ছোট্ট এই জীবনটা যেন কারো কষ্টের কারণ না হয়

আমাদের হতাশার কারণ কিন্তু এই প্রকৃতি বা পশু-পাখি নয়; আমাদের হতাশার কারণ আমরা নিজেরাই, অর্থাৎ অমরা মানুষেরাই একে অপরকে হতাশ করি, কাঁদাই। অথচ উল্টোটা করলে পৃথিবীটা কত সুন্দরই না হতো! চাইলেই কিন্তু আমরা একে অপরকে হাসাতে পারি। পারস্পারিক সহযোগিতার মনোভাব, কাউকে ছোটো না করা, সহমর্মিতা, সঠিক ব্যবহার, সুন্দর ব্যবহার দিয়ে এটি করা সম্ভব।

একটা উদাহরণ দিই—

আজকে আমি ছোটো ছোঠো ছয়টা ইলিশ মাছ কিনেছি। সন্ধ্যার সময় মাত্র আটশো টাকা দিয়ে মাছগুলো কিনেছি। অন্য সময় হলে এরকম মাছ কিনতে বারোশো টাকা কমপক্ষে লাগে। পকেটে হাত দিয়ে দেখি টাকা নেই। ওটি ছিল বিক্রেতার কাছে শেষ ছয়টি মাছ, বললাম– বাসায় চলেন। উনি জানতেন না আমার বাসা কতো দূরে। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় বললেন– আপনার বাসায় যেতে পারতাম না। বললাম, কেন মামা? উনি কটু কথা শুনালেন। আমি ওনার কথার ধারপাশ দিয়ে না গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বাসা কোথায়? এভাবেই মাছের প্রসঙ্গ ঢাকা পড়ে গেল। জীবনকথা জমে উঠল। শেষ পর্যন্ত উনি আমাকে মোবাইল নম্বর দিলেন এবং আরও ভালো মাছ সাপ্লাই দেয়ার প্রতিশ্রতি দিলেন।

ওনাকে আমি কী দিলাম? আসলে বাড়তি কিছুই তো দিলাম না। কিছু দেয়ার সামার্থ আমার নেইও। তাছাড়া দিতে গেলে তো আগে নিতে হয়, তাই দেয়া যে সবসময় খুব ভালো তাও তো নয়। মানুষের প্রাপ্যটুকু দিলেই হয়, তা না দেয়াটা পাপ। হেঁটে যাওয়ার কষ্টটুকু পোশায়ে দিয়েছি সত্য, তবে ওনাকে আমি এর চেয়ে বড় একটা জিনিস দিয়েছি— শান্তি দিয়েছি, তা সে মুহূর্তটুকুর জন্যে হলেও। ওনার ব্যবসায় লাভ-লসের খোঁজ খবর নিয়েছি, ওনার পরিবার সম্পর্ক জানতে চেয়েছি। এটা ওনার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। প্রায় সকল ক্রেতার কাছে উনি ঠকবাজ! আমারা ধরে নিয়েছি, বিক্রেতা মাত্রেই ঠকবাজ। আমলা ভুলে যাই যে, এই দুনিয়ায় সকলেই বিক্রেতা— নিত্য কেনাবেঁচা চলছে সবখানে, কখনো আমাদের জ্ঞাতে, কখনো অজ্ঞাতে।
প্রত্যেক মানুষ এখন নিজেকে এক দুঃসহ প্রতিযোগিতার মাঝে ফেলে দিয়েছে। ধনী গরীব সবাই এখন হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে। গরীবের সামনে তবু একটা লক্ষ্য আছে— সে স্বচ্ছল হতে চায়। ধনীর সমস্যা আরও বেশি, সে সুখের খোঁজে, আরো স্থুলভাবে বললে ভোগের নেশায় সে বেহুশ!

মারাত্মক অসুখ বিরাজ করছে চারপাশে। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সবাই সবাইকে কাঁদাতে ব্যস্ত। অন্যকে না কাঁদাতে পারলে আমাদের যেন কোনো সুখ নেই। আমরা ক্লান্ত হচ্ছি এবং ক্লান্ত করছি। ভয়ংকর এক বিষবৃত্ত তৈরি হয়েছে। এর থেকে বের হতে হলে অবশ্যই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে, না হলে দশটি পদ্মা সেতু হলেও লাভ হবে না। মানুষের ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করতে হবে, মানুষকে হাসাতে হবে, নিজেও হাসতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে— ছোট্ট এই জীবনটা যেন কারো কষ্টের কারণ না হয়।