১ ডিসেম্বর (২০২০) বিকেল ৩টায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী, ধর্মীয়, জাতিগত, শিশু, কিশোর, ছাত্র, যুব, নারী সংগঠন এবং রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পরিবারের ৬০টি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য এবং সংবিধানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির ধৃষ্টতাপূর্ণ হুমকির প্রতিবাদে স্বাধীনতা চত্বর (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঘিরে এক মহা মানববন্ধন কর্মসূচীর আয়োজন করে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বানে এই মানববন্ধন কর্মসূচী একই সময়ে সারা দেশে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে পালন করা হয়। ঢাকায় মৎস ভবন থেকে আরম্ভ করে এই মানববন্ধন ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউট, শাহবাগ ও টিএসসি হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরে অবস্থান করে। মানববন্ধন ও সমাবেশের মূল দাবী হচ্ছে— অবিলম্বে জাতির পিতা এবং বাংলাদেশের সংবিধান অবমাননাকারী মামুনুল-বাবুনগরী গংকে গ্রেফতার করতে হবে এবং বাংলাদশে জামায়াত-হেফাজতের মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক-সন্ত্রাসী রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।
উদ্যানের চারপাশ ঘিরে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অংশগ্রহণ করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) শফিউল্লাহ বীরউত্তম, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান এমপি, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মাণিক, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের সভাপতি রামেন্দু মজুমদার, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব উদ্দিন বীর বিক্রম, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান নূর এমপি, রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ-এর আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক আবেদ খান, নির্মূল কমিটির সহ সভাপতি ও গণহত্যা জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, চলচ্চিত্র নির্মাতা, নাট্যনির্দেশক মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক নিমচন্দ্র ভৌমিক, বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের মহাসচিব ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালযের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য কামরুল হাসান খান, জাসদের সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ শিরীন আখতার, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ, সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজল দেবনাথ, বাংলাদেশ কবিতা পরিষদের সভাপতি মুহাম্মদ সামাদ, নির্মূল কমিটির সহ সভাপতি ও শিক্ষাবিদ শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল, যুগ্ম সম্পাদক শহীদ সন্তান নূজহাত চৌধুরী শম্পা, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, চিকিৎসা সহায়ক কমিটির সভাপতি ডা: উত্তম বড়ুয়া, সাধারণ সম্পাদক ডা: মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল, বাংলাদেশ যুবলীগের সভাপতি শেখ ফজলে শামস পরশ, সমাজকর্মী আরমা দত্ত এমপি, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ-এর সভাপতি রোকেয়া কবির, প্রজন্ম-৭১-এর সভাপতি শহীদ সন্তান আসিফ মুনীর তন্ময়, নির্মূল কমিটির সদস্য ও অভিনেত্রী শমি কায়সার প্রমুখ।
সভা থেকে সাম্প্রদায়িক সংগঠন হিসেবে হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াতের মৌলবাদী রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। বলেছেন, আজকে যারা নতুন করে বাংলাদেশের অস্তিত্বে হুমকি দিচ্ছে, যারা মসজিদের ভেতরে মানুষ পুড়িয়ে মারছে, তাদের যথাযোগ্য শাস্তি নিশ্চিতে সরকারকে বাধ্য করা হবে। আর ’৭১-এর পরাজিত শত্রুরাই দেশকে পাকিস্তান-আফগানিস্তান বানাতে ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করছে। সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য কোন অবস্থাতেই সফল হতে দেয়া যাবে না। এজন্য মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
সমাবেশে বক্তারা আরো বলেন, ভাস্কর্য একটি দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অংশ। সৌদি আরব, তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়াসহ পৃথিবীর সব মুসলিম দেশেই ভাস্কর্য আছে। কিন্তু বাংলাদেশে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘একটি গোষ্ঠী’ ভাস্কর্যবিরোধী ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্য দিচ্ছে। এই গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। এটি চরম ধৃষ্টতা ও জাতির পিতা, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবমাননা। এই গোষ্ঠীকে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। তারপরও তারা যদি ধৃষ্টতা দেখায়, তবে তাদের এর পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার ভাস্কর্য সম্পর্কে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, তার প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভ জানানোর কোনো ভাষা খোঁজে পাচ্ছি না। তারাই এ কাজ করছে যারা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় বলেছে “বাংলা” ইসলামের ভাষা নয়, ১৯৫৪-এর নির্বাচনের সময় বলেছে যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিলে স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। তারাই ১৯৭০-এর নির্বাচনে ইসলামকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে বাংলার মুক্তিকামী মানুষকে ঠেকাতে চেয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছে।’ এদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান মন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতাকারীদের ‘আস্ফালন’ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে মোজাম্মেল হক বলেন, আস্ফালন বন্ধ করুন, না হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ রাজপথেই এর জবাব দেবে, যার পরিণাম ভালো হবে না। আর ধৃষ্টতা দেখালে পরিণামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
সমাবেশ পরিচালনাকালে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, প্রখ্যাত লেখক সাংবাদিক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াত সমর্থিত হেফাজত-খেলাফতের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক নেতারা যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, সেগুলো সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চরম অবমাননা ছাড়া কিছুই নয়। যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গার হুমকি দেন, তারা দেশকে মোল্লা উমরের আফগানিস্তান এবং জিয়াউল হকের পাকিস্তান বানাতে চান। আমরা তাদের এসব বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ এবং মৌলবাদীদের গ্রেফতার করে শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, মৌলবাদীরা মনে করেছেন, করোনার কারণে আমরা মনে হয় হারিয়ে গেছি। কিন্তু মনে রাখা দরকার, আমরা হারিয়ে যাইনি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তি ঐক্যবদ্ধ আছে। যারা ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিতে চান, তারাই বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে যাবেন। মেয়র বলেন, সারা বিশ্বে সব দেশেই তাদের জাতির পিতার ভাস্কর্য আছে। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন কেউ ঠেকাতে পারবে না। অবিলম্বে পদ্মা সেতুর পার হয়ে বঙ্গবন্ধুর বিশাল ভাস্কর্য স্থাপিত হবে, হবেই। কেউ বাধা দিতে এলে আমরা বসে থাকব না।
সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, যারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে, তারাই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা এখনো বেঁচে আছেন।
কর্মসূচিতে সংহতি জানান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি বলেন, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়াতেও ভাস্কর্য আছে। ভাস্কর্য ও মূর্তির পার্থক্য বালকও বোঝে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য হবে কেউ ঠেকাতে পারবে না ঘোষণা দিয়ে মেয়র বলেন, ধর্ম ব্যবসায়ীরাই এর বিরোধিতা করছে। ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি।’
দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলনের সভাপতি, নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মাণিক বলেন, রাজাকার মামুনুল হক, রাজাকার পীর চরমোনাই, রাজাকার বাবুনগরী তোমরা এসে দেখে যাও বাংলার মুক্তিকামী মানুষেরা আজ একত্রিত হয়েছে তোমাদের বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়ার জন্য। তোমাদের স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হচ্ছি— তোমরা কি ভুলে গেছো ২০১৩-এর ৫ মে-এর কথা, সেদিন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের পর তোমরা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। আবার যদি তোমরা শাপলা চত্বরমুখী হওয়ার চেষ্টা করো তাহলে তোমাদের হাত-পা-মাথা ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া হবে। তোমরা যদি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ মানতে না পারো তাহলে তোমরা পাকিস্তান চলে যাও। মনে রেখো— পাকিস্তানও তোমাদের নেবে না। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের সংবিধান একইসূত্রে গাঁথা। আমি সরকারের কাছে আবেদন জানাবো— এইসব রাজাকারদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অবিলম্বের গ্রেফতার করা হোক।
পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের মহাসচিব ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য কামরুল হাসান খান বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বারবার ষড়যন্ত্র করেছে, এখন আবার ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না।
জাসদের সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ শিরীন আখতার বলেন, যারা ষড়যন্ত্র করছে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। তারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে। এই ব্যবসায়ীদের বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে মারা হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা এখনো জীবিত আছি। মৌলবাদী শক্তিকে যে করেই হোক প্রতিহত করতে হবে। বাংলাদেশে তাদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।
বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, জাতির পিতাকে যারা অবমাননা করছে, তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে। জাতির পিতার ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলে নদীতে ছুড়ে ফেলার মতো ধৃষ্টতা তারা দেখিয়েছে। তারা কোন অবস্থাতেই ভাস্কর্য করতে দেবে না বলেছে। কারা বলছে? তারা কারা? তারা হচ্ছে একাত্তরের পরাজিত সৈনিক, একাত্তরের পরাজিত শত্রু, তাদেরই উত্তরসূরি, একেবারেই তাদের প্রতীকী রূপ।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ বলেন, আমরা মনে করি, ভাস্কর্যের সঙ্গে ধর্মের কোন বিরোধ নেই। কাজেই যারা বাংলাদেশে ভাস্কর্যের সঙ্গে ধর্মের সাংঘর্ষিক অবস্থান তৈরি করছে, এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমরা দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করার সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
মৌলবাদের আস্ফালন রুখতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব শক্তিকে একতাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব। তিনি বলেন, তারা এত বছর ধরে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে, মানুষকে ভুল বুঝিয়ে এসেছে। এটা স্পষ্টভাবেই বলতে চাই, তারা বাংলাদেশকে একটা তালেবানী রাষ্ট্র করতে চায়। যে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে, সেই বাংলাদেশ কখনও পাকিস্তানী, আফগানিস্তানী বা তালেবানী রাষ্ট্র হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর এই ধরনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে একত্রিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজল দেবনাথ বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার নামে সাম্প্রদায়িক মহল দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির যে চেষ্টাটি করছে, এটি শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ভাস্কর্য এবং মূর্তির মধ্যে যেভাবে পার্থক্য করা হচ্ছে সেটিও কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না।
বাংলাদেশ কবিতা পরিষদের সভাপতি মুহাম্মদ সামাদ বলেন, আজকে যে অন্ধ মৌলবাদী শক্তি ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছে, তাদের শুধু পুলিশী ব্যবস্থায় শাস্তি দিলেই হবে না, তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সচেতন করে তুলতে হবে, যেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো অক্ষয় থাকে।
নির্মূল কমিটির চিকিৎসা সহায়তা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা: উত্তম বড়ুয়া বলেন, ভাস্কর্য হাজার বছরের ঐতিহ্যের সাক্ষী, ভাস্কর্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ইতিহাস তুলে ধরে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য মানে বাংলাদেশ, যারা এই ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে কথা বলে আজকে বাংলাদেশকে নতুন করে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে আমরা নাগরিক সমাজ নতুন প্রজন্মকে সাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের দাঁতবাঙা জবাব দিতে চাই। প্রয়োজনে আমরা নতুন করে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শুরু করব।
সমাবেশ শেষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে দিনের কর্মসূচি শেষ হয়। তবে এমন প্রতিবাদী কর্মসূচি বিজয়ের মাসজুড়ে চলবে বলে আয়োজকেরা জানিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ৬০টি সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত এ কর্মসূচী থেকে সাত দফা দাবির ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। মানববন্ধন ও সমাবেশে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবেদ খান। এতে বলা হয়,
১. অবিলম্বে জাতির পিতা এবং বাংলাদেশের সংবিধান অবমাননাকারী মামুনুল-বাবুনগরী গংকে গ্রেফতার করতে হবে এবং করোনা মহামারীকালে স্বাস্থ্যবিধি লংঘনকারী সবরকম সমাবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে।
২. ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার জন্য এবং ধর্মের নামে যাবতীয় হত্যা ও সন্ত্রাস বন্ধের উদ্দেশ্যে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে লেখা সংবিধানে বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বপ্রদানকারী তার সহযোগীরা ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। আমরা সরকারের নিকট দাবি জানাচ্ছি— অবিলম্বে বাংলাদশে জামায়াত-হেফাজতের মৌলবাদী-সা¤প্রদায়িক-সন্ত্রাসী রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।
৩. বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ মাহফিল ও খুৎবার নামে ভিন্নধর্ম, ভিন্নমত, নারী এবং ভিন্ন জীবনধারায় বিশ্বাসীদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রচারকারী ও হুমকিপ্রদানকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
৪. সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, চেতনা এবং জাতির পিতার জীবন ও দর্শন পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৫. মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা অস্বীকারকারীদের শাস্তির জন্য কার্যকর আইন দ্রুত পাশ করুন। ১ ডিসেম্বর জাতীয়ভাবে ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ পালনের ঘোষণা দিন।
৬. অবিলম্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষানীতি, নারীনীতি, সংস্কৃতিনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
৭. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশ, জাতি, সংবিধান এবং জাতির পিতার বিরুদ্ধে বিষোদগারকারীদের কঠোর শাস্তি প্রদান করতে হবে।
আমরা ২০২০ সালে মুজিববর্ষে এই বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নাগরিক সমাজের নিকট আহ্বন জানাচ্ছি– ৩০ লক্ষ শহীদের স্বপ্ন এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অসাম্প্রদায়িক কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ ও জাতিবিরোধী মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস প্রতিহত করুন। সমমনা সকল সামাজিক-সাংস্কৃতিক-নাগরিক সংগঠনকে নিয়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করুন।
মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী সংগঠনসমূহের মধ্যে রয়েছে, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ৭১, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এসোসিয়েশন, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, প্রজন্ম ’৭১, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ, ইতিহাস সম্মিলনী, জাতীয় কবিতা পরিষদ, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ, বাংলাদেশ গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা, বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু গবেষণা সংসদ, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ), জাতীয় যুব জোট, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ কেন্দ্র, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলন, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ, ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন জাতীয় কমিটি, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধ সংহতি পরিষদ, বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ), বাংলাদেশ ফার্মাসিস্ট ফোরাম, গৌরব ’৭১, অপরাজেয় বাংলা, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার, কর্মজীবী নারী, জাতীয় নারী জোট, নারী মুক্তি সংসদ, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, শেখ রাসেল ফাউন্ডেশন ইউএসএ (বাংলাদেশ চাপ্টার), জঙ্গীবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ মোর্চা, সেকুলার ইউনিটি বাংলাদেশ, ইউথ ফর ডেমোক্রেসি এন্ড ডেভলপমেন্ট, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ, ঘাসফুল শিশু কিশোর সংগঠন, বাংলাদেশ মানবাধিকার আন্দোলন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন বাংলাদেশ। এছাড়াও অনেক সংগঠন স্বতস্ফুর্তভাবে জঙ্গি-মৌলবাদবিরোধী এই মানববন্ধন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করে।