বিশ্বব্যাপী খাবারের দাম বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ভোক্তারা এক বছর আগের তুলনায় মুদি খাবার, ফাস্ট ফুড এবং রেস্টুরেন্টের খাবারের জন্য প্রায় ৬.৫% বেশি অর্থ প্রদান করছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের খামার মালিকরা দাবী করছে যে, তেল এবং সারের দামের বৃদ্ধি সত্ত্বেও তারা পণ্যের দাম বেশি পাচ্ছে না। এবং তারা খামার চালিয়ে নিতে সমস্যায় পড়ছেন। কৃষিতে মোটা অংকের ভর্তুকি থাকা সত্ত্বেও উন্নত দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের যখন এই অবস্থা, তখন বাংলাদেশের কথা বলাই বাহুল্য। দ্রব্যমূল্য, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারের ওপর চাপ বৃদ্ধি পায়। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ‘কারণ’ যাই হোক না কেন জনগণ চায় খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি না পাক। অপরদিকে কৃষিপ্রধান এবং গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের জন্য কৃষি শ্রমিক এবং বর্গা চাষীদের ভাগ্য জড়িয়ে আছে কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির ওপর। সেদিক থেকে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের সরকার থাকে উভয় সংকটে। কৃষকের কথা চিন্তা করে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করতে গেলে অকৃষি শ্রমিকদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়, পাশাপাশি অকৃষি শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষের ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে সরকারের ওপর তৈরি হয় রাজনৈতিক চাপ। যদিও অকৃষি শ্রমিকদের জীবনমান শুধুমাত্র মৌলিক খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে না, তথাপি তাদের প্রান্তিক জীবনযাপনে বাধ্য করা কর্পোরেট সমাজ এবং তাদের পরিচালিত গণমাধ্যম বুঝাতে চায় যে, সাধারণ মানুষের জীবনমান মৌলিক খাদ্যপণ্যের দাম কমিয়ে রাখার ওপর নির্ভরশীল। যদিও মানুষ এখন মৌলিক খাদ্য পণ্যের পিছনে ব্যয় করছে তার উপার্জনের ছোট্ট একটি অংশ, বিশেষ করে উন্নত দেশের মানুষ। ২০২০ সালে মার্কিন ভোক্তারা তাদের নিষ্পত্তিযোগ্য ব্যক্তিগত আয়ের গড়ে ৮.৬ শতাংশ খাবারের জন্য ব্যয় করেছে – বাড়িতে খাবার (৫.0 শতাংশ) এবং বাড়ির বাইরের খাবার (৩.৬ শতাংশ) এর মধ্যে বিভক্ত। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়- যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬০ সালের পর থেকে খাবারের পিছনে মানুষের ব্যয় করার হার ক্রমান্বয়ে কমেছে।
বাংলাদেশে এ জাতীয় কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এখনও যে বাংলাদেশের অনেক মানুষের ব্যয়ের প্রধানতম খাত খাদ্য একথা নিশ্চিত করে বলা যায়। একটি রিসার্স পেপারের তথ্য বলছে যে, সোমালিয়ার মতো দরিদ্র দেশগুলো গড়ে তাদের উপার্জনের ৫০% ব্যয় করে খাদ্যের পিছনে, যদিও প্রায়ই তারা যথেষ্ট পরিমাণ সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না বলে অপুষ্টিতে ভোগে। বিশ্বব্যাংকের ডাটাও একই মতামত দেয়। একইসাথে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে খাদ্যের দাম থাকে উন্নত দেশের তুলনায় বেশি, যদিও এসব দেশের কৃষকেরা খুব কমই খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্যের সুবিধা ভোগ করতে পারে। দ্রুত জনসংখ্যাবৃদ্ধি, নগরায়ন, অপরিকল্পিত এবং চাপিয়ে দেওয়া পরিবহন ব্যয় এ মূল্যবৃদ্ধির জন্য প্রধানত দায়ী। অপরদিকে কৃষকদের জন্য সরকারি ভর্তুকি না থাকায় এবং খামারভিত্তিক আধুনিক এবং সমবায়ভিত্তিক কৃষি পদ্ধতি চালু না থাকায় কৃষক বিচ্ছিন্নভাবে তার উৎপাদিত পণ্যের যে মূল্য পায় সেটি তার উৎপাদন খরচের তুলনায় সামান্য বেশি, কখনও কখনও কম। ফলে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে কৃষিপণ্যের উৎপাদনের সাথে যারা প্রধানত জড়িত, সেই গ্রামের কৃষকদের জীবনমান অত্যন্ত নিম্নমানের। উৎপাদনের বিনিময়ে তারা তাদের জীবনের জন্য বাৎসরিক ভোগ্যপণ্যের ব্যয় নির্বাহ করতে পারে না, অপরদিকে বিনোদন এবং চিকিৎসার পিছনেও তারা খুবই ন্যূনতম অর্থ ব্যয় করতে পারে। অপরদিকে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে কৃষিপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে কৃষক যেমন সে সুবিধা খুব কমই ভোগ করতে পারে, একইসাথে অকৃষি শ্রমিকদের প্রান্তিক জীবনমানও হুমকির মুখে পড়ে। ফলে এ ধরনের দেশের জন্য খাদ্যপণ্যের যোগানের ক্ষেত্রে যে সমস্যাটি রয়েছে সেটি এখনও বিশ্বব্যাপী অমীমাংসীত একটি ই্যসু।
এক সময় কৃষিই ছিল মানুষের জীবীকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম। সেখান থেকে কৃষি তথা খাদ্যপণ্যের ব্যবসা, এবং সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বহুমাত্রিক জীবনযাপন এবং জীবীকা অর্জন করেছে। সভ্যতার শুরুতে, এমনকি আমাদের দেশে মাত্র কয়েক দশক আগেও যার বেশি জমি ছিল, যার ঘরে গচ্ছিত শস্য থাকত, তাকেই ধনী বলা হত। এখন আর সেটি বলা হয় না। বর্তমানে যাদের টাকা বেশি আছে, তাদেরই ধনী মানুষ বলা হয়। এবং এই টাকা যে কোনো খাত থেকেই আসতে পারে। বরং কৃষিকাজ এখন আর ধনী হবার কোনো উপায় নয়। যতই দিন যাচ্ছে মানুষ কৃষি থেকে দূরে সরে যেতে চাইছে। কারণ, কৃষিকাজ মানসম্মত জীবন ধারণের নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। ফলস্বরূপ একটি বার্ধক্যজনিত কৃষি জনসংখ্যা এবং নতুন প্রজন্মের কৃষকদের খুঁজে বের করা একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যায় পরিণত হয়েছে। কৃষিকাজ এতটাই কম বেতনে পরিণত হয়েছে যে, উন্নয়নের সব স্তরের দেশগুলিতে তরুণরা তাদের পিতামাতার পথ অনুসরণ করে পারিবারিক খামারে যাওয়ার পরিবর্তে অন্য কাজের দিকে যাচ্ছে। কৃষিকাজের জনসংখ্যা বৃদ্ধ হচ্ছে এবং একটি বিপদ রয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত, পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদিত হবে না, কারণ এটি বাড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত কৃষিজীবী মানুষ অবশিষ্ট থাকছে না। আমি এই বিষয়ে খুব বেশি পদ্ধতিগত গবেষণার কথা জানি না, তবে কৃষিতে নতুন প্রজন্ম যে, সাড়া দিচ্ছে না সে উদাহরণ দেশে দেশে– কেনিয়া, নাইজেরিয়া, চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যের নাম অনেক গবেষকের গবেষণায় উঠে এসেছে। অনেক দেশ ভর্তুকি দিয়ে কৃষি ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছে, যেমন: দক্ষিণ কোরিয়া।
এখনও বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশে শতকরা ৭৫ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে বাংলাদেশের গ্রাম এলাকায় ৫৯.৮৪% লোকের এবং শহর এলাকায় ১০.৮১% লোকের কৃষিখামার রয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ১৯.১% এবং কৃষিখাতের মাধ্যমে ৪৮.৪% মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। এই তথ্যের আলোকে বলা যায়— কৃষি পণ্যের যৌক্তির মূল্য প্রাপ্তির ওপরই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি মানুষের জীবনমান নির্ভর করছে।
গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম ও সরবরাহে মারাত্মক ধাক্কা লেগেছে। এতে বিশেষত দরিদ্রতম দেশগুলি এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষেরা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে এটিই এখন ধরে নেওয়া হয় যে, খাদ্যের দামগুলি যে স্তরে পৌঁছেছে এখার থেকে খুব বেশি পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই৷ খাদ্যপণ্যের মূল বৃদ্ধি পাওয়ায় কিছু মানুষের জীবন যেমন কঠিন পরিস্থতিতে পড়েছে, একইসাথে যারা খাদ্য উৎপাদনের সাথে জুড়িত তাদের জীবনমান উন্নত হওয়ার কথা। সেটি কি হচ্ছে, যদি না হয়ে থাকে তবে কেন সেটি হচ্ছে না? সাম্প্রতিক মূল্য পরিবর্তনের এ ধারাকে সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে একটি প্রকৃত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া দরকার যে, বিশ্বের খাদ্য ও কৃষিপণ্যের দামের বস্তুত কীভাবে কী পরিবর্তন হয়েছে? এবং এই পরিবর্তনগুলি দ্বারা কী বোঝায়? এই প্রশ্নগুলি ব্রিটিশ থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক গ্রিন হাউসের একটি গবেষণাপত্রে পরীক্ষা করা হয়েছে, যার নাম ‘প্রাথমিক পণ্যের মূল্য এবং বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা: কেন কৃষক এখনও খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও লড়াই করে।’ অর্থাৎ খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেলেই কৃষকের জীবনমান উন্নত হচ্ছে, এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সুযোগ নেই।
আমরা এমন একটি পৃথিবীতে বসবাস করছি, যেখানে এর অর্ধেক জনসংখ্যা প্রতিদিন ২ ডলারেরও কম আয়ে বসবাস করে এবং যেখানে প্রায় ৫ বিলিয়ন মানুষ উন্নয়নশীল এবং অত্যন্ত দরিদ্র দেশে বাস করে, সেখানে খাদ্যের ঘাটতি রয়েছে এবং খাদ্যের মূল্য ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওর্গানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কোঅপারেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-এর মহাপরিচালক ২০০৮ সালে সংস্থাটির সাধারণ সভায় যে ভাষণটি দিয়েছিল সেখানে খাদ্যপণ্যের বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির পূর্বাভাস ছিল। ভাষণটিতে বলা হয়েছিল— “গড়ে আগামী দশ বছরে সিরিয়াল, চাল এবং তৈলবীজের দাম গত দশকের তুলনায় ১০% থেকে ৩৫% বেশি (বাস্তব অর্থে) হবে বলে অনুমান করা হয়েছে। জাতীয় সরকার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য একসাথে কাজ করতে হবে।” খাদ্যপণ্যের এই মূল্যবৃদ্ধির জন্য তিনি কয়েকটি কারণের কথা বলেছিলেন। তার মধ্যে খরা, খাদ্যপণ্যের মজুদ কমে যাওয়া, বায়োফুয়েল, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, উন্নয়নশীল দেশের অভ্যান্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি কারণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য। বিশ্বব্যাংকও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য বায়োফুয়েল এবং জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। বিশ্বব্যাংকের রিসার্স পেপার “এ নোট অন রাইজিং ফুড প্রাইস”-এর তথ্য বলছে, খাদ্যমূল্য বৃদ্ধিতে জৈব জ্বালানির অবদান একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সমস্যা উত্থাপন করে, যেহেতু বেশিরভাগ বৃদ্ধি ইইউ এবং মার্কিন সরকারের নীতির কারণে সংগঠিত হয়, যে দেশগুলো জৈব জ্বালানী উৎপাদনে প্রণোদনা প্রদান করে এবং জৈব জ্বালানী নীতি যা উৎপাদনে ভর্তুকি দেয় তাদের আলোকে পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। খাদ্যপণ্যের মূলবৃদ্ধি পেলে উন্নয়নশীল দেশের জন্য অবশ্য ভালো এবং খারাপ দুটি দিকই রয়েছে। খাদ্যপণ্যের মূল্য কি বিচ্ছিন্নভাবে শুধু উন্নয়নশীল দেশে বাড়ে? খাদ্যের দাম যে শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাড়ছে, তা নয়। গত কয়েক বছর ধরে উন্নত দেশেও একই চিত্র। বিশেষ করে করোনা অতিমারি পরবর্তী এবং করোনা অতিমারির এই সময়ে খাদ্যের দামের উর্দ্ধগতি অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব লেবার স্টাটিসটিকসের তথ্যমতে সে দেশে গরুর মাংসের দাম গত এক বছরে ১৬% বৃদ্ধি পেয়েছে। সে দেশের ব্যুরো অব লেবার স্টাটিকটিকস্ বলছে যে, একইভাবে মাছ এবং ডিমের দামও বেড়েছে। খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী এবং মুদি দোকানীদের বরাত দিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের তথ্য বলছে— খাদ্যপণ্যের দামের এ উর্দ্ধগতি সম্ভবত পুরো ২০২২ সাল জুড়ে চলবে।
খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির পাঁচটি কারণ
স্বল্পমেয়াদে অনেক কারণ খাদ্যের দামকে প্রভাবিত করে এবং বাজার অস্থির করে তোলে। এই কারণগুলির মধ্যে রয়েছে সরবরাহ এবং চাহিদা, আবহাওয়া, রোগের প্রাদুর্ভাব, যুদ্ধ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দীর্ঘমেয়াদে অন্তর্নিহিত কিছু শক্তি রয়েছে যা খাদ্যের দাম বাড়ায়। (বিশ্বব্যাংক, দ্যা ব্যালান্স.কম) তেলের মূল্য বৃদ্ধিখাদ্য অনেক দূরত্বে পরিবহন করা হয়, এবং উচ্চ তেলের দাম শিপিং খরচ বাড়ায়। তেলের দাম চাষেও প্রভাব ফেলে। সেচের মূল্য বাড়ে, পাশাপাশি তেলের উপজাতগুলি সারের একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। জলবায়ুর পরিবর্তনজলবায়ু পরিবর্তন চরম আবহাওয়া তৈরি করে। এর কারণ হল গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন যা তাপকে আটকে রাখে, যার ফলে বাতাসের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। গরম বাতাস বেশি আর্দ্রতা শোষণ করে। বৃষ্টি কম হয়, হ্রদ ও নদী থেকে পানি বাষ্পীভূত হয় এবং জমি শুকিয়ে যায়। যখন বৃষ্টি হয়, এটি বন্যা সৃষ্টি করে, যা ফসলের ক্ষতি করতে পারে। কৃষিতে ভর্তুকিকৃষিতে সরকারি ভর্তুকি দেওয়া না-দেওয়ার ওপর খাদ্যপণ্যের মূলবৃদ্ধি নির্ভর করে। যেসকল দেশের সরকার কৃষিতে ভর্তুকি দেয় সেসব দেশে খাদ্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখা সম্ভব হয়। পাশাপাশি কৃষিপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করাও সম্ভব হয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সীমাবদ্ধতাবিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) ভর্তুকিযুক্ত ভুট্টা এবং গমের পরিমাণ সীমিত করে যা দেশগুলি বিশ্বব্যাপী মজুদগুলিতে যোগ করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং কিছু উন্নয়নশীল দেশ তাদের কৃষি শিল্পে প্রচুর ভর্তুকি দেয়। সেসব দেশের কৃষকরা একটি অন্যায্য বাণিজ্য সুবিধা পায়। অন্যদিকে ডব্লিউটিও এক প্রান্তে মজুদ সীমিত করে। এটি খাদ্য মূল্যের অস্থিরতা বাড়ায়। বেশি মাংস খাওয়া এবং বায়োফুয়েল মানুষ ধনী হওয়ার সাথে সাথে বিশ্বজুড়ে লোকেরা বেশি পরিমাণে মাংস খাচ্ছে। মাংস-ভিত্তিক খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় পশুদের খাওয়ানোর জন্য শস্য-ভিত্তিক খাবারের চেয়ে বেশি শস্য লাগে। মাংসের উচ্চ চাহিদা মানে শস্যের দাম বেশি হওয়া। একইসাথে উন্নত বিশ্বে এখন শস্য থেকে বায়োফুয়েল তৈরি করা হচ্ছে, ফলে শস্যের যে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে সে কারণেও দাম বাড়ছে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার অন্যতম একটি প্রধান কারণ মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ব এবং চাঁদাবাজি। পথে পথে চাঁদাবাজির ফলে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়, ফলে সবজি সহ মাছ মুরগীর দাম বৃদ্ধি পায়।
প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
যদিও এখনও বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করে এবং তারা কৃষি শ্রমিক তথাপি গ্রামেরও একটি বড় জনসংখ্যার চাষাবাদ যোগ্য পর্যাপ্ত ভূমি নেই, ফলে গ্রামে থেকেও তারা কৃষি পণ্যের ক্রেতা। যে কারণে কৃষি পণ্যের দাম বাড়লে ভোক্ত হিসেবে শুধু শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ নয়, গ্রামের এমনকি কৃষি শ্রমিকরাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আগে যে উন্মুক্ত জলাশয় ছিল, তার বেশিরভাগ চাষাবাদযোগ্য জলাশয়ে পরিণত হওয়ায় বা দখল হওয়ায় গ্রামের নিম্নআয়ের মানুষ উন্মুক্ত জলাশয় থেকে যে মাছের যোগানটা পেত সেটি এখন পাচ্ছে না। ফলে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষও এখন পুরোপুরি বাজার নির্ভর হয়ে পড়েছে। এ কারণে কৃষি পণ্যের দাম বৃদ্ধি এখন আর বাংলাদেশের জন্যও কোনো সমাধান নয়, বরং কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদন বজায় রাখার সময় এসেছে। জাতীয় খাদ্য ও নিরাপত্তার খসড়া নীতি, ২০২০ এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, আগে থেকেই জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ সুষম খাবারের ঘাটতিতে রয়েছে তাই অসামঞ্জস্যগুলো দূর না করলে মানুষের খাদ্য পুষ্টির জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনায় সুফল আসার বিষয়টা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ২৩ সেপ্টেম্বর (২০২১) জাতিসংঘ ফুড সিস্টেমস সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য অধিক খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী একটি ‘স্থিতিশীল খাদ্য ব্যবস্থা’ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে ৫ দফা সুপারিশ দিয়েছেন। আর আমাদের ১৭টি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ও লক্ষমাত্রার ২ নম্বর অভীষ্ট হচ্ছে— ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষির প্রসার। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে কৃষিতে ভর্তুকি এবং বাজারে নজরদারী এবং মধ্যস্বত্তভোগীদের অবসান ঘটানোর কোনো বিকল্প নেই।
গ্রামের মানুষের একসময় নগদ উপার্জন ছিল না, এখনও গ্রামের অনেক মানুষ নগদ উপার্জন নেই। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কৃষি জমিও অনেকের নেই। এই সুযোগে শহুরে কিছু মানুষ শিল্পের স্বার্থের নাম করে স্বল্প মজুরিতে গ্রামের মানুষকে ভাগিয়ে শহরে নিয়েছে। শিকড়চ্যুত হয়ে এসব মানুষ শহরে গিয়ে পুরোপুরি বাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। কিন্তু তাদের মজুরী থেকে গেছে সামান্য। শহরের দূষিত পরিবেশ, বাড়তি খাটুনি এবং নিম্ন জীবনমান তাদের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকিও তৈরি করেছে। অপরদিকে মালিকশ্রেণি গ্রাম থেকে শ্রমশক্তি ভাগিয়ে শহরে এনে ঝুঁকিতে ফেলার নাম দিয়েছে কর্মসংস্থান। কর্সংস্থানের নাম করে তারা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধাও নেয়। আসলে কি এসব মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে? হয়নি। মৌলিক চাহিদার কোনো মানদণ্ডেই তারা ভালো নেই। তাদের নিম্নমানের বাসা ভাড়া করে থাকতে হয়, পানি থেকে শুরু করে সবকিছু তাদের কিনে খেতে হয়। বিনিময়ে তারা শহরের একটি খুপচি ঘরে বস্তিবাসী হয়েছে। বিনামূল্যের গ্রামের খোলামেলা পরিবেশটুকুও তো শহরে নেই। তাদের সন্তানেরা না পাচ্ছে শিক্ষা, না পাচ্ছে চিকিৎসা। এর ফলে গ্রামে ও শহরে দু‘দিকেই সংকট তৈরি হয়েছে। শহরে ক্রমবর্ধমানভাবে নিম্নআয়ের মানুষ বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের হাহাকার বেড়েছে, কম মূল্যে মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ বেড়েছে। এ চাপের ফলে গ্রামের কৃষক শ্রেণিও চাপে পড়ছে, কারণ, তারা তাদের ফসলের উৎপাদন মূল্যটুকুও পাচ্ছে না। কম মূল্যে বাজারে খাদ্যপণ্য নিশ্চিত করার জন্য ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ দিলে ব্যবসায়ীরা তাদের মুনাফা নিশ্চিত রাখার জন্য কৃষকের উৎপাদিত পণ্য নামমাত্র মূল্যে কিনে নিতে চাইছে। প্রয়োজন ছিল গ্রামের মানুষ কীভাবে গ্রামেই ভালো থাকতে পারে সে উদ্যোগ নেওয়া। গ্রামের অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত করা। কীভাবে স্বল্প জায়গায় সমন্বিত খামার গড়ে গ্রামের মানুষ নিজের প্রয়োজন মেটাতে পারে, এবং বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারে সে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং উদাহরণ তৈরি করা। গ্রামাঞ্চলে ছোট ছোট এবং মাঝারি বিনিয়োগ নিশ্চিত করা। বর্তমান সরকার গ্রামে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে সমর্থ হলেও ‘একটি বাড়ি একটি খামার’এর মতো উদ্যোগ সফল করতে পারেনি। গ্রামে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং বিনোদনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করে গ্রামগুলোকে বসবাসের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে পারেনি। মূলত গ্রামোন্নয়ন এবং গ্রামগুলোকে বসবাসের জন্য আকর্ষণীয় এবং উপযোগী করে তোলার মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সাফল্য।কর্পোরেট পুঁজি সবসময় গ্রামের টাকা শহরে টেনে নেয়, তার সাথে টেনে নেয় গ্রামের নিম্নআয়ের মানুষদের। এ ধারা ঠেকাতে না পারলে বাংলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে বিশাল একটি প্রায় ভাসমান শ্রমিক শ্রেণি তৈরি হবে, যারা শুধু টিসিবির ট্রাকের পিছনে দৌড়াবে তা নয়, বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডেও জড়িত হবে, হচ্ছে।