএএস মুরশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘উৎপাদন পর্যায়ে কৃষক দাম পাচ্ছে না, অন্যদিকে ঢাকার ক্রেতাদের চড়া দাম দিতে হচ্ছে—এ কথা আমরা অনেক দিন ধরেই শুনছি। এ বিষয়ে আসলে বিস্তারিত কোনো গবেষণা হয়নি। কেন এমন হচ্ছে তা জানতে একটি গভীর গবেষণা দরকার।’
সংবাদ : প্রথম আলো