ক্ষমতায় থেকে গত ষোলো বছর আওয়ামী লীগ আসলে কী আদর্শের চর্চা করেছে?

বঙ্গবন্ধু

৭৫ বয়সী একটি রাজনৈতিক দল এভাবে আদর্শচ্যূত হয়ে ছারখার হয়ে যেতে পারে? স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী একটি দলের এভাবে অধঃপতন হতে পারে? বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একটি দল এভাবে গণমানুষের কাছে হাসিঠাট্টা এবং আক্রান্তের বিষয়বস্তু হতে পারে? জাতির পিতা, দেশের জন্য ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে থাকা সপরিবারে শহীদ মানুষটাকে এভাবে লাঞ্চিত অপমানিত করা যেতে পারে? কেন মানুষ এভাবে আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার ওপর খেপে উঠলো? কেন মানুষ আওয়ামী লীগের নাম গন্ধ পেলেই তাকে আক্রমণ করতে চাইছে, করছে? সংকটটা এতটা ভয়ানকভাবে কীভাবে তৈরি হলো? শুধুই কি জঙ্গি জামাতি চক্র এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের সব দোষ? শুধুই কি বিদেশের হস্তক্ষেপ, নাকি আত্মসমালোচনার বিশেষ সুযোগ রয়েছে?

অনেক কথাই বলা যায়—

১. এদেশের বেশিরভাগ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেনি, ’৭১-এর গণহত্যা স্বীকার করেনি, ভুলে গিয়েছে, বিচার চায়নি। এমনকি এমন মানুষ অনেক আছে যারা মনে করে যে, ’৭১-এর গণহত্যা ঠিক ছিলো।

২. এদেশের বেশিরভাগ মানুষ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং তার আত্মত্যাগ মেনে নেয়নি;

৩. এদেশের বেশিরভাগ মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ভারতের হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখে;

৪. এদেশের বেশিরভাগ মানুষের মনস্তত্বে ইসলামের শরিয়তি ধারা দিয়ে পরিচালিত, যেখানে মওদুদীবাদ ধর্মের রাজনৈতিক বহিঃপ্রকাশ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে;

৫. এদেশের বেশিরভাগ মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে ইচ্ছুক ছিলো না;

৬. এদেশের বেশিরভাগ মানুষ বাংলাদেশকে একটি ইসলামিক দেশ হিসেবে দেখতে চায়;

৭. এদেশের বেশিরভাগ মানুষ ভারতকে শত্রু মনে করে, এবং আওয়ামী লীগকে ভারতের বন্ধু মনে করে;

৮. এদেশের বেশিরভাগ মানুষ খুব দায় না ঠেকলে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগকে দেখতে চায় না;

৯. এদেশের মানুষের মধ্যে মধ্যপন্থা মূলত একটি চাপিয়ে দেওয়া রাজনীতি, প্রকৃতপক্ষে তারা কট্টরপন্থী;

১০. এদেশের বামপন্থা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও ঐতিহাসিকভাবে তা ডানপন্থার বুকচিরে বেরিয়ে এসেছিলো, ফলে ইসলামের প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা এদেশের বামপন্থার মধ্যেও রয়েছে। আবার অনেক বামপন্থী নেতা বামপন্থাকে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির রাজনীতি না করার সুযোগ হিসেবে দেখে। ভয়ংকর হলেও সত্য যে, তারা জামায়াত ইসলামির বিকল্প হিসেবে বাম রাজনীতি করে;

১১. ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের শত্রু, চীনও শত্রু। চীন তাদের নয়া কৌশলে অক্টোপাসের মতো করে বাংলাদেশকে বন্ধু বানাতে চাইলেও বাস্তবে চীন কারো বন্ধু নয়;

১২. এদেশের মানুষ অন্যান্য দেশের আধিপত্য যে চোখেই দেখুক না কেন ভারতের আধিপত্য মানতে তারা একেবারেই নারাজ, কারণ, ভারত এদেশের মানুষের ধর্মীয় শত্রু, এবং রাজনৈতিক শত্রুও। ভারত বলয় থেকে বের হওয়ার জন্য তারা বুঝে বা না বুঝে যেকোনো খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তেও রাজি আছে।

দেশের যখন এরকম একটি বাস্তবতা তখন বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগের এদেশে রাজনীতি করা যে খুব কঠিন ছিলো একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। দিন দিন সেটি আরো কঠিন হয়েছে, কারণ, মুক্তবুদ্ধি এবং মুক্তচেতনা দেশ থেকে ধীরে ধীরে লোপ পেয়েছে, বিপরীতে ঘৃণা বিদ্বেষ এবং হিংসার রাজনীতি বেড়েছে। পারিবারিকভাবে ইসলামিক মূল্যবোধের চর্চার চেয়ে সম্রাজ্যবাদী ইসলাম বেশি করে জায়গা করে নিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে এ ধরনের বিশ্লেষণ কি আওয়ামী লীগের কাছে ছিলো না? যদি থেকে থাকে তাহলে সুযোগ পেয়েও জনগণের মনস্তত্ত্ব তৈরি করার জন্য কোনো কৌশল তারা অবলম্বন করলো না কেন? বরং তারা একদল গুণ্ডা বাহিনী এবং পুলিশ প্রশাসন নিয়ে ‍শুধু ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইলো। গুণ্ডা বাহিনী লুটপাট চালিয়ে গেলো, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মোটেও ধারণ করলো না। পুলিশ দুর্নীতির শিখরে পৌঁছে গেলো, কিন্তু জনগণের বন্ধু হতে পারলো না। শেখ হাসিনা বাধ্য হয়ে বা ইচ্ছে করেই গন্ধের গন্ধ আত্মীয়দেরও ক্ষমতার মধ্যে আনতে আনতে প্রকৃত রাজনীতিবিদদের কোনঠাসা করে ফেললো। এরপর শুরু হলো অনুপ্রবেশ। আওয়ামী বিরোধিরাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সেজে বসে গেলো। এক সময় এসে বিভিন্নক্ষেত্রে তারাই কলকাঠি নাড়তে শুরু করলো। আওয়ামী লীগ কীভাবে ভাবলো এই বাংলাদেশে রাঘববোয়াল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার করে, বিএনপি-এর মতো এতবড় একটি দলকে কোনঠাসা করে, বিপরীতে কোনো ধরনের ন্যায়নীতির চর্চা না করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে? দানবের দেশে মানব যে কিছু নেই, তাতো নয়, কিন্তু সেই মানবদেরও আওয়ামী লীগ বিগত কয়েক বছরে খেপিয়ে তুলেছিলো। ফলে আজকে আওয়ামী লীগের যে পরিণতি তার দায় শুধু সমাজের দানবীয় শক্তির নয়, অনেকাংশেই এ দায় আওয়ামী সরকারের নিজের।

যদি প্রশ্ন করা হয়— গত ষোলো বছরে আওয়ামী লীগ আমলে কোন আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়েছে, এর উত্তর কেউই দিতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুকে তারা তাত্ত্বিক নেতায় পরিণত করতে ব্যর্থ হয়েছে, বিপরীতে কাঠোমোবদ্ধভাবে চাপিয়ে দিয়েছিলো দানবদের মাথার ওপরে? সুযোগ পেলে দানবেরা তা আস্ত রাখবে, রেখেছে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করতে গিয়ে জনগণের হাত থেকে তা ছুটে গিয়েছে একেবারে। বাধ্য হয়ে নিরপেক্ষ জনগণও আশ্রয় নিয়েছে শরিয়তী ইসলামে, বা নিদেনপক্ষে ঘৃণার চর্চায়। তথাকথিত মুক্তমনাদের জন্যও আওয়াম লীগ একথা সত্যে পরিণত করেছে। মুখে অনেক বলুক বা নাই বলুক, জামায়াত ইসলামই এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, তারাই এখন মেইনস্ট্রিম।

আওয়ামী লীগ ভালো কাজ যে করে নাই, তা নয়, অনেক করেছে। প্রয়োজনীয় কিছু মেগাপ্রজেক্ট, গ্রামগঞ্জে রাস্তাঘাট পৌঁছে দেওয়া, বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ভাতার আওতায় আনা, এরকম অসংখ্য ভালো কাজ তাদের আছে। একইসাথে মনে রাখা দরকার ছিলো— যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজের মতো ভয়ংকর একটা কাজও তারা করেছে, ভয়ংকর, কারণ, এদেশে যুদ্ধাপরাধীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। একইসাথে ক্ষমতায় থাকার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক কৌশল এবং অপকৌশল তাদের অবলম্বন করতে হয়েছে। জামায়াত বিনপির মতো সরাসরি মানুষকে আঘাত না করলেও, রাজনৈতিকভাবে এবং পুলিশি নিপীড়ণ তারা বিরোধী রাজনীতির ওপর চালিয়েছে, একথা অস্বীকার করার মোটেও সুযোগ নেই। ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে সংখ্যালঘুদের ওপরে এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপরে বিএনিপি-জামায়াত যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো সেটি নজিরবিহীন, ২০২৪-এ যা ঘটছে সেটিও নজিরবিহীন। সে তুলনায় না গিয়ে বলা যায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রয়োজনীয় কারণে অপকৌশলে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে যে জনভিত্তি তৈরি করতে হয় আওয়ামী লীগ সেটি করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। বিপরীতে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতির যে ধরনের খবর সামনে আসছিলো তাতে মানুষ একেবারেই খেপে গিয়েছিলো। এর আগে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে মানুষ ছিলো নাজেহাল। পাড়ায় পাড়ায়, শহরে মহল্লায় কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ যুবলীগের অত্যাচারে মানুষ ছিলো জর্জরিত। ফলে ৫ আগস্ট যে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনার পতন হয়েছে সেটিকে একমাত্রিকভাবে ব্যাখ্যা করার কোনো সুযোগ নেই। শুধুমাত্র বিদেশী হস্তক্ষেপ বলে উড়িয়ে দেওয়াও যায় না। এজন্যই এমন হযবরল অবস্থা ধারণ করেছে আন্দোলন পরবর্তী সরকার ব্যবস্থা। যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে— আসলে এই সরকার টিকতে পারবে কিনা। খুত দ্রুত তারা সবকিছু পরিবর্তন করছে। পুলিশকে বিশ্বাস না করে মাঠে রাখে হয়েছে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছাত্রদের, যারা মূলত আওয়ামী নেতাকর্মীদের পালানোর পথ বন্ধ করার কাজে নিয়োজিত ছিলো। মেরেধরে একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে এরকম একটি কাজ করতে কতটা ষড়যন্ত্র এবং ব্যাকগ্রাউন্ড ওয়ার্ক প্রয়োজন হয়, সেটি বোঝা কঠিন কিছু নয়। বোঝাই যাচ্ছিলো খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এর চেয়ে খারাপ হচ্ছে এসব দেখেও জনগণের নিরবতা। তারা কোনো আওয়ামী লীগের নেতা কর্মী মারা পড়লে উল্লাস করছে। তারা পথেঘাটে ছাত্রদের ট্রাফিক কার্যক্রমের প্রশংসা করছে, কিন্তু ঘরে ঢুকে ঢুকে মানুষ হত্যা করছে, লুটপাট করছে সেগুলো তারা দেখতে চাচ্ছে না।

কেন মানুষ এরকম হয়ে গেলো? আওয়ামী লীগকে এগুলো বিশ্লেষণ করতে বসতে হবে। এরকম একটি সমন্বিত শক্তি কি একদিনে তৈরি হয়েছে? তারা বলতে গেলে সবদিক থেকে সরকারকে ঘেরাউ করেছে। তারা জনশক্তি তৈরি করেছে, তারা পুলিশ বাহিনীকে হঠিয়ে দেওয়ার কার্যকর পরিকল্পনা দাঁড় করিয়েছে, তারা সেনাবাহিনীর একাংশের দখল নিয়েছে, তারা দেশের সবখানে পাহারা বসিয়েছে। এরপর তারা গণভবন আক্রমণ করেছে। চাইলে এটা তারা আরো পনেরো দিন আগেও করতে পারতো। করেনি, কারণ, তারা শুধু শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে নামাতে চায়নি, তারা ভয়ংকর এক নারকীয় খেলায় মেতে উঠতে চেয়েছে। এর পরিণাম দেশের জন্য ভালো হবে না, মানুষের জন্য ভালো হবে না, কিন্তু অশিক্ষিত অসভ্য দেশের জনগণ হিসেবে আমাদের সেটি বোঝার ফুসরত কই? আমরা শোধ প্রতিশোধ এবং রক্তের খেলা পছন্দ করি। ক্ষমতার আদর্শ এখানে নেই, নিরপেক্ষতা এবং মহত্ত্ব বলে এখানে কিছু নেই। গণতন্ত্রের কথা ‍শুধু মুখে বলা হয়, আসলে আমরা ভয়ংকরভাবে পরমত অসহিঞ্চু এবং আপন শ্রেষ্ঠেত্বের দাবীদার। এমতাবস্থায় এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, বাংলাদেশ একটি গভীর সংকটের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে।

প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার সশস্ত্র আন্দোলনের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন হলে নজিরবিহীনভাবে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবার সহ হত্যা করা হয়েছে। যশোরে এক আওয়ামী লীগ নেতার আবাসিক হোটেল জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেখানে জীবন্ত পুড়ে মরেছে হোটেলে থাকা বিশ পঁচিশ জন মানুষ, যার মধ্যে একজন বিদেশীও রয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, অনেক জায়গা থেকে হত্যার খবর এসেছে। একদিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে, অন্যদিকে এখন চলছে আইনী নিপীড়ণ, গ্রেফতার। সংখ্যালঘু হামলার ডামাডোলে হারিয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক হামলার বিষয়টি। ভয়ানকভাবে আইন হাতে তুলে নেওয়া হচ্ছে। হুমকি দিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। অস্ত্রের মুখে দোকান ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এক কথায় দেশে এখন একটি অরাজগ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কিন্তু জনগণ এসব দেখতে রাজি নয়, তারা এই নৈরাজ্যকে পরিবর্তন হিসেবে মেনে নিয়েছে। তারা ভালো কিছুর আশায় বুক বেধেছে। সব ধ্বংস এবং হত্যাযজ্ঞ মেনে নিয়েও তারা ভালো কিছু চায়। প্রশ্ন হচ্ছে— এই চাওয়ার মধ্যে ঘৃণার ভাগটা বেশি নয়তো, নইলে শিক্ষিত শ্রেণিও কীভাবে এমন স্রোতে গা ভাসালো? আওয়ামী লীগ যত অপরাধই করুক ৩২ নম্বর পুড়িয়ে দেওয়াটাও নির্বিকারচিত্তে মানুষ মেনে নিতে পারলো! গলদটা তাহরে কোথায় আসলে?