সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার রতনকান্দি একটি একটি অসাম্প্রদায়িক গ্রাম। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এই গ্রামের নেতৃস্থানীয় মুসলমানেরা সকলকে ডেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন— যেন কোনোভাবেই হিন্দুদের বাড়িতে আক্রমণ না হয়। হিন্দুদের কোনো প্রকার ক্ষতি না হয়। তাদের কাছে হিন্দুরা ছিলো আমানতের মতো। ফলে গ্রুপ করে করে হিন্দুদের বাড়িগুলো পাহারা দিয়েছিলো গ্রামের মুসলমানেরা। আমি নিজে যেমন এই গ্রামের বাসিন্দা হয়ে গ্রামটিকে দেখেছি, পাশাপাশি আমার স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যালের কাছ থেকে শুনেছি এই গ্রামের ইতিহাস।
বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল বলেন, “আমার বাবা ছিলেন একজন ধর্মগুরু। রতনকান্দি, পোরজনা, জামিরতা, বাচড়া, নন্দলালপুর ও অন্যান্য গ্রামের মানুষ তাকে এক নামে চিনতো। দীক্ষা ও পূজা-অর্চনার আয়োজন হলেই দূর-দূরান্ত থেকে ডাক আসতো তার। বাবার সঙ্গে তখন মাঝেমধ্যে আমিও যেতাম। আমার ছোটবেলাটা ছিলো অন্যরকম। বাল্যবন্ধু আব্দুল মজিদ সরকার, গোলাম মাহবুব নান্নু, ননী গোপাল সরকার ও আবুল কালাম আজাদ প্রমুখের সঙ্গে সারাদিন কাটাতাম। লেখাপড়ায় তেমন মনোযোগী ছিলাম না। লেখাপড়ার পাশাপাশি ব্যস্ত থেকেছি খেলাধুলা নিয়েও। ফুটবল, লাটিম আর ছিলো মার্বেল খেলা। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদীতে দলবেধে সাঁতার কাটতাম। মাঝেমধ্যে গ্রামের পাশেই দলবেধে পিকনিক করতে যেতাম। এসব স্মৃতি মনে হলে এখনও আনমনা হয়ে যাই। আমার প্রাথমিক শিক্ষা হয়েছে রতনকান্দি মধ্যপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তখন প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি ছিলো না।”
“স্কুলের শিক্ষকদের আন্তরিকতা ও ভালোবাসার কথা খুব মনে পড়ে। দায়িত্ব নিয়ে পড়াতেন তারা। প্রাইমারি স্কুলে আব্দুল লতিফ ও হোসাইন মোহাম্মদ স্যার ছিলেন সকলেরই প্রিয়। বড় ভাই দেবেন্দ্রনাথ সান্যাল ছিলেন রতনকান্দি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা-প্রধান শিক্ষক। ভাই হলেও এতটুকু ছাড় দিতেন না তিনি। সেখানে ছিলেন মাওলানা রফিকুল্লাহ, মোহাম্মদ শাহ আলম ও অন্যান্য স্যার। তারা খুব স্নেহ করতেন আমাদের। শিক্ষকরা তখন ছাত্রদের মন থেকেই ভালোবাসতেন। ফলে তারা আমাদের মনের ভেতর এখনো জায়গা করে আছেন। অধিকাংশ শিক্ষকের মধ্যে এখন তো সেটা পাওয়া যায় না। অধিকাংশ শিক্ষক এখন টাকা উপার্জনে ব্যস্ত বেশি। ছাত্রদের প্রতি দায়িত্ব ও ভালোবাসা শিক্ষকদের মাঝে আগের মতো নেই।”
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, “গ্রামে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ ছিলো না। বরং আমাদের গ্রামটা ছিলো ঐতিহ্যবাহী অসাম্প্রদায়িক গ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গ্রামের মুসলমানেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যেনো কোনোভাবেই হিন্দুদের বাড়িতে আক্রমণ না হয়। তাদের কোনও প্রকার ক্ষতি না হয়। তাদের কাছে হিন্দুরা ছিলো আমানতের মতো। ফলে গ্রুপ করে করে হিন্দুদের বাড়িগুলো পাহারা দিয়েছেন গ্রামের মুসলমানেরা। কোনো কোনো রাতে আমরা মুসলমানদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে থাকতাম। তারা বাইরে থেকে আমদেরকে ঘরে আশ্রয় দিতেন। এ কারণে অত্যাচার ও নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়নি হিন্দুদের। আবার একাত্তরে গ্রামের একজন মানুষও পিস কমিটি বা রাজাকারে যুক্ত হয়নি। এটাও ছিলো আমাদের জন্য গর্বের বিষয়।
শৈশব ও কৈশোরের নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার রতনকান্দি গ্রামে। দ্বিজেন্দ্রনাথ সান্যাল ও নিলীমা সান্যালের তৃতীয় সন্তান দেবেশ চন্দ্র সান্যাল। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি রতনকান্দি প্রাইমারি স্কুলে। পঞ্চম শ্রেণি পাসের পর ভর্তি হন রতনকান্দি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। একাত্তরে তিনি ছিলেন ওই স্কুলেরই অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।
যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন
দেবেশ চন্দ্র সান্যালরা দেশের খবর জেনে নিতেন বড়দের নানা আলোচনা থেকে। ১৯৭০ সাল, আন্দোলন চলছে সারাদেশে। চায়ের দোকানে মানুষ বলাবলি করত– দেশের অবস্থা ভালো না। যারা ঢাকা থাকতেন তারা গ্রামে ফিরলে তাদের মুখেও শুনেছেন আন্দোলন-সংগ্রামের ঘটনা। ওসব কথা দেবেশের কিশোর মনকে খুব ভাবাতো।
১৯৭০ সাল, ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি সামরিক সরকার। দেবেশদের আসনে (শাহজাদপুর) এমএনএ প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগের সৈয়দ হোসেন মনসুর তারা মিয়া। তার প্রতিপক্ষ ছিলেন জামায়াতে ইসলামের ব্যারিস্টার কোরবান আলী। সে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজ এলাকায় গড়ে তোলে রাজাকার বাহিনী। গ্রামে ছিলো রাজাকার ক্যাম্প। এমপিএ পদে দাঁড়ান আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট জনাব আব্দুর রহমান। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মুসলীম লীগের মাওলানা ছাইফুদ্দিন এহিয়া খান মজলিশ। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীই বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন।
পাকিস্তানি জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের ১৬৭টির অধিকারী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে সারাদেশে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ক্ষমতা দিতে টালবাহান করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ফলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু নানা নির্দেশনা দিয়ে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন ঢাকা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে)। দেবেশরা এসব শোনেন ঢাকা যাতায়াত করা লোকজন ও চাকরিজীবিদের কাছ থেকে। বঙ্গবন্ধু বললেন, “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো … এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম …। বঙ্গবন্ধুর ওই কথাগুলোই দেবেশের কিশোর মনে দাগ কাটে। দেশকে শক্রমুক্ত করার শপথ নেন তিনি।
এরপর কী ঘটলো?
প্রসঙ্গক্রমে দেবেশ চন্দ্র সান্যাল বলেন, “২৫মার্চ, ১৯৭১ এর কালোরাতে ঢাকায় শুরু হয় গণহত্যা। ২৮ মার্চ কিছু সময়ের জন্য কারফিউ উঠলে ঢাকা থেকে অনেকেই চলে আসেন গ্রামে। তাদের মুখেই শুনি গণহত্যার খবর। কিন্তু তখনও আর্মিরা সিরাজগঞ্জে আসেনি। এপ্রিলের ঘটনা। সিরাজগঞ্জের এসডিওর সহযোগিতায় আওয়ামী লীগের নেতা এমপিএ জনাব আব্দুল রহমান, আব্দুল লতিফ মির্জা, ছুটিতে আসা বাঙালি সৈন্য, ইপিআর, আনসার ও অন্যান্যদের একটি গ্রুপ নদীর উত্তর পাড়ে বাঘাবাড়ি বন্দরে প্রতিরোধ গড়ে। তারা নদীর পাড়ে বাঙ্কার করে অবস্থান নেয়। যাতে পাকিস্তানি সেনারা নদীপথে সিরাজগঞ্জে ঢুকতে না পারে। কিন্তু ওদের ভারী অস্ত্রের মুখে তারা টিকতে পারে না। ঈশ্বরদী হয়ে ট্রেন পথে, বগুড়া হয়ে সড়কপথে ২৭ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা শাহজাদপুর ঢুকে থানায় ক্যাম্প করে। তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে শান্তি কমিটির নেতারা। শাহজাদপুরে শান্তি কমিটির নেতা মাওলানা ছাইফুদ্দিন এহিয়া খান মজলিশ ও ব্যরিস্টার কোরবান আলী ছাড়াও আরো অনেকে। ওরা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং হিন্দুদের ওপর অত্যাচার ও তাণ্ডব চালায়। শাহজাদপুর সদরে গৌরকুণ্ডু, প্রাণগোপাল সাহার বাড়ি ছাড়াও বিভিন্ন হিন্দু বাড়িতে লুটতরাজ শুরু করে। তারা দাঁড়িয়ে থেকে বিভিন্ন খারাপ লোক দিয়ে লুটতরাজ করায়। বিভিন্ন দোকান ও বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করে। আর্মিরা একদিন আমাদের গ্রামের বাজারে এসেও তাণ্ডব চালায়। এরপরই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কথা ভাবতে থাকি।”
জুলাই ৭১-এর শেষের দিকের কথা। দেবেশরা খবর পান, এক রাতে রতনকান্দি ঘাট থেকে নৌকা ছাড়বে। যারা মুক্তিযুদ্ধে যেতে চায় তারা সেখানে একত্রিত হবে। কাউকে কিছু না জানিয়ে কিশোর দেবেশও ওই ঘাটে হাজির হন। ওখানে আসেন আমাদের গ্রামের সুনিল কুমার রায়, বাচরা গ্রামের আব্দুল ওহাব, শাহজাদপুরের আব্দুর রাজ্জাকসহ প্রায় ২২ জন। মূলত এমপিএ অ্যাডভোকেট আব্দুর রহমানের নেতৃত্বেই ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে যান তারা। রাতে নৌকা ছেড়ে বিভিন্ন ঘাট হয়ে তারা চলে যান পাবনার সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া নামক গ্রামে। পরে আরেক নৌকায় পদ্মা নদী পার হয়ে আসেন কুষ্টিয়া জেলার একটি নিভৃত গ্রামে। এক বাড়িতে আশ্রয় নেন। খাওয়া-দাওয়া করে ওই রাতেই হেঁটে ঢোকেন ভারতে।
বাকী ইতিহাস শুনি দেবেশের মুখে। তার ভাষায়— “মেঘাচ্ছন্ন রাত। গুড়িগুড়ি বৃষ্টিও হচ্ছিলো। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে আমরা পথ চলি। ভারতের জলঙ্গি বর্ডার পার হয়ে ঢুকি ভারতের একটি বিএসএফ ক্যাম্পে। সেখান থেকে মালদহতে প্রথম যাই। সেখান থেকে যাই কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে। বয়স কম হওয়ায় আমাকে প্রথম ভর্তি করতে চায়নি। মালঞ্চ (কুড়মাইল) ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন বেড়া-সাঁথিয়ার এমএনএ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ। যুদ্ধে যাওয়ার প্রবল আগ্রহ ছিলো আমার। তা দেখে আমাকে নিতে সুপারিশ করেন অধ্যাপক আবু সাইয়িদ সাহেব। এভাবেই ভর্তি হই কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে।”
‘‘তখন আমি রতনকান্দি আদর্শ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। বয়সের কারণে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটমেন্ট দল আমাকে ভর্তি করতে চাইছিলো না। পরে সকলের অনুরোধে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ পাই। প্রথমে ভারতে কামারপাড়া যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হই। এরপর কামারপাড়া, কুড়মাইল, মালঞ্চ, প্রতিরামপুর ও শিলিগুড়ির পানিঘাটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। আমার ভারতীয় প্রশিক্ষণ এফএফ নম্বর ৪৭৪২। আমি ৭ নম্বর সেক্টরের হেড কোয়ার্টার— ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র নিয়ে একটি গ্রুপের সদস্য হিসেবে মানিকার চর, রৌমারী হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসি। ৭ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল (অব.) কাজী নূরুজ্জামান। তার গ্রুপের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন এমএ মান্নান। আমার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে রাজাকারদের আলটিমেটামে জীবনের নিরাপত্তার জন্য গোটা পরিবারকেই বাড়িঘর সব ফেলে ভারতের আসামের মানিকার চর শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে হয়েছিলো। গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে আমি বিভিন্ন গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। আমার অংশগ্রহণ করা ভয়াবহ যুদ্ধগুলোর মধ্যে (১) বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধ, (২) কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে স্টেশন ব্রিজ সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্প অ্যাম্বুস, (৩) কল্যাণপুর যুদ্ধ ও (৪) শাহজাদপুর উপজেলার ধীতপুর নামক স্থানে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ অন্যতম। আমি যুদ্ধে ছিলাম এক অকুতোভয় দুঃসাহসী কিশোর। পরে আমি অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি পাই। আমার নাম শুনলে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারেরা আঁতকে উঠতো। আমার অসম সাহসিকতার জন্য স্থানীয় লোকেরা আমাকে ‘বিচ্ছু বাহিনী’র নেতা বলে সম্বোধন করতো। যুদ্ধে আমার কোনো মৃত্যু ভয় ছিলো না। আমি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনি দিয়ে পাকিস্তানি হায়েনা সৈন্য ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।’’
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী ও কথা সাহিত্যিক।
লেখক পরিচিতি ঃ নিভা রানী সান্যাল; স্বামী ঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল; বর্তমান নিবাস ঃ মহল্লা ঘোষগাঁতী; পৌরসভা, ডাকঘর ও উপজেলা ঃ উল্লাপাড়া; জেলা ঃ সিরাজগঞ্জ।