এরকম কথাই ইতিহাসে বেশি প্রতিষ্ঠিত যে ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত না হলে গৃহযুদ্ধ লেগে আরো বেশি মানুষ মারা যেত, যত মানুষ মারা গিয়েছিল দেশ বিভাগের ফলে দেশ ছাড়তে গিয়ে তার তুলনায়।
যেটি তখন গৃহযুদ্ধ হতে পারত, সেটি এখন তৃ-দেশীয় যুদ্ধ। আচ্ছা, একটা বাজি ধরা যাক, ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ লাগলে পরিস্থিতি কী হবে? রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে তা বলা মুশকিল, তবে সামাজিকভাবে বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে যাবে এটা বড় বাজি ধরে বলা যায়।
যুদ্ধটা যদি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে না থাকে তাহলে প্রতিটি দেশের সংখ্যালঘুরা নির্মমভাবে কাটা পড়বে। পার্থক্য হচ্ছে ভারতের সংখ্যালঘুরা ত্রিশুলের কোপ খাবে, আর বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা খাবে চাপাতির কোপ।
যাইহোক, আশঙ্ক থাকলেও সেই পরিস্থিতি বিশ্ব বাস্তবতার কারণেই আর হবে না। যদিও বিচ্ছিন্নভাবে অনেক ঘটনা তো প্রতিদিনই ঘটছে। তবে রক্তপিপাষু মনস্তত্ত্ব সরাসরি ঘাতক হওয়ার সুযোগ না পেলেও সে হন্তারক হয় নানানভাবে, বর্তমান আধুনিক বিশ্বের এখন পর্যন্ত যতটুকু চমৎকারিত্ব তা শুধু ঐ কৌশলে ঘাতক হওয়ার মধ্যে। অর্থাৎ, এখন কেউ আর হাতে মারে না সহজে, ভাতে মারে।
উপমহাদেশের ক্রিকেটের মধ্য দিয়ে সামাজিক সেইসব সাম্প্রদায়িক মানুষের রক্তপিপাষু মনটা আবার জেগে ওঠে, ওঠার সুযোগ খোঁজে। যতই সে চেষ্টা করুক শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটের মধ্যে থাকতে আর পারে না, তাদের কাছে খেলাটা নিরাপদ একটা উপলক্ষ্য হয় ঘৃণা প্রকাশের জন্য।
আমাদের চির প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার কথা ছিল পাকিস্তান, কিন্তু হয়েছে ভারত। পাকিস্তান আমাদের জন্ম শত্রু, আর ভারত বড় এবং আধপত্যবাদী হিসেবে শত্রু, তার চেয়ে বেশি শত্রু তারা ধর্ম বিবেচনায়। উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান পরস্পর শত্রু। এককভাবে হিন্দু-মুসলিম পরস্পর বন্ধু হতে পারে, কিন্তু বন্ধুত্ব গৌণ হয়ে যায় জাতের লড়াই বাধলে।
এ দৃষ্টান্ত শুধু ’৪৭ এবং ’৭১-এ প্রতিষ্ঠিত নয়, এটা বেশ পুরনো লড়াই। তাই বিভিন্ন অবাস্তব কথা বলার চেয়ে এটা মেনে নিতে অসুবিধা নেই যে ভারত-বাংলাদেশের খেলায় সেই একই মজা ভারত এবং বাংলাদেশের মানুষ পায় ঠিক যে মজা ভারত-পাকিস্তানের খেলায় ভারত এবং পাকিস্তানের জনগণ পায়।
এই মিলের তাৎপর্যটা ঠিক কোথায়? এই মিল ব্যাখ্যা করতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। খুবই জঘন্য এক মনস্তত্ত্ব এই মিলের জন্য দায়ী। প্রশ্ন হচ্ছে- সেই মনস্তত্ত্বের বাইরে গিয়ে কি ক্রিকেট খেলা বা দেশে দেশে সংগঠিত কোনো খেলা উপভোগ করা সম্ভব? উত্তর যদি ‘না’ হয়, তাহলে খেলার সাথে রাজনীতি না মেলানোর কথা বলে উচ্চ শিক্ষিতরা আসলে কী বোঝাতে চায়?
তার চেয়ে বড় কথা এই খেলাগুলো আসলে এখন কতটুকু খেলা? শত শত কোটি টাকা লগ্নি থাকে এখানে এবং দিন শেষে হিসেব হচ্ছে কত লাভ বা লোকসান হল। খেলার গুরুত্ব নির্ভর করে কত বেশি মানুষে খেলা দেখে তার উপর। অনেক বেশি মানুষে খেলা না দেখলে আয়োজন লাভজনক হবে না, কারণ, টাকা দিচ্ছে বিজ্ঞাপন দাতারা, ফলে কত মানুষে তাদের বিজ্ঞাপন দেখল সেটি মূখ্য বিষয়।
ক্রিকেট খেলা বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য উত্তম মঞ্চ। প্রতিটি ওভারে ফাঁকে একটি বা দুটি বিজ্ঞাপন দেখানো যায় এবং এ সময় কেউ চ্যানেল পরিবর্তন করে না। অতএব, বিজ্ঞাপনটি সবাই দেখে। এ বিজ্ঞাপনগুলো বহুজাতিক কোম্পানির। ফলে পৃথিবীর সকল দেশে তাদের ব্যবসায়ীক প্রচার হয়।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সেফি ফাইনালের তিনটি দেশই এবার উপমহাদেশের। ইতোমধ্যে ফাইনাল নিশ্চিত করেছে পাকিস্তান। ধারণা করা যায়, আজকে আম্পায়ারদের চেষ্টা থাকবে বাংলাদেশকে যেভাবে হোক হারানোর। হারাতে চাইবে অন্য কোনো কারণে নয়, শুধু ঐ ব্যবসায়ীক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। কারণ, যত বেশি লোক খেলা দেখবে পণ্যের প্রচার তত বেশি হবে। সেদিক থেকে বাংলাদেশ-পাকিস্তান খেলা হওয়ার চেয়ে ভারত-পাকিস্তান খেলা হলে বেশি লাভ।
এক্ষেত্রে আমার একটি অতি ভাবনা হয়, হয়ত ইল্যান্ড চায়ই না ফাইনাল খেলতে, বরং উন্নত দেশগুলো চায় ক্রিকেটটা বেশি বেশি এরাই খেলুক, এসব দেশের প্রায় দুইশো কোটি লোকের কাছে পণ্যের বার্তা পৌঁছে যাক। এটা হয়ত অতি ভাবনা, কিন্তু ক্রিকেট খেলাটা যে এখন আর খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সেটি স্পষ্ট। এবং সেখানে সবচে’ বেশি দায় ভারত এবং ইল্যান্ডের।
বড় বড় কোম্পানীর জন্য এটি পণ্য প্রচার মঞ্চ। আর সাধারণ সমর্থকদের জন্য খেলাটা এখন উদ্র জাতীয়তাবাদ ধারণ করার সুযোগ।
ক্রিকেট দিয়ে সাধারণ মানুষকে মুখে “লজেন্স চুষ” ধরিয়ে দিয়ে মাতিয়েও রাখা যায় খুব। এই যেমন আমরা এখন বধ করতে শুরু করেছি, নিউজিল্যান্ড বধ করলাম, আজকে ভারত বধ করব, ফাইনালে পাকিস্তান।
ছা পোষা মানুষের সামনে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের সামনে নানান ধরনের ফানুস থাকে, তার মধ্যে এখন ক্রিকেট অন্যতম।
এগারো জন মাঠে খেলে জিতলে ভালো হয়, দেশের নাম হয়, (যদিও কাম বিশেষ কিছু হয় না) কিন্তু মেতে থাকে যে খেয়ে না খেয়ে এগারো কোটি মানুষ!
এই মাতলামি মাঝে মাঝে সভ্যতা-ভব্যতা-শালীনতা সবকিছু ছাড়িয়ে যায়। কাজ তো অবশ্যই বাদ, এমনকি বাচ্চার অসুস্থতার চেয়েও শত্রু ‘বধ’ করার জন্য জিভের সকল প্রকার ব্যবহার করা বেশি অত্যাবশ্যকীয় হয়ে যায়।
তারপরেও ভালো যে ধর্ম ধর্ম করে মাতাল হওয়ার চেয়ে ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকা ভালো। কিন্তু সেখানেও তো ধর্ম, সম্প্রদায়, সেই একই হিসেব নিকেষ- সেই হিসেব থেকেই এখন দুই দেশে চলছে এত জোস। দেখে মনে হয়, সুযোগ পেলে এটা খেলা থাকত না, এইসব সমর্থকরা রক্তাক্ত করত একে অপরকে।
পাহাড়ে যে দর্শন থেকে আগুন জ্বলে সেই একই দর্শন এভাবে যুদ্ধংদেহী হয়ে ক্রিকেটে সমর্থন করায়। নইলে ‘ভারত-পাকিস্তান’ এবং ‘বাংলাদেশ-ভারত’ ক্রিকেট ম্যাচের আলাদা কোনো মাহাত্ম কেন থাকবে?
যদিও এখন থাকে, পৃথিবীরে সব প্রান্তের খেলা নিয়েই এখন সামাজিক-রাজনৈতিক সব ধরনের হিসেব-নিকেষ থাকে। তাই কেউ যখন বলে, ক্রিকেট তো ক্রিকেট, তখন সে না বুঝে বলে, শিক্ষতরা তাদের সাম্প্রদায়ীক আবেগ আড়াল করে।
আমাদের দেশে ক্রিকেট সমর্থন আওয়ামীলীগ বিএনপি কে সমর্থন করার মতই, আমাদের দেশে এটা স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তিরও সমীকরণ, কীভাবে অন্যসব হিসেব ছাপিয়ে যায় সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় পরিচয় সেটিও উপমহাদেশের, বিশেষ করে ভারত এবং বাংলাদেশের মানুষের ক্রিকেট সমর্থনের মধ্য দিয়ে প্রতিভাত হয়।
যাইহোক, তারপরেও আমরা খেলা দেখতে চাই, খেলা উপভোগ করতে চাই অন্তর্নিহীত এসব বুঝতে না চেয়ে। এই ‘বুঝতে না চাওয়া’র মধ্যেই সাধারণ মানুষের সৌন্দর্য এবং সরলতা, সেটিই আবার অজ্ঞতা, কখনো তা নৃশংসতা।