ড. মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাত। সারাদিন বিভিন্ন মুখরোচক খাবার খাওয়ার পরও একবেলা ভাত না খেলে প্রতিটি বাঙালিরই মনে হয়, কিছুই খাওয়া হয়নি। ফলে ভাতের ক্ষেত্রে বাঙালির পুষ্টিচাহিদা পূরণের চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা বেশি কাজ করে। এ প্রবণতা বাংলার মধ্যবিত্ত থেকে বিত্তহীনদের মধ্যে হাজার বছর ধরে বিরাজমান।
শুধু ভাত নয়, এ দেশে ধানভিত্তিক বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রীর উপস্থিতি দেখা যায়; যেমন চিড়া, মুড়ি, পিঠা-পুলিসহ অন্যান্য খাবার। একসময় দেশে হাজার ধরনের ধান পাওয়া যেত। এগুলোর প্রতিটিরই নিজস্ব উৎপাদন মৌসুম ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। এসব ধানের চাল থেকে তিনবেলার ভাতসহ তৈরি হতো রকমারি খাবার।
এখনো দেশের মানুষের খাদ্য থেকে পাওয়া শক্তির ৮০ শতাংশের বেশি চাল থেকে আসে। ষাটের দশকে শুরু হওয়া তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের পর বেশ কয়েকটি স্থানীয় জাত ছাড়া ধানের সনাতন এসব জাতের প্রায় সবগুলোই আজ বিলুপ্ত। এ জাতগুলোর মধ্যে বাদামি বা লাল রঙের চাল উৎপাদনকারী স্থানীয় জাত যেমন বিরই, আমপারা, বাঁশিরাজ, গাইনজা, চামারা, কাইটা, কালিবোরো, কুনাইল, ধলি বোরো, গাজিলি বোরো, নাহি বোরো, টেপি বোরো, রাতা বোরো, কাবর, বাতরি, মুইনাশাইল, গগোশাইল, পুটিশাইল দিঘা, মুক্তাহার ইত্যাদি জনপ্রিয়তার বিচারে উল্লেখযোগ্য। প্রবাদ আছে যে টেপি বোরো চালের ভাত খেলে ক্ষুধা লাগার উপায় নেই। এর মানে হলো, এ চালের ভাত আস্তে আস্তে হজম হয় ও দীর্ঘ সময় ধরে শক্তির জোগান দেয়।
বাংলাদেশে আবহমানকাল থেকে ঢেঁকির মাধ্যমে প্রক্রিয়া করে ধান থেকে চাল উৎপাদন করা হয়। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের আধুনিকায়নের ফলে কলের বা মেশিনের মাধ্যমে চাল ভাঙা শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের পর পরই। ১৯৮০ সালের পর নতুন নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি ব্যাপক উন্নতি ও প্রসার লাভ করে। শিল্পোন্নয়নের ডামাডোলে দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসে এখন পরিবর্তন ঘটছে। দেশে সাদা চালের চাহিদা বেড়েছে। এ কারণে সাদা চালের ধানের জাত ও চাল সাদা করার মেশিনের উদ্ভাবনও হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশসহ সব চাল উৎপাদনকারী এশীয় দেশেই এখন প্রক্রিয়াজাত সাদা চাল অত্যন্ত জনপ্রিয়। কয়েক দশক ধরেই এসব দেশে চাল প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। মিলিং, সেদ্ধকরণ ও দ্রুত সেদ্ধকরণ, চাল শুকানো, গুদামজাত ইত্যাদি ধাপ বিবেচনায় নিয়ে সাদা চাল প্রক্রিয়াকরণের নানা উপায় উদ্ভাবন হচ্ছে। দেখতে সুন্দর, খেতে সুস্বাদু বিধায় বর্তমানে ধনী-গরিব নির্বিশেষে দেশের বেশির ভাগ মানুষ সাদা চালের ভাত গ্রহণ করছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের বিভিন্ন গবেষণায় সাদা ও পলিশ করা চালের বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব উঠে এসেছে।
গবেষণাগুলোয় বলা হয়, এসব চাল বেশি গ্রহণের সঙ্গে টাইপ ২ ডায়াবেটিক মেলিটাস হওয়ার প্রবণতার সরাসরি সম্পর্ক পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামসহ এ চাল উৎপাদনকারী দেশগুলোয় এ রোগের প্রাদুর্ভাব গবেষণাটির ফলাফলের সপক্ষে সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ।
বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে গবেষণার মাধ্যমে অধিক ফলনশীল ধানের জাত মুক্তায়িত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) কর্তৃক যথাক্রমে ৮৮ ও ১৪টি ধানের জাত উদ্ভাবন হয়েছে। এ জাতগুলোর প্রায় সবই সাদা চালের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যসংবলিত। বর্তমানে বাংলাদেশে ব্রি উদ্ভাবিত বিআর ২৯ (সাদা রঙের চাল, ১৯৯৪ সালে মুক্তায়িত) জাতটি উচ্চফলনশীলতার জন্য বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া পলিশ করা বা মসৃণ সাদা অথবা প্রক্রিয়াজাত মিনিকেট চাল এখন প্রায় সবাই গ্রহণ করছে। এ দুই ধরনের চালের গ্লাইসেমিক সূচক বেশ উচ্চমাত্রার (৭০-এর বেশি)। প্রসঙ্গত, গ্লাইসেমিক সূচক হলো খাদ্যের গুণগত মান, যার মাধ্যমে ওই খাদ্য গ্রহণ করার পর তা ভেঙে রক্তে গ্লুকোজ সরবরাহের দ্রুততার আপেক্ষিক মাত্রা পরিমাপ করা হয়। খাদ্য গ্রহণ করার দুই ঘণ্টার মধ্যে গ্লুকোজ সরবরাহের মাত্রার ওপর গ্লাইসেমিক সূচককে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো উচ্চমাত্রা (৭০ বা তদূর্ধ্ব), মধ্যম (৫৬ থেকে ৬৯) এবং নিম্ন (৫৫ বা এর কম)।
উচ্চ গ্লাইসেমিক ইনডেক্স সমৃদ্ধ খাবার বেশি সংখ্যক বার ও অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করলে দেহে গ্লাইসেমিক লোড বেড়ে যায়। ফলে ভোক্তা ধীরে ধীরে টাইপ ২ ডায়াবেটিস মেলিটাসে আক্রান্ত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সূত্রমতে, বর্তমানে দেশে ১ কোটিরও বেশি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ১৯৯৫, ২০০০ ও ২০১০ সালে এ রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪, ৫ ও ৯ শতাংশ। দেশে এখন যে হারে এ রোগের প্রকোপ বাড়ছে তা অব্যাহত থাকলে, ২০৩০ সালে তা দেড় কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিস্ময়ের বিষয় হলো, দেশের বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে সচেতনতা অত্যন্ত কম। এমনকি আক্রান্ত মানুষের ৫০ শতাংশেরও বেশি জানে না, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অথচ ডায়াবেটিসকে এখন অন্যান্য অনেক অসংক্রামক রোগ যেমন হূদরোগ, স্ট্রোক, বড়-ছোট রক্তনালির ক্ষতি, কিডনি সমস্যা, দৃষ্টি সমস্যা এমনকি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার প্রশস্ত পথ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ডাক্তাররা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাধারণত নিম্ন গ্লাইসেমিক সূচকমান (৫৫ বা তার চেয়ে কম) সংবলিত খাবার গ্রহণের পরামর্শ দেন। লাল বা বাদামি চাল ডায়াবেটিস রোগীদের অন্যতম পথ্য হিসেবে বিবেচিত। ফলে বিগত বছরগুলোয় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সচেতন মানুষের মধ্যে প্রক্রিয়াকৃত সাদা চালের পরিবর্তে এখন লাল চাল, বিশেষ করে পূর্ণ দানাদার লাল চাল বা ঢেঁকি ছাঁটা চালের ভাতের কদর বাড়ছে। কারণ বিভিন্ন গবেষণায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে এ চালের কার্যকারিতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া পূর্ণ শস্য লাল চাল এখন অটিজমে আক্রান্ত শিশুর খাদ্যতালিকায়ও রাখা হচ্ছে।
পূর্ণ শস্য লাল চালের বৈশিষ্ট্য: ধানের জাতগুলো সাধারণত ইন্ডিকা ও জাপানিকা নামের দুটি ভিন্ন উপপ্রজাতিভুক্ত। গঠনশৈলী অভিন্ন হলেও উপপ্রজাতি দুটির ধানের মধ্যে অভ্যন্তরীণ গুণাগুণে যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। সব ধানের ক্ষেত্রে মাড়াই করার পর সেখান থেকে তুষ (হাস্ক), কুঁড়া বা ব্র্যান, শস্য ও ভ্রূণ পাওয়া যায়। গঠনগতভাবে দেখতে গেলে ধানের কুঁড়া (ব্র্যান) উপরিত্বক, বীজত্বক ও নিউক্লিয়ার কোষের সমন্বয়ে গঠিত। পূর্ণ দানাদার লাল চাল উৎপাদনের সময়ের তুষ (লেমা, পেলিয়াসহ) পুরোপুরি আলাদা করে ফেলা হয় এবং কুঁড়াও আংশিকভাবে ভাঙা বা মিলড হয়ে যায় (শুরুর ফ্লোচার্ট দ্রষ্টব্য)।
প্রক্রিয়াজাত সাদা চালের তুলনায় পূর্ণ শস্য লাল চালে উদ্ভিদজাত অন্যান্য সক্রিয় জৈব যৌগ ও পুষ্টি উপাদানের পাশাপাশি খাদ্যতন্তু (ডায়েটারি ফাইবার), সক্রিয় গৌণ জৈব যৌগ যেমন গামা অ্যামাইনো বিউটারিক অ্যাসিড (গাবা), সি-অরাইজানল এবং ম্যাগনেশিয়াম, ফেনল, ক্যারোটিনয়েড, টকোট্রিনলস, ফাইটোস্টেরলস, পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (ওমেগা-৩ বা ওমেগা ৬), বিভিন্ন খনিজ, অ্যান্থোসায়ানিনস, অ্যান্থোসায়ানিডিন ও ভিটামিন বি বেশি পরিমাণে থাকে। সাধারণত এসব পুষ্টি উপাদান অতিক্রিয়া বা সিনারজেস্টিক হিসেবে কাজ করে এবং দীর্ঘমেয়াদি ডিজেনারেটিভ রোগ প্রতিরোধে কাজ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পূর্ণ দানাদার লাল বা বাদামি চালে ডায়াবেটিক প্রতিরোধী উপাদান ডায়েটারি ফাইবার, গাবা, সি-অরাইজানল নামের সক্রিয় জৈব যৌগ রয়েছে।
এছাড়া এতে রোগ প্রতিরোধী শর্করার ভগ্নাংশ পাওয়া যায়। এসব উপাদানের মধ্যে গাবা হলো একটি অ-আমিষ অ্যামাইনো অ্যাসিড, যা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজে অংশগ্রহণ করে। এসব কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দেহের কেন্দ্রীয় স্নায়বিক ব্যবস্থায় নিউরোট্রান্সমিটারের ভূমিকা পালন, রক্তচাপ ও হূত্কম্পনের হার নিয়ন্ত্রণ, মস্তিষ্কের আমিষ সংশ্লেষণ ত্বরান্বিত করা এবং ব্যথা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দান। তেমনি সি-অরাইজানল হলো ফিউরালিক অ্যাসিড এস্টারের একটি মিশ্রণ, যা অগ্ন্যাশয়কে সরাসরি প্রভাবিত করে এর (বেটা) কোষকে উদ্দীপিত করে গ্লুকোজবর্ধক ইনসুলিন নিঃসরণ করতে পারে। অন্যদিকে ডায়েটারি ফাইবার গ্রহণের সঙ্গে ডায়াবেটিক কমানোর বিপাকীয় প্রক্রিয়ার যোগসূত্রের বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে ক্লিনিক্যালি প্রমাণিত হয়েছে।
এখানে ২ নং চিত্রে পূর্ণ দানাদার চালের বিভিন্ন খাদ্যতন্তু ও সক্রিয় জৈব উপাদানের কার্যাবলির প্রবাহ দেখানো হয়েছে।
পূর্ণ দানাদার লাল বা বাদামি চালের ডায়াবেটিস-বিরোধী কার্যকারিতার প্রমাণ হিসেবে এ চালে প্রাপ্য শর্করার কম গ্লাইসেমিক সংবেদনশীলতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাছাড়া এ চালে কয়েকটি গৌণ সক্রিয় জৈব যৌগ যেমন গামা অ্যামাইনো বিউটারিক অ্যাসিড (গাবা), সি-অরাইজানল এবং ম্যাগনেশিয়াম আছে যেগুলো ডায়াবেটিস-বিরোধী কার্যাবলি ছাড়াও অক্সিডেন্ট, ক্যান্সার, হাইপারলিপিডেমিক, হাইপারটেনসিভ ও হূদরোগবিরোধী কার্যকারিতার সুবিধার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ধান ভাঙার পর চালের পুষ্টি উপাদানের বিভাজন: উপরের ১নং চিত্র ও আলোচনায় শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন গুণাগুণ থেকে চালের পুষ্টিমান সম্পর্কে জানা গেছে। চালের উপরিভাগের কুঁড়া স্তরের অপসারণের বিষয়টি চাল ভাঙার বা মিলিংয়ের মাত্রার মাধ্যমে বিশেষায়িত করা হয়, যা পূর্ণ দানাদার লাল বা বাদামি চালের সামগ্রিক পুষ্টিমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। সাধারণত পূর্ন দানাদার লাল বা বাদামি চাল মিলিংয়ের মাত্রা বা বিস্তৃতির সীমা শূন্য থেকে ১০ শতাংশ। চাল থেকে অত্যাবশ্যকীয় চর্বি, আমিষ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, খাদ্যতন্তু বা আঁশ (ডায়েটারি ফাইবার), ভিটামিন ও মিনারেলের মাত্রা হ্রাসের বিষয়টির সঙ্গে মিলিং পদ্ধতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। চালের পুষ্টি উপাদান যতদূর বেশি সম্ভব ধরে রাখতে চাইলে মিলিংয়ের মাত্রা প্রায় ২ শতাংশ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখতে হয়।
দেখা গেছে, ধান ভাঙা বা মিলিং করার সময় আমিষ, খনিজ, মুক্ত ফেনোলিক ও ফ্ল্যাভানয়েড জাতীয় উপাদানগুলোর ক্ষতির পরিমাণ যথাক্রমে ২৮ দশমিক ৬, ৮৪ দশমিক ৭, ৬৫ দশমিক ১ ও ৭২ দশমিক ৩ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। আবার অত্যাবশ্যকীয় খনিজের বেলায় ধান ভাঙানোয় বা মিলিংয়ে প্রক্রিয়ায় জাতভেদে আয়রনের ক্ষতি হয় ২৫ থেকে ৮৪ শতাংশ। গবেষণায় দেখা গেছে, রঙিন চালের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া করে সাদা করার সময় ৯০ শতাংশের বেশি ফেনোলিক যৌগ কালো ও লাল দানা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। এ থেকে বোঝা যায়, চালের বহিঃত্বক ও জার্মে কী পরিমাণ পুষ্টি থাকে। অন্যদিকে মিলিংয়ের মাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চালের মুখরোচক নরম অংশ বেরিয়ে আসার পাশাপাশি রান্নার সূচকেও উন্নতি ঘটে। কারণ চালের বহিঃত্বকের গঠন কিছুটা চর্বণ অনুপযোগী ও আঁটসাঁট প্রকৃতির থাকে, যা চালের ভেতরে পানি অনুপ্রবেশে বাধা দেয়।
এছাড়া এর কারণে রান্না করতে সময়ও একটু বেশি লেগে যায়। ফলে রুচি ও পুষ্টি বৈশিষ্ট্যাবলির কারণে পূর্ণ দানার লাল বা বাদামি চাল সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণাও আছে। যদিও চালের বহিঃত্বক ভগ্নাংশ ও জার্মে সক্রিয় জৈব যৌগ উচ্চমাত্রায় বিদ্যমান। অন্যদিকে এতে অক্সিডেটিভ এনজাইম, লিপোক্সিনেজ ও পার অক্সিডেজ উপস্থিতির কারণে রান্না করার পর বিস্বাদ গন্ধ দেখা পাওয়া যায়। এবং পুষ্টিবিরোধী উপাদান ফাইটিক অ্যাসিড ও ট্যানিনের উপস্থিতি কখনো কখনো ভোক্তাকে বিভ্রান্ত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভোক্তা তার পছন্দের সঙ্গে আপস করতে পারেন।
পূর্ণ দানাদার চাল এ কুঁড়ার স্তরগুলো (মোট ওজনের ৬-৭ শতাংশ), ভ্রূণ (২-৩ শতাংশ) ও শস্য (প্রায় ৯০ শতাংশ) সমৃদ্ধ। এ চালকে পূর্ণ শস্য খাদ্য বলা হয়, কারণ শস্য ও উপরিত্বকের সহাবস্থান, বীজত্বক ও জার্মের মধ্যে মানব শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর উপস্থিতি পাওয়া যায়। কুঁড়ার স্তর, জার্ম ও শস্য চালের তিন ধরনের শারীরবৃত্তীয় ভগ্নাংশ (সাইকোলজিক্যাল ফ্র্যাকশন) এককের তুলনায় সমন্বিতভাবে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হিসেবে কাজ করে।
তা সত্ত্বেও ভোক্তার কাছে পূর্ণ দানাদার লাল চালের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে কিছু অন্তর্গত ও বাহ্যিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেগুলো হলো ক. বেশি আঁশের জন্য শক্ত গঠন অনুভূতি ও চিবানোর সমস্যা, খ. নিম্ন পানি শোষণক্ষমতা ও একটু বেশি সময়ব্যাপী রান্না, গ. প্রক্রিয়াকৃত সাদা চালের চেয়ে জারণে অধিক সংবেদনশীলতা ও দুর্গন্ধ সৃষ্টি, ঘ. পুষ্টিবিরোধী নিয়ামকের (যেমন ফাইটিক ও ট্যানিন) উপস্থিতি, ঙ. খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কারণে প্রক্রিয়াকৃত খাদ্যপণ্যের প্রতি আসক্তি এবং সর্বোপরি চ. সাধারণ ভোক্তার পূর্ণ দানাদার লাল বা বাদামি চালের স্বাস্থ্য সুবিধা সম্পর্কে অজ্ঞতা।
বাংলাদেশ দ্রুত উন্নয়নের দেশ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং এ অর্জনের জন্য দেশের কর্মমুখী সৃজনশীল মানুষের অবদান অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ২০৪০ সালের মধ্যে জনমিতিক লভ্যাংশ (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) অর্জনের পথে এগিয়ে চলেছে। অর্থাৎ দেশে ওই সময়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মক্ষম যুবা বয়সীর উপস্থিতি থাকবে। জনমিতিক লভ্যাংশের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে সুস্থ-সবল মানুষ পাওয়া খুবই জরুরি। আর সুস্থ-সবল মানুষের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের কোনো বিকল্প নেই।
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি খাদ্যের অভ্যন্তরীণ গুণাবলিও মানবদেহের জন্য নিরাপদ হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেহেতু দেশের বেশির ভাগ মানুষের খাদ্যশক্তির সিংহভাগ (৮০ শতাংশেরও বেশি) পাওয়া যায় চাল থেকে, সেহেতু দেশের মানুষের কল্যাণের জন্যই চালের গুণাগুণ উন্নয়ন অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় উচ্চফলনশীল জাত ব্রি-ধান ২৯-এর সম-উৎপাদনশীলতাসম্পন্ন কিন্তু নিম্ন গ্লাইসেমিক সূচক (<৫৫ ) সংবলিত ধানের জাত উদ্ভাবন ও এর দ্রুত সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। তাছাড়া বর্তমান মিলিং পদ্ধতির উন্নয়ন করে চালের এলুরিন কম নষ্ট হয়, এমন পদ্ধতির উদ্ভাবন করতে হবে। এ কাজটি সম্পাদন করতে নীতিনির্ধারক, গবেষকদের কর্মপন্থা প্রণয়নের এখনই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। সর্বোপরি সচেতন ভোক্তারা এ কাজটিকে আরো গতিশীল করে তোলায় চমত্কার অবদান রাখতে পারেন।
লেখক: ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও জৈব কৃষি গবেষক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট।
(লেখাটি ৮ জানুয়ারি ২০১৯ বণিক বার্তাতেও প্রকাশিত হয়েছে)