শুভ্র সিনহা রায়
আপনি রাস্তায় ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। এ বিষয়ে নিকটস্থ থানায় মামলা করতে গেছেন। কিন্তু পুলিশ আপনার মামলা নিতে চাইছে না। সে ক্ষেত্রে কী করবেন?
অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে থানা কর্তৃপক্ষ মামলা নিতে চায় না। সে ক্ষেত্রে আপনি আদালতের দ্বারস্থ হলে খুব সহজেই মামলা করে প্রতিকার পেতে পারবেন। এ ছাড়া আমলযোগ্য অপরাধ সংঘটনের পর কেউ থানায় মামলা করতে চাইলে পুলিশ বিনামূল্যে সে মামলা নিতে বাধ্য। কিন্তু বাস্তবে প্রায়ই এমন অভিযোগ শোনা যায় যে, পুলিশ থানায় মামলা নিতে চায় না।
যেভাবে মামলা করবেন : কোনো কারণে পুলিশ যদি কখনো থানায় মামলা নিতে না চায়, তাহলে সরাসরি সংশ্লিষ্ট বিচারিক হাকিমের আদালতে নালিশি অভিযোগ দায়েরের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করা যায়। আর সংঘটিত অপরাধ আমল অযোগ্য হলে সব সময়ই সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নালিশি মামলা দায়ের করতে হয়।
আমল অযোগ্য অপরাধ হলো যেসব অপরাধ সংঘটনের কারণে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে না এবং এসব অপরাধ বিষয়ে তদন্ত করতেও সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয়।
কোনটি আমলযোগ্য এবং কোনটি আমল অযোগ্য অপরাধ, তা ফৌজদারি কার্যবিধির দ্বিতীয় তফসিলের তৃতীয় কলামে বিধৃত করা রয়েছে।
ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী নালিশ মানে হলো কোনো অপরাধ সংঘটন বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার নিমিত্তে মৌখিক বা লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট বিচারিক হাকিমের কাছে আবেদন জানানো।
যদি কোনো আমল অযোগ্য অপরাধ সংঘটনের খবর কেউ সংশ্লিষ্ট থানায় নিয়ে যায়, তবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিষয়টি সাধারণ ডায়েরিতে (জিডি) লিপিবদ্ধ করে অভিযোগসহ অভিযোগকারীকে মহানগরের ক্ষেত্রে মুখ্য মহানগর হাকিম বা মহানগর হাকিম এবং মহানগরের বাইরের এলাকার ক্ষেত্রে মুখ্য বিচারিক হাকিম বা কোনো প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট অথবা বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠাবেন। এ ক্ষেত্রে থানায় না গিয়ে সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়েও লিখিত বা মৌখিকভাবে অভিযোগ জানিয়ে প্রতিকার প্রার্থনা করা যায়।
অথবা পুলিশ যদি আমলযোগ্য অপরাধ সংঘটনের পর থানায় এজাহার নিতে অস্বীকৃতি জানায়, সে ক্ষেত্রেও সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নালিশি মামলা করা যায়।
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ দায়েরের পদ্ধতি : ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মৌখিকভাবে অভিযোগ করতে চাইলে ঘটনার আদ্যোপান্ত আদালতে খুলে বলে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করতে হবে।
এর পর দায়েরকৃত অভিযোগের কোনো ভিত্তি আছে কি না, তা পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগকারীকে এবং প্রয়োজন মনে করলে ঘটনার কোনো সাক্ষী থাকলে তাঁদের শপথের মাধ্যমে পরীক্ষা করবেন। পরীক্ষার সারসংক্ষেপ লিখে তিনি নিজে, অভিযোগকারীর এবং কোনো সাক্ষী থাকলে তাঁর স্বাক্ষর নেবেন। তবে কেউ দরখাস্ত আকারে ঘটনার পূর্ণ বিবরণসহ লিখিত অভিযোগ দায়ের করে প্রতিকার দাবি করলে এ ধরনের পরীক্ষার প্রয়োজন নেই।
ম্যাজিস্ট্রেট ওই পরীক্ষায় সন্তুষ্ট হলে বা লিখিত অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগটিকে একটি সিআর কেস নম্বর (Complaint Register case number) বা সিআরপি কেস নম্বর (Complaint Register Petition case number) দিয়ে নথিভুক্ত করবেন। এ জন্য একে সিআর মামলাও বলে।
তবে শপথ পরীক্ষার সময় সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট যদি অপরাধ সংঘটন বিষয়ে অভিযোগকারীর বক্তব্যে সন্তুষ্ট না হন অথবা যদি অভিযোগকারী মামলার ভিত্তি (Prima facie) প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন, তবে ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি আমলে না নিয়ে আবেদনটি খারিজ করে দিতে পারেন।
নালিশি পিটিশনটি খারিজ হলে অভিযোগকারী খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে দায়রা জজ আদালতে বা হাইকোর্ট বিভাগে উক্তাদেশ ঘোষণার ৬০ দিনের মধ্যে রিভিশনের আবেদন করতে পারেন।
অভিযোগ আমলে নেওয়ার ফল ও তদন্তে প্রেরণ : অভিযোগটি আমলে নিলে ম্যাজিস্ট্রেট বিবাদীপক্ষের বিরুদ্ধে সমন জারি করে আদালতে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য উপস্থাপনের নির্দেশ দিতে পারেন অথবা আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে নিতে থানাকে নির্দেশ দিতে পারেন। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে আদেশপ্রাপ্ত হলে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগটি থানায় এজাহার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে মামলার জন্য প্রয়োজনীয় পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।
আবার অআমলযোগ্য অপরাধের বেলায় বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তদন্ত করতে ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে নির্দেশ দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও আদিষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অভিযোগটি বিষয়ে তদন্ত শুরু করবে এবং তদন্তকালীন আমলযোগ্য অপরাধ তদন্ত করার মতোই ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে।
অভিযোগের তদন্ত শেষে পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিলে কিংবা অভিযোগের কোনো ভিত্তি খুঁজে না পেলে পুলিশের দাখিলকৃত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী নারাজি দিতে পারেন। অর্থাৎ পুলিশ প্রতিবেদনে তিনি কেন সন্তুষ্ট নন, আদালতে সে কারণ দর্শিয়ে অভিযোগটির পুনঃতদন্তের আবেদন করতে পারেন।
তবে প্রয়োজন মনে করলে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য অথবা অধিকতর তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি নিজে বা তাঁর অধস্তন অন্য কোনো ম্যাজিস্ট্রেটকে বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারেন। অভিযোগটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরও তদন্তকাজে সম্পৃক্ত করতে পারেন।
মনে রাখা জরুরি : নালিশি মামলার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র প্রথম থেকেই পক্ষ হয়ে মামলা শুরু করে না। যেমনটা থানায় এজাহার করার মাধ্যমে মামলা দায়ের করলে রাষ্ট্র নিজে পক্ষভুক্ত হয়ে পরবর্তী সময়ে মামলা পরিচালনা করে। ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে নেওয়ার আদেশ দিলে রাষ্ট্র তখন মামলার পক্ষ হয়ে পরবর্তী সময়ে মামলা পরিচালনা করে। তাই নালিশি মামলার ক্ষেত্রে কেউ অভিযোগ দায়ের করে পরবর্তী শুনানির দিন যদি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির না হন কিংবা ঘটনার তদন্তে যদি অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত না হয়, তবে ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি খারিজ করে দিতে পারেন।
অভিযোগকারী চাইলে এ ধরনের খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে দায়রা জজ আদালতে বা হাইকোর্ট বিভাগে ৬০ দিনের মধ্যে রিভিশন আবেদন করতে পারেন। নালিশি মামলা সাধারণত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিই করতে পারেন।
লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট