গণমাধ্যমে কোন খবর কীভাবে প্রকাশ করা হবে, কী ছবি বা ভিডিও যাবে সেই প্রতিবেদনের সাথে – এ নিয়ে পশ্চিমাবিশ্ব সতর্ক৷ জটিলতা রয়েছে বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশে৷ দেখা যাক গণমাধ্যমে সংবাদ উপস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু ভুল এবং অসঙ্গতি৷
মানবিকতা না পেশাদারিত্ব?
সুদানে মৃতপ্রায় একটি শিশু মাঠে পড়ে রয়েছে আর তার ঠিক কয়েক হাত দূরেই একটি শকুন তাকিয়ে রয়েছে –১৯৯৩ সালে বিশ্ব তোলপাড় করা এই ছবিটি তুলেছিলেন বিখ্যাত ফোটো জার্নালিস্ট কেভিন কার্টার৷ পুলিত্জার পুরস্কারও পেয়েছিল ছবিটি৷ কিন্তু প্রশ্ন উঠেছিল শিশুটির মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা না করে তিনি কি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারতেন না? আর এ কারণেই হয়ত আত্মহত্যা করেছিলেন কেভিন৷
ধর্ষিতার ছবি ও পরিচয় প্রকাশ নয়
সংবাদ নীতিমালা বলে, ধর্ষিতা বা যৌন নিপীড়নের শিকারের নাম প্রকাশ করা যাবে না৷ কিন্তু অনেকক্ষেত্রে গণমাধ্যম ধর্ষিতার এলাকার নাম বা তাঁর কোনো আত্মীয়ের পরিচয় প্রকাশ করে৷ এ যুগেও সাংবাদিকতার এমন ভুল সত্যিই মর্মান্তিক৷
অপরাধীর অপরাধ প্রমাণের আগে ছবি প্রকাশ নয়
সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুযায়ী, অপরাধ করেছে সন্দেহে পুলিশ ধরার পরই তার ছবি সাংবাদিকরা প্রকাশ করতে পারেন না, কেননা, অপরাধ তো তখনো প্রমাণিত হয়নি৷ কিন্তু বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশে অপরাধীর অপরাধ প্রমাণের আগেই ছবি প্রকাশ করার ঘটনা ঘটে৷
উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দেশের একটি প্রধান দৈনিক হিন্দু নারীদের ছবি প্রকাশ করে, যারা ভোট কেন্দ্রে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন৷ ক্যাপশনে যে স্থানের উল্লেখ ছিল, ছবিটি সেই স্থানের ছিল না৷ ফটোশপের সহায়তায় কিছু পরিবর্তনও আনা হয়েছিল ছবিটিতে৷ ছবিটি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছিল তখন৷
একতরফা বক্তব্য নয়
বড় বড় ইস্যুতে ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো এক তরফা বক্তব্য প্রচার করে৷ কিন্তু সাংবাদিকতার প্রথম নীতিই হলো নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন৷ অর্থাৎ কোনো ঘটনায় উভয় পক্ষের বক্তব্য থাকতে হবে৷ না হলে জন্ম নেবে বিতর্কের৷
উদ্ধার কাজে সমস্যা বা আহতদের প্রশ্ন
দুর্ঘটনা স্থলে অতিরিক্ত সাংবাদিকের উপস্থিতি কাজে বাধার সৃষ্টি করে৷ একইভাবে দুর্ঘটনাগ্রস্ত মানুষ বা নিহতদের স্বজনদের ঘটনা ঘটার মুহূর্তে প্রশ্ন করাটা একেবারেই অমানবিক৷ এতে নৈতিকতার চেয়েও মানবিকতার প্রশ্ন এসে যায়৷ বিশ্বের অনেক দেশের সাংবাদিকরা এমন পরিস্থিতিতে ঐ আহত বা নিহতদের স্বজনদের স্বার্থ রক্ষা করে কাজ করেন৷
ভুল ছবি, ভুল সংবাদ পরিবেশন
যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশের দুটি দৈনিক পত্রিকা কাবা শরীফের ছবি ব্যবহার করে মিথ্যা সংবাদ ছাপাতেও পিছপা হয়নি৷ ‘আলেমদের নির্যাতনের প্রতিবাদে কাবার ইমামদের মানববন্ধন’ শিরোনামে তারা একটি সংবাদ পরিবেশন করে, যেটা কিনা ১৮ অক্টোবর ২০১২ তে প্রকাশিত কাবার গিলাফ পরানোর সময় তোলা৷
জঙ্গিবাদকে উসকে দেয়া
গত দুই বছরে তথাকথিত ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট আইএস বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে জবাই করে হত্যা করেছে এবং সেই হত্যাদৃশ্যের ভিডিও প্রচার করেছে৷ অনেক সংবাদ মাধ্যমও নিজেদের টিআরপি বাড়াতে সেই ভিডিও প্রচার করেছে৷ কিন্তু একদিকে এই ভয়াবহ দৃশ্য মানুষের মনে চাপ সৃষ্টি করে, অন্যদিকে জঙ্গিবাদকে উসকে দেয় না কি!
শিশুদের ছবি প্রকাশ না করা
কোনো শিশুর বাবা-মাকে হত্যা করা হয়েছে৷ মানবিক আবেদন সৃষ্টি করতে অনেক সংবাদমাধ্যম তখন শিশুটিকে নিয়ে নানা প্রতিবেদন তৈরি করে৷ এতে যে শিশুটির উপর মানসিক চাপ তৈরি হয়, এটা সাংবাদিকদের বোঝা উচিত এবং এটা নীতিবিরুদ্ধ৷
শিশু অপরাধী এবং শিশু নির্যাতনের শিকার
অনেক দেশেই শিশু অপরাধীদের ছবি প্রকাশ করা হয় না৷ পাশাপাশি কোনো শিশুর ছবি তুলতে হলে অভিভাবকদের অনুমতি লাগে৷ এছাড়া ক্ষেত্র বিশেষে শিশুদের নিরাপত্তার স্বার্থেও অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া তাদের ছবি প্রকাশ করা উচিত নয়৷ কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই নীতি মেনে চলা হয় না৷ বাংলাদেশে নির্যাতিত শিশুর ছবিও হরহামেশাই প্রকাশ করা হয়৷
# সূত্র: DW