ছাত্রলীগ যখন কাউকে খুন করে, ফলাফল হচ্ছে- একজন খুন হল; ছাত্রশিবির যখন কাউকে খুন করে, তখনও ফলাফল হচ্ছে- একজন খুন হল, ফলাফল একই। ফলাফলের দিক থেকে এ দুটি খুনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ফলাফলে পার্থক্য নেই, তবে খুনের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে ঢের পার্থক্য রয়েছে। শিবির খুন করে ‘আদর্শিকভাবে’, ছাত্রলীগ খুন করে আদর্শের বিচ্যুতি থেকে, তাই শিবিরের সন্ত্রাস এবং ছাত্রলীগের সন্ত্রাস একইভাবে একইঅর্থে আলোচনা করার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে গভীর একটি বিশ্লেষণ দরকার, তবে সে আলোচনার আজকের লেখার উদ্দেশ্য নয়।
লিখতে চাচ্ছি শুধু ছাত্রলীগ নিয়ে।‘ছাত্রলীগ কারা করে’ এই প্রশ্নটি না করে, প্রশ্ন করা যায়- বর্তমানে রাজনীতি কারা করে?
উত্তরে বলা যেতে পারে কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও রাজনীতি করে–
১। বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজে পড়ুয়া চতুর কিছু ছেলেরা, যারা ধনী এবং ক্ষমতাশালী হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে নেতা হয়;
২। উদ্ধত এবং উগ্র কিছু ছেলেরা, যারা কর্মী হয়, কেউ কেউ নেতাও হয়।
এই দুইয়ে মিলে হয় নেতা-কর্মী। কিছু মননশীল ছেলে ছাত্র রাজনীতিতে শুরুতে আসলেও শেষ পর্যন্ত তারা টিকে থাকতে পারে না, কিছু চলে যায় অতি সংখ্যালঘুত্ব মেনে নিয়ে, কিছু চলে যায় একটি ভাল চাকরি বোগলদাবা করে। চতুর ঐ ছাত্রনেতারা মেধাবী মননশীলদের খেদিয়ে দিতে পেরে বেজায় খুশি হয়, কারণ, এতে তাদের যাচ্ছেতাই করার পথ প্রশস্ত হয়। তাই যোগ্যদের বিসিএস বা এরকম কোন চাকরি ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করতে শুধু ছাত্রলীগ নয়, মূল আওয়ামীলীগও চায়। গত দশ বছরের ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের উপর নজর রাখলে দেখা যাবে যে, যোগ্য অনেকেই ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিল, কিন্তু তাদের বেশিরভাগ এখন নেই, বেশিরভাগ চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছে, কিছু ঝরে গিয়েছে।
অবিশিষ্ট যারা থেকেছে তারা মূলত অপকর্মই করেছে। ‘ভাল কাজ’ বলতে- জামাত-শিবির ঠেকানো। অর্থাৎ ‘শিবির জুজু’ ছাত্রলীগকে সুবিধা করে দিয়েছে, তারা ‘কাউন্টার টেরোরিজম’ তত্ত্ব হাজির করতে পেরেছে, এবং সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা জারি রাখতে পেরেছে। এই ‘কাউন্টার টেরোরিজম’ শিবিরের বিরুদ্ধে যতটা না ব্যবহৃত হয়, তার চেয়ে শতগুণ বেশি ব্যবহৃত হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন অঞ্চলে আধিপত্য এবং চাঁদিবাজি বজায় রাখতে।
যুদ্ধপরাধীদের বিচার, গণজাগরণ মঞ্চ, নাস্তিক-আস্তিক ইস্যু, ব্লগার হত্যাকাণ্ড, যাত্রীবাহী বাসে মানুষ পুড়িয়ে মারা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে ছাত্রলীগের অপকর্মগুলি আলোচিত হয়েছে কম। দুই একটি বিষয় অতি স্পর্শকাতর হওয়ায় সেগুলি আলোচিত হয়েছে। গত কয়েক বছরের ছাত্রলীগের কিছু ভয়ঙ্কর অপকর্মের উপর চোখ রাখলে এ বক্তব্যে বিশ্বাস রাখা কঠিন যে, ছাত্রলীগের মধ্যে বিশেষ কোন পরিবর্তনের আভাস আছে। ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার যে সংস্কৃতি ছাত্রলীগ তৈরি করেছে, তাতে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সোনলী ঐতিহ্যের এ সংগঠনটি হয়ে উঠেছে নানান ধরনের অপরাধীর আশ্রয়স্থল, রাজনীতিটা যাদের কাছে একটা অজুহাতমাত্র।
ছাত্রলীগের হাতে বিরোধীপক্ষের কেউ আহত বা নিহত হলে যে শুধু বিচার হয় না, তা নয়, বিচার হয় না নিজ দলের কেউ বা সাধারণ কেউ নিহত হলেও।
ছাত্র লীগের ক্রস ফায়ারে (বা অন্যকোনভাবে, জানা যায়নি) ঢাবি ছাত্র আবু বকর নিহত হয়েছিল ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ সালে। তারপর পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে, কিন্তু বিচার হয়নি। এ ধরনের হত্যাকান্ড বন্ধও হয়নি। এরকম আরেকটি ঘটনা ঘটায় পূর্বেরটি মানুষ ভুলে গিয়েছে।
আবু বকর হত্যাকাণ্ডের বিচার বিষয়ে ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকে একটি ফলোআপ রিপোর্ট হয়েছিল, এরপরে বিষয়টি পুরোপুরি পর্দার আড়ালে চলে যায়।
বাংলা টাইমস-এ ২২ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে “ছাত্রলীগের হামলায় ছয় বছরে সাধারন ছাত্র সহ ৫৪ জন নিহত” শিরোণামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছেল। এই রিপোর্টে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ছাত্রলীগের হাতে নিহতের একটি পরিসংখ্যান রয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হয়েছে ৫৪ জন, এর মধ্যে ৩৯ জনই নিজ দলের, বাকী পনেরো জনের মধ্যে ২ জন শিশুও রয়েছে। এ পরিসংখ্যান থেকে বলা যায়- আওয়ামীলীগ ছাত্রলীগের সন্ত্রাস ‘কাউন্টার টেরোরিজম’ বললেও সেটি আসলে টেরোরিজমই। না হলে নিজ দলের ৩৯ জন খুন হবে কেন? সাধারণ জনগণ খুন হবে কেন? যদিও কোন খুনই কাম্য নয়। এটি ২০১৪ সাল পর্যন্ত হিসেব। এরপরেও ঘটনা ঘটে চলেছে, যদিও কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিরোধীপক্ষ নেই, তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে বিরোধী খুঁজে নিচ্ছে।
আসলে স্বার্থের রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব থাকবেই, এবং কম প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তিতে বিরোধীপক্ষ নিজেদের মধ্যে অচিরেই জন্ম নেবে, তাই ছাত্রদল থাকা বা না থাকায় ছাত্র রাজনীতিতে সংঘর্ষ এবং খুনের রাজনীতির কোন পরিবর্তন হচ্ছে না বলেই ধারণা করা যায়, বিশেষ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে অদূর ভবিষ্যেতেও কোন পরিবর্তন হবে না।