ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুতে টেলিভিশন চুরির অপবাদ দিয়ে রানা (২৭) নামে এক যুবককে গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। গত ২৮ ডিসেম্বরের এ ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর শুক্রবার রাতে আওয়ামী লীগ নেতাসহ দু’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা হলেন তাহেরহুদা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে একাংশের সভাপতি শাহীনুর রহমান তুহিন এবং ধূলিয়া গ্রামের বাবুল কাজী।
এরকম ঘটনা এদেশে নতুন নয়, এবং কেউ কোনো অপরাধ করলে তাকে এভাবে শাস্তি দেওয়া যায় -এরকম ভাবনার লোকও এদেশে নেহাত হাতে গোনা নয়। রাস্তায় গণপিটুনি দেওয়ার চিত্র অনেকেই নিশ্চয়ই দেখেছেন, পাশ দিয়ে রিক্সায় যাচ্ছে এমন লোকও নেমে একটি লাথি মেরে যায় যে হয়ত ঘটনার আদ্যপান্ত কিছুই জানে না, অর্থাৎ আমাদের মনোজগতটা এখনও আদীম, অসভ্য এবং নির্যাতনকারী হিসেবে রয়েছে।
শিশু নির্যাতন, এবং নারী নির্যাতন—এ দুটি খুবই সচরাচর চিত্র, যদিও খুব মারাত্মক কোনো ঘটনা না হলে এগুলো খুব বেশি গণমাধ্যমে আসে না। শিশু এবং নারী নির্যাতনের বিষয়গুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দলবদ্ধ নয়, সাধারণত দলবদ্ধ এবং কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ পেয়েছে এমন নির্যাতনের বিষয়গুলিই আমরা শুধু জানতে পারি, যদিও এ ধরনের ঘটনার বিস্তার সারাদেশে অনেক বেশি এবং বারংবার।
চুরি ডাকাতির অপরাধ জানলে, কেউ ধরা পড়লে তাকে দলবদ্ধভাবে নির্যাতন করা হয়, এবং এক্ষেত্রে একজন থাকে নেতৃত্বে। অনেকক্ষেত্রে চোর সন্দেহে কাউকে ধরে এনেও এরকম নির্যাতন করা হয়। সাধারণত যার পোশাক মলিন, চেহারা একটু উসকোখুসকো তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেশে আমাদের সমাজের মানুষ!
ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, অনেক লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ ধরনের ঘটনাগুলো দেখলেও কেউ প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসে না। অনেকে যুক্তি দেখায় যে ভয়ে আসে না, যদি তাকেও মারে। আসলে এ যুক্তি ধোপে টেকে না, কারণ, কোনো রাস্তায় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলেও এ ধরনের চিত্র দেখা যায়। কেউ আহত ব্যক্তিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে না, যদিও এক্ষেত্রে কারও মার খাওয়ার ভয় নেই। তাছাড়া আপনার হৃদয় যদি আবেগে আপ্লুত হয়, আপনার মনে যদি দয়ামায়া থাকে তাহলে কোনো ভয় আপনাকে আটকাটে, আর অনেক লোক যখন একইসাথে মায়াবী হয়ে এগিয়ে যাবে তখন কমসংখ্যাক ভয়ঙ্কর মানুষ পাত্তা পাবে না। সমস্যা হয় তখন যখন সমাজে ভয়ঙ্কর এবং নির্লিপ্ত মানুষের সংখ্যা দরদী এবং মানবিক মানুষের তুলনায় বেড়ে যায়।
একটি ঘটনা এক্ষেত্রে উল্লেখ না করে পারছি না। কিছুদিন আগে গোপালগঞ্জ শহরের অদূরে মহাসড়কে একটি ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটে—যাতে একটি মাহেন্দ্র গাড়িতে থাকা সবাই মারা যায়, যার মধ্যে দুজন শিশুও রয়েছে। এ ধরনের বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দুর্ঘটনাটি ঘিরে গবেষণা হওয়ার কথা, কিন্তু আমাদের দেশে তা হয় না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করেছি ঘটনার অনুপুঙ্খ জানতে, কারণ, পত্রিকায় যা এসেছে তা খুবই অপ্রতুল এবং ভুলভাল। ঘটনাটা যা জানতে পেরেছি–
মহাসড়কের সাথে অবস্থিত বাইপাস সড়ক দিয়ে একটি মটরসাইকেল উঠে আসছিল, মটর সাইকেলটি অসতর্কভাবে ওঠায় ওটি বাসের সামনে পড়ে যায়, দ্রুত গতিতে ধাবমান বাস চালক তখন মটার সাইকেল আরোহীকে বাঁচাতে ডানে কাটে, এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসছিল মাহেন্দ্র গাড়িটি, যেটির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। বাসটি মাহেন্দ্র গাড়িটিকে পাশে অবস্থিত কনক্রিটের একটি ছোট্ট স্থাপনার সাথে পিশে ফেলে।
সাথে সাথে কিন্তু সবাই মারা যায়নি, সেটি যাওয়ার কথাও নয়। বিশ্লেষণ করে এবং খোঁজ নিয়ে যেটি জানলাম, মাহেন্দ্রটিতে ছিল মোট ১৩জন যাত্রী! যদিও একটি এরকম গাড়িতে স্বাভাবিকভাবে থাকার কথা পাঁচজন যাত্রী। আটজন যাত্রীই অতিরিক্তি ছিল।
কমপক্ষে চারজন লোক মারা গিয়েছে ধীরে ধীরে, অনেক সময় নিয়ে; কিন্তু তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ সাড়ে চার ঘণ্টা পরে বাসটি রেকার দিয়ে সরানো সম্ভব হয়েছে। ততক্ষণে আহতরা সবাই মারা গিয়েছে। একজন আহত ব্যক্তিকে জনতা বের করে রাস্তায় চলমান একটি অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দেয়, কিন্তু তার সাথে কেউ সহযাত্রী হয়নি। জানা যায়, অ্যাম্বুলেন্স চালক তাকে কোনোমতে খুলনা আড়াইশো বেড হাসপাতালে পেঁৗছে দেয়, যেখানে সে মারা যায়। যদিও লোকটিকে স্বাভাবিকভাবে প্রথমে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে আনার কথা ছিল, বা আহত লোকটিকে নিয়ে কয়েকজনের ঐ অ্যাম্বুলেন্সে যাওয়া উচিত ছিল।
আরও যেটি জানা যায়, চেপ্টে যাওয়া মাহেন্দ্রর মধ্যে তখনও একটি শিশু বেঁচে ছিল, সে মৃত মায়ের কোলে লেপ্টে ছিল, কিন্তু বাসটি না সরিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করা সম্ভব ছিল না। লজ্জা, ঘৃণা এবং দু:খের বিষয় হচ্ছে, একটি বাস সরানোর মতো একটি ভারী রেকার জেলা সদরে ফায়ার সার্ভিসের নেই! ফলে সেটি যতক্ষণে এসেছে ততক্ষণে সাড়ে চার ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে! দুর্ঘটনা কবলিত মাহেন্দ্রর মধ্যে শিশুসহ তিন থেকে চারজন লোক ‘আমাকে বাঁচান’ বলতে বলতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে অস্ট্রেলিয়ার পার্থ স্টেশনের একটি ঘটনা মনে পড়ছে—খবরে দেখেছিলাম যে জনতা সম্মিলিতভাবে ট্রেনটির বগি ঠেলে ফাঁকে পড়ে যাওয়া একজনকে উদ্ধার করে। ফলে লোকটি বেঁচে যায়। উপরের দুর্ঘটনার খবরটি শোনার পর থেকে আমার বারে বারে মনে হয়েছে জনতা সম্মিলিতভাবে বাসটিকে ঠেলে ধাক্কিয়ে কি অপরপাশে ফেলে দিতে পারত না? দড়িবেঁধে, ঠেলে, গুতিয়ে কোনো না কোনোভাবে সেটি হয়ত যেতই, কারণ, হাজার হাজার লোক সেদিন চারপাশে উপস্থিত ছিল। অন্তত হাত লাগাতে পারত, আঁকিবুকি করতে পারত, অস্থির হতে পারত … কিছুই করতে পারেনি, বিপরীতে যেটি জানা গিয়েছে—যে মৃতদেহগুলি বাইরে ছিটকে আসে তাদের পকেটের মানিব্যাগ এবং মোবাইল পাওয়া যায়নি।
জনতার যে পরিচয়, গণমানুষের যে পরিচয় আমরা পাচ্ছি তাতে এটা বলা অসংগত নয় যে আমরা হয়ত পিচাচ্ছি। আসলে যতটুকু হৃদয়বৃত্তির চর্চা থাকলে, যতটুকু মমত্ববোধ ভেতরে মজুদ হলে মানুষ মানুষ হয় তা আমাদের নেই, এজন্য কাউকে বাঁচানোর জন্য সংগঠিত হওয়ার নজির আমাদের কম, আছে আক্রমণের জন্য সংগঠিত হওয়া।
দেশের দুর্ঘটনাগুলো নিয়ে গবেষণা হলে, বেশিরভাগক্ষেত্রেই হয়ত অসহায়ত্বের এমনসব চিত্র উঠে আসত। নারী অধিকারকর্মীরা যদি প্রকৃতপক্ষে ঘরে ঘরে সংগঠিত নারী নির্যাতনের বিষয়গুলি তুলে আনতেন তাহলে ভয়ঙ্কর সব বিষয় উঠে আসত। শিশু নির্যাতন বিষয়ে মনোযোগী হওয়া জরুরী সবচে বেশি, কারণ, শিশুরা বলতে পারে না, তারা বলা প্রয়োজন আছে বলে বুঝতে পারে না, তারা আইন জানে না, এ কারণে শিশু নির্যাতনে বিষয়গুলি একেবারেই আড়ালে থেকে যায়।
সামনে আসে আলোচ্য বিষয়ের মতো নির্যাতনের আলোচিত ঘটনাগুলি। ছোটবেলায় মনে পড়ে একদিন পাড়ায় একটি আলোচনা শুনছিলাম, আলোচনা ছিল এরকম—কয়েকজন ডাকাত জনতার হাতে ধরা পড়েছে এবং জনতা ডাকাতদের সবার চোখ উপড়ে ফেলেছে। সবার মতো আমিও সেদিন খুশি হয়েছিলাম, কারণ, যেহেতু ডাকাতদের চোখ তুলে ফেলা হয়েছে, যে মহিলারা বলাবলি করছিল তাদের চোখেমুখেও ছিল খুশির ঝিলিক, কারণ, ডাকাতদের চোখ তুলে ফেলা হয়েছে।
একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বড় না হলে, কিছুটা হৃদয়বৃত্তির চর্চা না করলে আজও হয়ত আমি মনে করতাম যে ধৃত ডাকাতদের চোখ তুলে ফেলা যায়। ঐ নারীরা যে সবাই খুব খারাপ মানুষ ছিল তাতো নয়, কিন্তু তারা এমন একটি পরিবেশ এবং চর্চার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে যেখান থেকে অতটুকুই শিখতে পেরেছে যে ডাকাতদের চোখ তুলে ফেলা যায়, তাদের নির্যাতন করে হত্যা করা যায়।
কোনো নির্দিষ্ট আদর্শের নয়, হৃদয়বৃত্তির চর্চার মধ্য দিয়েই শুধু একটি সমাজ সুন্দর হতে পারে, মানবিক হতে পারে, কিন্তু সে চর্চা আমাদের পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে অনুপস্থিত। ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার আত্মঘাতী চেষ্টায়, অহংকার এবং আক্রমণের মাধ্যমে বর্বর সুখলাভের মন নিয়ে বেড়ে উঠছে আমাদের সমাজের মানুষ। শাহীনুর রহমান তুহিন এবং বাবুল কাজী—আমাদের চারপাশের অসংখ্য সেরকম মানুষের মধ্যে দুজন মাত্র।
কোনো বড় ঘটনার প্রেক্ষিতে এরকম দুএকজন হয়ত গ্রেফতার হবে, কিন্তু সমাজে পূর্ণাঙ্গরূপে হৃদয়বৃত্তি এবং মানবিকতার চর্চা ছাড়া এরকম অসংখ্য মানুষকে নিবৃত করা যাবে না, প্রতি মুহূর্তে তারা অন্যকে অত্যাচার করছে, প্রতি মুহূর্তে তারা হিংস্র হচ্ছে, নির্যাতনের অজুহাত খুঁজছে।