মোশাররফ হোসেন মুসা
সরকারি কাজ-কর্মে দুই প্রকারের অডিট অনুসৃত হয়ে থাকে, তাহলো প্রি-অডিট (pre-audit) ও পোস্ট-অডিট (post-audit)। যদি কোনো কাজের বিল পরিশোধ কালে কাজের মান ও কাগজ-পত্র যাচাই-বাছাই করা হয়, তাহলে তাকে প্রি-অডিট বলে। আর যদি বিল পরিশোধের পর নির্দ্ধারিত সময়ের মধ্যে দাখিলকৃত বিলের কাগজ-পত্র যাচাই-বাছাই ও সমন্বয় করা হয়, তাহলে তাকে পোস্ট-অডিট বলে। প্রি-অডিট নিয়মভুক্ত কাজে তাৎক্ষণিক হিসাব নিকাশের নিয়ম থাকায় গোঁজামিল দেওয়া কিংবা দুর্নীতি করার সুযোগ থাকে কম। কিন্তু পোস্ট-অডিট নিয়মভুক্ত কাজে সিডিউল মোতাবেক কাজ করা ও বিল-ভাউচার সমন্বয় করার জন্য যথেষ্ট সময় থাকায় দুর্নীতি করার সুযোগ থাকে বেশি। এই নিয়মে কাজ পাওয়া কোনো কোনো ঠিকাদার প্রকাশ্যেই বলে থাকেন-‘আগে তো বিল উঠাই, তারপর কাজ করব কি না পরে দেখা যাবে।’ এসব কারণে পোস্ট-অডিট নিয়মভুক্ত কাজে অডিট আপত্তি হয় বেশি। কিন্তু অডিট আপত্তির কারণে বিলের টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে কিংবা সিডিউল মোতাবেক কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে এমন ঘটনা বিরল (এখানে জনৈক রাজনৈতিক নেতা কর্তৃক বিলের টাকা উত্তোলন করে ব্রিজের কাজ সমাপ্ত না করার ঘটনাটি উদাহরণ হতে পারে)। একই কারণে বর্তমান বিশ্বে দুর্নীতি ও অপচয় রোধে প্রি-পেইড পদ্ধতি অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
একইভাবে সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক বান্দার পাপ-পূণ্যের হিসাবেও প্রি-অডিট ও পোস্ট-অডিটের মতো নিয়ম রয়েছে। নিরীশ্বরবাদী, সংশয়বাদী ও পুনর্জন্মবাদী লোকদের পাপ-পুণ্যের হিসাবকে অনেকটা প্রি-অডিট বলা যায়। নিরীশ্বরবাদীরা মনে করেন, মানুষের সৃৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিক নিয়মে এবং তার নিজের কর্মফল নিজেকেই ভোগ করতে হবে। তাদের ধারণায় পৃথিবীর ভালো-মন্দ করার জন্য আলাদাভাবে কোন ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। পৃথিবীর মঙ্গল অথবা অমঙ্গল করার উভয় ক্ষমতাই মানুষের রয়েছে। তারা আলাদাভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার না করলেও বিবেকের ঈশ্বরকে মান্য করে চলেন। এ কাতারের জনৈক ব্যক্তি বলেছেন- তিনি মন্দ কাজ করলে অনুতাপে ভোগেন আর ভালো কাজ করলে আনন্দিত থাকেন।
সংশয়বাদীরা পরকাল সম্পর্কে সন্দিহান থাকলেও ইহজগত সম্পর্কে সচেতন থাকেন বেশি। তারা মনে করেন, পৃথিবীটা পাপে পুর্ণ ও দুঃখময়। আরও পাপ করলে পৃথিবী আরও দুঃখময় হয়ে উঠবে। সেজন্য সকলকে পুণ্যের কাজ করতে হবে। অপর দিকে পুনর্জন্মবাদীদের বক্তব্য পাপ-পুণ্যের বিষয়ে ঈশ্বর সরাসরি অবলোকন করছেন এবং সে অনুযায়ী ফল দিতে সচেষ্ট রয়েছেন। তারা আরও মনে করেন- ভালো কাজ করলে উৎকৃষ্ট প্রাণীরূপে ও মন্দকাজ করলে নিকৃষ্ট প্রাণীরূপে পরজন্মে পৃথিবীতে আগমন ঘটবে। তাদের কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ উভয়ই ইহলোক কেন্দ্রিক (এখানে জীবনানন্দ দাশ ও ক্ষুদিরাম বসুর ইহলোকে ফিরে আসার আকুতি উদাহরণ হতে পারে)।
কিন্তু পুনরুত্থানবাদীদের দৃষ্টিতে ইহলোক ক্ষণকাল আর পরলোক অনন্তকাল। তারা আরও মনে করেন, পাপ-পুণ্যের কর্মফল বিলম্বে পাওয়া যাবে। যেমন- নেক কাজ করলে বেহেস্ত এবং পাপ কাজ করলে গোর আজাব ও শেষ বিচারে দোযখে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তার আগে পাপীদের পাপ মোচনের বিভিন্ন সুযোগ রয়েছে। যেমন, গির্জায় গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করা, পাদ্রীর দেওয়া শাস্তি ভোগ করে শুদ্ধ হওয়া, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা, তওবা করা, হজ্ব পালন করা, যাকাত দেওয়া ইত্যাদি। সেজন্য এ কাতারের কেউ কেউ দুর্নীতির সমর্থনে প্রকাশ্যেই বলে থাকেন, “যুবক বয়স হলো অর্থোপার্জনের বয়স। আর বৃদ্ধ বয়স হলো মার্জনা চাওয়ার বয়স।” উপরোক্ত বিষয়ে স্বাভাবিকভাবে যে কথা এসে যায়, তা হলো যারা পৃথিবীতে পুনরায় ফিরে আসার বাসনা পোষন করেন—পৃথিবীর প্রতি তাদের মমত্ববোধ আর যারা পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে চলে যেতে চান–পৃথিবীর প্রতি তাদের মমত্ববোধ এক হওয়ার কথা নয় । এক্ষেত্রে আরও প্রশ্ন এসে যায়, ইহলোককে কর্মময় ও শান্তিময় করার জন্য
প্রি-অডিটভুক্ত ধর্ম, না পোস্ট-অডিটভুক্ত ধর্ম কোনটি বেশি কার্যকর ?