কৃষ্ণকে “কানু হারামজাদা” বলায় ক্ষেপেছে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা

Anuska Sharma

অনলাইন স্ট্রিমিং সার্ভিস নেটফ্লিক্সে রিলিজ করা একটি সাম্প্রতিক মুভিতে একটি জনপ্রিয় বাংলা লোকগীতির ব্যবহার নিয়ে ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা অনেকেই মারাত্মক ক্ষেপেছেন— যার জেরে নেটফ্লিক্স বয়কট করারও ডাক উঠছে, ছবিটির প্রযোজক আনুষ্কা শর্মাকেও ভীষণভাবে ট্রোলড হতে হচ্ছে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়- ‘বুলবুল’ নামে ওই মুভিতে যে প্রাচীন বাংলা গানটি নিয়ে এই বিতর্ক, সেটি হল ”কলঙ্কিনী রাধা” – বাংলাদেশে সিলেটের কিংবদন্তী বাউল শিল্পী শাহ আবদুল করিম যে গানটিকে অসম্ভব জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।

ওই গানে হিন্দুদের ভগবান কৃষ্ণকে যেভাবে ''কানু হারামজাদা'' এবং তার লীলাসঙ্গিনী রাধাকে ''কলঙ্কিনী'' বলে বর্ণনা করা হয়েছে, সেটাকে বিশেষত উত্তর ভারতে অনেকেই হিন্দুত্বের ওপর আক্রমণ হিসেবেই দেখছেন।
Anuska Sharma
বলিউড তারকা আনুষ্কা শর্মা ইদানীং নেটফ্লিক্সে ওয়েব সিরিজ ও মুভি প্রযোজনাও করছেন
 

ওই গানে হিন্দুদের ভগবান কৃষ্ণকে যেভাবে ”কানু হারামজাদা” এবং তাঁর লীলাসঙ্গিনী রাধাকে ”কলঙ্কিনী” বলে বর্ণনা করা হয়েছে, সেটাকে বিশেষত উত্তর ভারতে অনেকেই হিন্দুত্বের ওপর আক্রমণ হিসেবেই দেখছেন।

এই আক্রমণ ও সমালোচনার মুখে নেটফ্লিক্স ওই মুভির হিন্দি সাবটাইটেলেও কৃষ্ণের বর্ণনায় ”হারামজাদা” শব্দটি পাল্টে ”নটখট” (দুষ্টু) শব্দটি ব্যবহার করেছে – তবে আনুষ্কা শর্মা নিজে বা মুভির নির্মাতা সংস্থা এই বিতর্ক নিয়ে এখনও মুখ খোলেননি।

নেটফ্লিক্সের প্ল্যাটফর্মে বুলবুল রিলিজ করেছিল গত ২৪ জুন, আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ”কলঙ্কিনী রাধা” নিয়ে শুরু হয়ে যায় তুমুল হইচই আর তর্কবিতর্ক।

ভারতের জনপ্রিয় ইউটিউবার ও ”বিগ বস – ১৩”র প্রতিযোগী হিন্দুস্তানি ভাউ টুইট করেন, “বুলবুলে যেভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও রাধাকে নোংরা ভাষায় অপমানিত করা হয়েছে, তার জন্য সরকার কি আনুষ্কা শর্মাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করবে?”

আদিত্য অখিল নামে আরও একজন টুইটার ব্যবহারকারী অভিযোগ তোলেন, বিনোদনের নামে চিরকালই বলিউড এভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজ ও তাদের দেবদেবীদের অপমান করে আসছে।

প্রথমেশ ভাই নামে আরও একজন লেখেন, “প্রথমে পাতাল লোক ও এখন বুলবুল – আনুষ্কা শর্মা এমন সব সিরিজ ও মুভিই প্রযোজনা করছেন যেগুলো হিন্দুদের ভাবাবেগকে আহত করে।”

ভগবান কৃষ্ণকে অপমান করেছে, এই ধরনের মুভির বিরুদ্ধে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে গর্জে উঠতে হবে বলেও আহ্বান জানান তিনি, ‘হ্যাশট্যাগ বয়কটবুলবুলে’র আওয়াজও সোশ্যাল মিডিয়াতে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

পীযূষ রাই নামে আর একজন জনপ্রিয় ইউটিউবার আবার নিজের চ্যানেলে প্রশ্ন তোলেন, “এই মুভিতে যেভাবে হিন্দু দেবীদের গালিগালাজ করা হয়েছে, সেটা কি বাংলায় খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা না কি? আমি ভুল করলে বাঙালিরা আমাকে শুধরে দেবেন!”

একই সঙ্গে নবী মহম্মদ বা খ্রিস্টানদের আরাধ্য যীশুকে এই ধরনের ভাষায় ডাকার ক্ষমতা ফিল্মের নির্মাতাদের আছে কি না, সে চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দেন তিনি। বলেন, “বুলবুলে যেটা করা হয়েছে তা হল সিলেক্টিভ সেকুলারিজম!”

বস্তুত ”হারামজাদা” ও ”কলঙ্কিনী” শব্দদুটির জন্য ইংরেজি ও হিন্দিতে বুলবুলে যে ধরনের সাবটাইটেল ব্যবহার করেছিল তা অনেকের কাছেই রীতিমতো আপত্তিকর ও ”হিন্দুফোবিক” ঠেকেছে।

যেমন, ইংরেজি সাবটোইটেলে কলঙ্কিনীর জায়গায় ”শেমলেস হাসি” (লজ্জাহীনা নারী) ও হারামজাদার জায়গায় ”বাস্টার্ড” (বেজন্মা) লেখা হয়েছিল।

হিন্দিতে ব্যবহার করা হয়েছিল যথাক্রমে ‘বেশরম’ ও ‘হারামজাদা’ শব্দ দুটো। পরে অবশ্য হারামজাদা পাল্টে লেখা হয়েছে ‘নটখট’ শব্দটি।

তবে কলকাতার লোকশিল্পীরা অবশ্য এই বিতর্ককে তেমন আমল দিচ্ছেন না, আর এটিকে হিন্দুত্বর বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে দেখারও কোনও প্রয়োজন নেই বলেই তাদের অভিমত।

গায়ক সাত্যকি ব্যানার্জি যেমন বিবিসিকে বলছিলেন, “এই প্রচলিত লোকগানটি বাউলরাই বেশি গেয়ে থাকেন, ফকিরদের মধ্যে এটি গাওয়ার প্রচলন কম। আর বাউলরা তো তাদের ঘরের লোক, প্রিয় রাধাকৃষ্ণকে আদর করে কত নামেই না ডাকেন।”

“বাউলদের গানে কৃষ্ণকে ননীচোর, লম্পট কত কিছুই তো বলা হয়। ‘ননীচোরা কৃষ্ণ’, ‘লম্পট বনমালী’ গানে এমন অনেক কিছুই বলার রীতি আছে, সেই ভাবের জায়গা থেকেই জিনিসটা দেখলে ভাল হয়”, বলছিলেন তিনি।

ঘুমচিঠি নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল চালান প্রতীক ব্যানার্জি, তার গবেষণা আবার বলছে বাউল শাহ আবদুল করিম বা তার পূর্বসূরী রাধারমণ মিত্র – মূল গানটি তাদের কারওরই লেখা নয়।

বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, “যতদূর জানতে পারছি এই গানটির উৎস আসামের কামরূপ অঞ্চলে। পরে অবশ্য আবদুল করিমের মতো অনেক শিল্পীই গানটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন, কিন্তু এটির বাণী আসলে আরও অনেক পুরনো।”

“এই গানে হারামজাদা বা কলঙ্কিনী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে বলেই যারা হিন্দুত্ব গেল গেল রব তুলছেন, তাদের উদ্দেশে বলব আপনারা আসলে বাঙালিয়ানা বা বাংলা লোকসংস্কৃতির কিছুই বোঝেন না!”

“এটা অনেকটা চিলে কান নিয়ে গেল শুনেই কান ফিরিয়ে আনতে দৌড় লাগানোর মতো ব্যাপার”, বলছিলেন প্রতীক ব্যানার্জি।

পশ্চিমবঙ্গে এই বিতর্ক তেমন আলোড়ন ফেলতে না-পারলেও উত্তর ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ”হারামজাদা” বলে ডাকার ঘটনায় রীতিমতো ছিঁ ছিঁ পড়ে গেছে।

এরই মধ্যে তেলুগু ভাষায় নেটফ্লিক্সের আর একটি রিলিজ ‘কৃষ্ণ অ্যান্ড হিজ লীলা’ (কৃষ্ণ ও তার লীলা) নেটফ্লিক্সের জন্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে – ওই প্ল্যাটফর্ম বয়কট করার দাবি ভারতে ক্রমশ আরও জোরালো হচ্ছে!