বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষকে সরকারি অফিশগুলোতে যেতে হয়। সরকার, পরোক্ষাভাবে জনগণ কাজ করার জন্য বেতনভূক্ত কর্মচারী নিয়োগ করে। এটাই গণপ্রজাতন্ত্র। মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্যই হাজার হাজার কোটি টাকা বেতন দিয়ে সরকার কর্মী বাহিনী নিয়োগ করে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের দেশে সরকারি অফিশের চেয়ারটা পরিণত হয় মানুষকে জিম্মি করে অবৈধভাবে টাকা উপার্জনের হাতিয়ারে। ফলে এখন অফিশের পিয়ন নিয়োগেও আট দশ লক্ষ টাকা ঘুষ লেনদেন হচ্ছে বলে শোনা যায়। মানুষ ‘অশিক্ষিত’ এবং অসচেতন হওয়ায় খুব সহজেই সরকারি কর্মচারীরা দূর্নীতি করতে পারে, এবং দূর্নীতি করে পার পেয়ে যায়। কোনো অভিযোগ উঠলে তদন্তকারী কর্মকর্তা এক্ষেত্রে পরিণত হয় একজন ভাগিদারে। সিস্টেম যা ছিল তা-ই থেকে যায়।
একটা উপজেলায় মাসে কত কোটি টাকার দুর্নীতি হয়? তেমন কোনো পরিসংখ্যান কোনো গণমাধ্যম বা বেসরকারি সংস্থার কাছে নেই। খুব সহজ নয় সে হিসেব করা। তবে গবেষণা প্রকল্প হিসেবে কাজটা করা যেতেই পারে— তাতে উঠে আসবে যে, একটা উপজেলা থেকে সাধারণ মানুষের কত টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। যতটুকু উন্নয়ন এলাকায় হয় তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা বেরিয়ে যায় বলে ধারণা করা যায়। ঘুষের সাথে জনগণের করের (ভ্যাট/ট্যাক্স) টাকায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন যোগ করলে যত টাকা একটি উপজেলা বা জেলা থেকে সরকারি কর্মচারীরা নিয়ে যায় ততটা উন্নয়ন হয় না। এর সাথে যোগ হয় রাজনীতির নামে গুণ্ডাপাণ্ডাদের চাঁদাবাজি। এসব কারণেই মূলত গ্রামের মানুষ রাতদিন পরিশ্রম করেও জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে পারছে না।
উপজেলায় দুর্নীতি এবং হয়রানির বড় পাঁচটি ক্ষেত্র হচ্ছে— উপজেলা পরিষদ (উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিশ), ভূমি কর্মকর্তার অফিশ, থানা, সাবরেজিস্টারের অফিশ এবং উপজেরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়, উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, সমবায় অফিশ, কৃষি কর্মকর্তা, মৎস্য কর্মকর্তার অফিশ, প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার অফিশ এবং উপজেলা সমাজসেবা অফিশ -্এসব অফিশগুলোতেও প্রচুর পরিমাণে দূর্নীতি হয়। ‘জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল’ তুলনামূলক অচেনা একটি অফিশ হলেও এখানেও দূর্নীতির বড় সুযোগ রয়েছে। এর বাইরে দূর্নীতি হয় সরকারি ব্যাংকগুলোতে। বিশেষ করে কৃষি ব্যাংকে সাধারণ মানুষ নাজেহাল হয় সবচেয়ে বেশি।
জেলা পর্যায়ে গিয়ে এসব অফিশের উপরিতলের সাথে যোগ হয় ডিসি অফিশ, জেলা পরিষদ, আদালত এবং কারাগার। এছাড়া জেলা পর্যায়ে, কর, কাস্টমস্ (যেখানে আছে), গণপূর্ত এবং পিডিবি দূর্নীতির দুটি বড় জায়গা। বিভাগীয় পর্যায়ে সিটি কর্পোরেশন, কাস্টমস্ এবং রেল ছাড়া দূর্নীতির তেমন কোনো স্বতন্ত্র ক্ষেত্র নেই। সাধারণত উপজেলা এবং জেলার অফিশগুলোতে কর্মরত কর্মচারীদের বদলী বা পদায়ন ইত্যাদি কাজের ক্ষেত্র থেকেই বিভাগীয় অফিশের দুর্নীতিগুলো হয়ে থাকে। তাছাড়া জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে কিছু নিয়োগ হয়, যেগুলো দূর্নীতির একটি বড় ক্ষেত্র।
এর উপরের দূর্নীতি হচ্ছে, প্রকল্প পরিচালকের দূর্নীতি, কেনাকাটায় দূর্নীতি— যেগুলো পত্রিকায় প্রায়ই খবর হয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের অধীনে বিদেশী অনুদান আসে, যেমন, এলজিআরডি মিউনিসিপালিটির অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের অনুদান এবং স্বল্পসুদে ঋণ পায়। বিশ্বব্যাংক আবার স্বচ্ছতা আনার জন্য বিএমডিএফ নামে সরকারের অধীনে আলাদা একটি সংস্থাও তৈরি করেছে, তাতে সুফল কতটা মিলেছে সেটি অবশ্য পর্যালোচনার বিষয়। অর্থাৎ যুগ্ম সচিব থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত পদগুলোতে দূর্নীতির যে ক্ষেত্র সেগুলো জনসাধারণের চেনা জানা গণ্ডির বাইরে। তাছাড়া দূতাবাস সংক্রান্ত কোনো খবরই আসলে পত্রিকায় আসে না। সেখানেও প্রচুর দূর্নীতির সুযোগ রয়েছে, মাঝে মাঝে একটু আধটু শোনা যায়।
বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত দূর্নীতির যে চিত্র সেখানে টাকা কালেকশনের কাজটা করে উপজেলা এবং জেলার অফিশগুলো, প্রধানত উপজেলার কর্মচারীরা। ফলে উপজেলায় যদি ঠিকমত চোখ রাখা যায়, এবং উপজেলা পর্যায়ের দূর্নীতি বন্ধ করা যায়, তাহলে এ ধরনের দূর্নীতি (যে দূর্নীতির কারণে জনগণ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয়) অনেকাংশেই বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার চাইলেই তা সম্ভব, কিন্তু সরকার চাইবে না, তার কারণ— যারা দূর্নীতিটা করছে তারাই তো প্রকারন্তরে সরকার।
দূর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পারত সাংবাদিকেরা। সাংবাদিকেরা তা পারে না, কারণ, তেমন চৌকস কোনো সাংবাদিক যেমন উপজেলা পর্যায়ে থাকে না, আবার দুএকজন থাকলেও ভাগীদারদের কাছে তারা কোণঠাসা। উপজেলা প্রেসক্লাবে মাসে এক লাখ টাকা খরচ করলেই তো সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া যায়। সব সাংবাদিককেও কব্জা করা লাগে না। প্রেসক্লাবের সভাপতি এবং সম্পাদককে বোগলদাবা করতে পারলেই হয়ে যায়। তাছাড়া শীর্ষ গণমাধ্যমগুলো বেতনভূক্ত কোনো প্রতিনিধি উপজেলা পর্যায়ে থাকে না, ফলে কারো সদিচ্ছা থাকলেও অর্থের অভাবে সঠিক কাজটি তারা করতে পারে না।
সবকিছু মিলিয়ে উপজেলা পর্যায়ে দূনীতি বাড়তে বাড়তে সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে, কিন্তু গণমাধ্যমে তার কিছুই আসে না। আসবেও না। এজন্য বলছি— ভুক্তভোগী আপনি নিজেই লিখুন। এতটা নিষ্ক্রিয় হয়ে, মাথা নত করে না থেকে, নিজেকে একটু জাগ্রত করুন, অধিকার আদায়ে সোচ্ছার হোন, নিজে লিখতে না পারলে কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নেন। ‘চিঠিপত্র’ হিসেবে আমাদের লিখুন। চিঠিপত্র হিসেবে লিখলে জবাবদিহিতার কোনো বিষয় আমাদের থাকবে না। তবে আপনি সত্য লিখবেন, সাপোটিং ডকেুমেন্টস্ রাখবেন, মোবাইলে ছবি তুলবেন, গোপনে রেকর্ড করবেন। এভাবেও দূর্নীতির লাগাম অনেকখানি টেনে ধরা সম্ভব হবে। কোনো ডকুমেন্টস্ না থাকলেও লিখুন, আমরা অভিযুক্তের নামটা লিখব না, সেক্ষেত্রে শুধু ঘটনাটা ছাপব। তাতেও একটা দূর্নীতি বিরোধী মনোভাব মানুষের মধ্যে তৈরি করা সম্ভব হবে।
লিখুন (মেইল করুন)/ফোনে সরাসরি সম্পাদকের সাথে কথা বলুন
০১৮৪ ৬৯ ৭৩২৩২