আমি ভেবেছিলাম এনটিভির নামে কেউ ট্রল করছে …

এনটিভি অনলাইন

দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির সাবেক সাংসদ আলহাজ্ব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলী ফালুর মালিকানাধীন টিভি চ্যানেল ‘র অনলাইন হচ্ছে https://www.ntvbd.com/, এখান থেকে একটি সংবাদ ছড়িয়েছে গতকালকে—যেটি দেখে শিক্ষিত সমাজ বিস্মিত হয়েছে, অশিক্ষিত মুর্খরা অন্ধত্বের খোরাক পেয়েছে। মালিককে নিয়ে যত কথাই থাকুক না কেন, এনটিভি চ্যানেলে যারা কাজ করে তাদের কিছু জ্ঞান বুদ্ধি আছে বলেই আমরা ভাবতে চাই, কিন্তু সেটি যে নেই তা এ ধরনের ট্রলের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। তারা শুধু যে মসজিদটি অক্ষত থাকার খবর দিয়েছে তা নয়, তারা আরও লিখেছে—

এনটিভি অনলাইন
এনটিভি অনলাইন থেকে স্ক্রিনশটটি নেওয়া।

“সবই পুড়ল, রইল শুধু ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ”

অথচ স্পষ্টতেই সেখানে সবই পোড়েনি। আসলে এটা নিয়ে কোনো কথা বলাই কোনো মানে হয় না। এই কুসংস্কার, এই অন্ধত্ব একুশ শতকে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমি কিছু বলতে চাই না। একটি চায়ের দোকানের বাদানুবাদ থেকেই পেয়ে গেছি উত্তরগুলো।

তবে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, সেখানে তারা শুধু হাতাহাতি করতে বাদ রেখেছিল। তখন ভাবছিলাম, এমনিই ধর্মের প্রশ্নে সমাজটা অন্ধত্ব এবং ধান্দা নির্ভর, তার ওপর যদি এ ধরনের উস্কানি দেয় কোনো মূলধারার গণমাধ্যম তাহলে অবস্থা তো এরকমই হওয়ার কথা। 

পোড়েনি
দেখাই যাচ্ছে তেলতেলে টাইলস্ মাড়িয়ে আগুন ওখানে পেঁৗছায়নি।

দেখা যাচ্ছে তেলতেলে টাইলস্ মাড়িয়ে আগুন ওখানে পেঁৗছায়নি।

এখানে একটা চায়ের দোকানে বসেছিলাম, এই দোকানটাতে প্রধানত বাঙালি কম্যুনিটির লোকজনই আড্ডা দেয়, দোকানটাও একজন বাঙালির। সেখানে একটি তর্কবিতর্ক শুনছিলাম। একজন বলছে, “দেখছিস! এনটিভিতেও খবরটি এসেছে। তখন আরেকজন বলতেছে, “এনটিভিও তোর মতো ভূয়া। তুই একটা কাগজে লিখে পোড়ায়ে দেখ তো পোড়ে কিনা, তাহলে তো হিসেবটা সহজ হয়ে যায়।”

চায়ের দোকানদার বলতেছে, “তাহলে তো বাবরি মসজিদ ভাঙার সময় প্রতিটি হাতুড়ির বাড়ি উল্টে ঐ হিন্দুগো কপালে লাগার কথা। সিরিয়ার মসজিদগুলো নিয়ে তো কিছু বললেন না …” 

আশ্বস্ত হলাম। বুঝলাম যে দুবৃত্তরা যতই চেষ্টা করুক, মানুষ এগোচ্ছে। মানুষ এসব ভাওতাবাজিতে এখন আর ততটা উস্কানি অনুভব করে না। কিন্তু এনটিভি নিয়ে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। এই চ্যানেলটা আর সম্প্রচারে থাকতে পারে কি, থাকা উচিৎ কি? 

এনটিভির দেখাদেখি অনেক আঞ্চলিক পত্রিকায়ও এসেছে এই খবরটি। যেমন বরিশাল টাইমস্ নামক একটি অনলাইন এই খবরটি করেছে—

৬ তলা মসজিদ

একই কাজ করেছে জাগোনিউজ নামের অনলাইনটিও—

তারা একটি ভিডিওও জুড়ে দিয়েছে, যেখানে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, শুধু মসজিদ নয়, অন্যান্য অনেকগুলো ভবনে আগুনের আঁচ অতটা মারাত্মকভাবে লাগেনি। 

জাগোনিউজ.কম

বিষয়টি নিয়ে আমি কথা বলেছি লন্ডনে বসবাসরত একজন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন,

শোনো, বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশে একটা মনস্তত্ব তৈরি হয়েছে, সেটি ধর্মভিত্তিক এবং আত্মঘাতী। অনেক মুর্খ হিন্দুরা ভাবে এটা শুধু সাম্প্রদায়িক। নাহ, বিষয়টি মুসলমানদের অশিক্ষার ফসল, এটা তাদের ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। এখানে যেটা হয়েছে, পত্রিকাগুলো হয়ত কাটতি বাড়াতে চেয়েছে। তুমি যে নিউজটা দেখাচ্ছো, দেখা যাচ্ছে ওখানে অর্ধলাখ ফেসবুক শেয়ার রয়েছে। পত্রিকা কাজটি প্রধানত করেছে এ কারণে (প্রচার বাড়াতে), তারা সমাজের ভালো মন্দের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে না, তারাও একটি ব্যবসায়ীক মনোভাব নিয়ে মাঠে নেমেছে। আবার এটা ঐ পত্রিকায় কর্মরতদের মানসিকতা এবং অশিক্ষার বিষয়টাও তুলে ধরছে। আরেকটা বিষয় মনে রাখতে হবে, ভারতবর্ষে হিন্দুরা একসময় কিছু শিক্ষাদিক্ষার চর্চা করেছে, অনেক মুসলিমও প্রগতিশীল হয়েছিল, এখন তারা পাল্টাপাল্টি অসভ্য হয়েছে। আরও হচ্ছে।”  

ভয়ঙ্কর হচ্ছে, এ ধরনের ট্রলগুলো তারা (গণমাধ্যম এবং গণমানুষ) এমন একটি সময় এবং এমন একটি বিষয়কে ঘিরে করছে যেটি খুবই অমানবিক ঠেকছে বেশিরভাগ মানুষের কাছে। যেখানে শতাধিক মানুষ মরে আঙ্গাড় হয়ে গেছে সেখানে একটি মূল ধারা গণমাধ্যম কীভাবে এমন ফাজলামিতে মনোযোগ দিতে পারে? এ হিসেব মেলাতে পারছে না লন্ডনবাসী বাঙালিরা। কথা থেকে যায়, এটাই যদি ঐ গণমাধ্যমের মূল আগ্রহের জায়গা হয়ে থাকে তাহলে তারা ঐ সব বাড়িতে থাকা কোরআন শরীফ সম্পর্কে কোনো নিউজ করছে না কেন? অত বড় বাড়িতেও তো নামাজ পড়ার জায়গা ছিল, সেটির অবস্থা কী? জায়নামাজগুলো অক্ষত আছে কি? এসব প্রশ্ন আমার নয়, মানুষের কথা। ধর্ম নিয়ে এইসব বাড়াবাড়ি, অজ্ঞতা যতদিন থাকবে, ততদিন বাংলাদেশ কখনই বিজ্ঞান ভিত্তিক হবে না, কোনোদিনও বদলাবে না কিছু, পুড়ে ডুবে নানানভাবে মরবে মানুষ, মরছে মানুষ!

আরও অনেক পত্রিকাও এরকম খবর ছেপেছে:

যুগান্তর

যুগান্তর পত্রিকা

বিশেষজ্ঞরা অবশ্য একই কথা বলছে, তারা বলছে,

ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে ব্যবসায়ীক প্রচারণাই পত্রিকাগুলোকে এ ধরনের একটি কুসংস্কারধর্মী খবর প্রদানে উৎসাহিত করেছে। আমাদের গণমাধ্যম যেহেতু মানুষের পিছনে ছোটে এবং মানুষ এই ধরনের সংবাদ পছন্দ করেছে, তাই দেখাদেখি বেশিরভাগ পত্রিকাই পক্ষঘাতগ্রস্থের মতো দিগ্বিদিক শর্টকাট সে পথে হেঁটেছে। 


শেকস্ রাসেল/লন্ডন, যুক্তরাজ্য থেকে

[মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব। কারও কোনো মতামতের জন্য ফলোআপনিউজ কোনো দায় অনুভব করে না, কোনো দায়িত্ব নেয় না।]