কিডনি ও হৃদরোগের জটিলতা নিয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার দুপুরে তার মৃত্যু হয়। সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়ভাষিণীর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী সহ দেশের সর্ব স্তরের মানুষ।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মেয়ে ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী জানান, ২০১৭ নভেম্বরে বাথরুমে পড়ে গোড়ালিতে চোট পান তাঁর মা। হাসপাতালে ভর্তি করার পর হার্ট অ্যাটাক হলে প্রিয়ভাষিণীর হৃদযন্ত্রে স্থায়ীভাবে পেসমেকার বসাতে হয়।
এরপর গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে আবারও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ভর্তি করা হয় ল্যাব এইড হাসপাতালে। সেখানে কিছুদিন চিকিৎসার পর গত ২২ ফেব্রুয়ারি আবারও তাকে ওই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।
ফুলেশ্বরী জানান, কয়েক দিন আগে তাঁর মায়ের গোড়ালিতে অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু রক্তচাপ ঠিক থাকছিল না। মঙ্গলবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে তাকে ল্যাবএইডের সিসিইউতে নেওয়া হয়।
বেলা পৌনে ১টার দিকে সেখানেই তার মৃত্যু হয় জানিয়ে ল্যাবএইডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক সাইফুর রহমান লেনিন বলেন, “পৌনে এক ঘণ্টা চিকিৎসকরা নানাভাবে চেষ্টা করেন, সবকিছুই ব্যর্থ হয়ে যায়।”
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হতে হয় এই বীর নারীকে। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদানের জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মুক্তিযোদ্ধা খেতাব দেয়। তার আগে ২০১০ সালে তিনি পান স্বাধীনতা পুরস্কার।
যুদ্ধদিনের সেই ‘ভয়াবহ’ অভিজ্ঞতা স্মরণ করে ২০১৫ সালে তিনি বলেছিলেন, “১৯৭১ সালে আমি খুলনা ছিলাম। অক্টোবরের শেষের দিকে আমাকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়…৩২ ঘণ্টা আমাকে আটকে রাখা হয়েছিল। এমন কোনো নির্যাতন নেই, যা তারা করেনি। আমার জীবনে সে এক দুঃসহ স্মৃতি।”
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে সরকারি কর্মকর্তা আহসান উল্লাহর সঙ্গে নতুন করে সংসার শুরু করেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। এর আগে কৈশোরে তাঁর বিয়ে হয়েছিল—বিষয়টিকে তিনি কৈশোরের ভুল হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তার ছয় সন্তান কারু তিতাস, কাজী মহম্মদ নাসের, কাজী মহম্মদ শাকের (তূর্য্য), তিন মেয়ে-রাজেশ্বরী প্রিয়রঞ্জিনী, রত্নেশ্বরী প্রিয়দর্শিনী ও ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী।
এক সময় তিনি মন দেন শিল্পের সাধনায়। ঝরা পাতা, শুকনো ডাল, গাছের গুঁড়ি দিয়ে তার তৈরি গৃহসজ্জার উপকরণ ও শিল্পকর্ম তাকে ধীরে ধীরে করে তোলে ভাস্কর।
প্রিয়ভাষিণীর প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনী হয় যশোরে শিল্পকলা একাডেমিতে। চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন।
তাঁর মৃত্যুতে এক শোক বার্তায় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, “ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ছিলেন আমার সুহৃদ, বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর। তার প্রকৃতিনির্ভর বিভিন্ন শিল্পকর্ম শিল্পবোদ্ধাদের সহজেই আকৃষ্ট করে। বাংলাদেশের মানুষ এই মহান ভাস্করকে দীর্ঘদিন স্মরণে রাখবে।”
তার মৃত্যুর খবরে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির চেয়ারম্যান শাহরিয়ার কবির, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি মুহম্মদ সামাদ, চিত্রশিল্পী মনিরুজ্জামান ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধি ও অধিকারকর্মীদের অনেকেই ছুটে যান হাসপাতালে।
কবি সামাদ জানান, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর ছোট ছেলে কাজী মহম্মদ শাকের তূর্য অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরবেন বুধবার। তিনি ফিরলে বৃহস্পতিবার সকালে শুরু হবে শেষযাত্রার আনুষ্ঠানিকতা।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় প্রিয়ভাষিণীর কফিন রাখা হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষ বিদায় জানানো হবে এই মুক্তিযোদ্ধাকে।
সেদিন দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজার পর বিকালে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে।
আর আগামী ১০ মার্চ বিকাল ৪টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর স্মরণে নাগরিক শোকসভার আয়োজন করবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট।
ছোট মেয়ে ফুলেশ্বরী হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, “আমার মা নিজের চেয়েও বেশি এ দেশকে ভালোবাসতেন। মৃত্যুর আগেও তিনি দেশের কথা বলে গেছেন। এ দেশের মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা নিয়ে তিনি চলে গেলেন।”
শাহরিয়ার কবির বলেন, “একাত্তরের পর সামাজিক নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অসম সাহসিকতা আর দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন। এই মুক্তিযোদ্ধা এক সময় ভাস্কর্য শিল্পের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির কথা তুলে ধরেছেন। তিনি আমাদের অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। অথচ তাঁর এই অবদানের স্বীকৃতির জন্য আমাদের দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়েছে।”
একাত্তরে নির্যাতিত নারীদের কষ্টের কথা প্রকাশে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর ‘অগ্রণী’ ভূমিকার কথা স্মরণ করে শাহরিয়ার কবির বলেন, “তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে একাত্তরের নির্যাতিত নারীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের সাহস যুগিয়েছেন। পরে আমরা একাত্তরের সেসব ঘটনার কথা ধারাবাহিকভাবে জানতে পারি। নীরবতার দেয়াল ভেঙে তাঁরা যে এগিয়ে এসেছেন, সেখানে রয়েছে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর বড় অবদান।”
খুশী কবিরের চোখে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ছিলেন ‘একাত্তরের প্রতীক’।
২০১৪ সালে একুশের বইমেলায় ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘নিন্দিত নন্দন’ প্রকাশিত হয়। স্বাধীনতা পদকের পাশাপাশি তিনি পেয়েছেন হিরো বাই দ্যা রিডার ডাইজেস্ট ম্যাগাজিন পদক,চাদেরনাথ পদক,অনন্য শীর্ষ পদক, রৌপ্য জয়ন্তী পুরস্কার (ওয়াইডব্লিউসিএ) এবং মানবাধিকার সংস্থা কর্তৃক মানবাধিকার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
“তিনি ছিলেন সবসময় হাসিখুশি উচ্ছ্বল মানুষ। নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পছন্দ করতেন। কাউকে উপকার করতে পারলে খুশি থাকতেন। ভেবেছিলেন-বলতেন একটি ধর্ম নিরপেক্ষ সমৃদ্ধ বাংলাদেশের কথা। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে গণমানুষের মাঝে স্থান করে নিয়েছেন। ভালোবাসার বিনাশ নেই, তাই তিনি বেঁচে থাকবেন চীরদিন।”