অর্পিত সম্পত্তির ইজারা (বা সেলামি) এক লাফে সাত গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশ ত্যাগ করেছে এক হিন্দু পরিবার। পুরান ঢাকার এই বাসিন্দার নাম রিংকু চৌধুরি। থাকতেন সূত্রাপুর থানার ১১ নং ঠাকুর দাস লেনের একটি বাসায়। বিগত কয়েক বছর অর্পিত সম্পত্তির ভাড়া দিতে পারেননি। অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না হওয়ার কারণে পরিবারটি কাউকে কিছু না বলে ভারতে চলে যায়। বর্তমানে তারা ভারতের বারাসাতে অবস্থান করছে।
রিংকু পরিবারের সদস্য সংখ্যা স্বামীসহ চারজন। এক ছেলে ও এক মেয়ের ভরণপোষণ ঠিক মতো করতে না পারার কারণে আগেই মেয়েকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ছেলেকে ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করায়। সংসারের টানাপড়েনে ছেলের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেনি। গত বছর বার্ষিক পরীক্ষায় রিংকুর ছেলে অংশগ্রহণ না করলে প্রতিবেশীরা জানতে পারে তাদের দেশত্যাগের খবর। এমন কথাই জানিয়েছে প্রতিবেশী মোস্তফার পরিবার। রিংকুর ছেলের সঙ্গে পড়ত মোস্তফার ছেলে।
সবাই জানে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুরা মুসলিমদের চাইতে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। যেসব অর্পিত সম্পত্তিতে হিন্দুরা ছিল তারা এখন পড়েছে মহা সংকটে। বছরে বর্ধিত ৭গুন ইজারা ভাড়া (সেলামি) দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারাও এসব সম্পত্তি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে চাইছে। আইনে আছে অর্পিত সম্পত্তিতে কেউ থাকতে না চাইলে তা ডিসিকে বুঝিয়ে দিতে হবে। প্রত্যেক জেলা উপজেলায় ডিসিদের অধীনে থাকে এসব সম্পত্তি। তারাই এসব সম্পত্তির দেখভাল করে থাকেন।
ঢাকার ডিসি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায় বেশ কয়েকবছর ধরে অর্পিত সম্পত্তির ইজারা আদায় বন্ধ রয়েছে। ৭ গুণ ভাড়া বৃদ্ধি সিদ্ধান্তের পর এই অচলা অবস্থার সৃষ্টি। বেশিরভাগ ইজারা গ্রহীতা আগের নিয়মে ভাড়া দেবার আবেদন করেছে। ডিসি অফিসে এসব আবেদন বছরের পর বছর জমে পাহাড় হয়েছে। কোনো আবেদনের জবাবই তারা দেয় না। ডিসি অফিসের এই নিষ্ক্রিয়তার কারণে অর্পিত সম্পত্তির অধিকাংশ ইজারা গ্রহীতা অবৈধ দখলদারে পরিণত হয়েছে।
এদিকে এই অচলা অবস্থার মধ্যে ডিসি অফিসের কতিপয় অসাধু কর্মচারী অন্য ব্যক্তিকে অর্পিত সম্পত্তির ইজারা দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। রিংকু চৌধুরির সম্পত্তি এখন দখল করে আছে দীপঙ্কর নামে এক ব্যক্তি। যার সঙ্গে রিংকু চৌধুরির কোনো পারিবারিক সম্পর্ক নেই।
এ বিষয়ে ঢাকার ডিসি শহীদুল আলমের(বর্তমানে অন্য ডিসি) সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, আমরা নতুন কাউকে ইজারা দেই না। যারা আগের ইজারা গ্রহীতা তাদের কেউ মারা গেলে তাদের পরিবারের সদস্যরাই ইজারা পান। যদি এই নিয়মের শর্ত ভঙ্গ হয় তাবে আমরা অবৈধ লোককে অর্পিত সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ করি।
ডিসি শহীদুল আলম বলেন, অনেকে বর্ধিত ভাড়া কিস্তিতে দিচ্ছেন। কেউ এক সঙ্গে দিচ্ছেন। তাকে প্রশ্ন করা হয়, এ পর্যন্ত কতজন নতুন বর্ধিত ভাড়া দিয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি কোনো ডেটা দিতে পারেননি।
যারা ভাড়া দিতে পারছে না তাদেরকে ডিসিরা উচ্ছেদ করবেন কিনা? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন মানবিক কারণে এটা তারা করতে যাচ্ছেন না। তবে ভাড়া আদায়ের জন্য একজন একজন করে ডাকা হবে বলে তিনি জানান।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ডিসি অফিসের লোকজন চেনেই না কে কার সম্পত্তিতে বসে আছে। এই না চেনার কারণে রিংকু চৌধুরি দেশ ত্যাগ করলে অন্য ব্যক্তির হাতে চলে যায় ওই সম্পত্তি। ডিসি অফিসের তালা সেখানে ঝুঁলেনি।
প্রসঙ্গত অর্পিত সম্পত্তি হচ্ছে সেই সব সম্পত্তি যার মালিক ছিল বাংলাদেশের হিন্দুরা। তাদের কেউ কেউ ভারত গেলে কিংবা গণহত্যার শিকার হয়ে অস্তিত্বহীন হলে সেগুলো পাকিস্তান ও পাকিস্তান পরবর্তী বাংলাদেশ সরকার প্রথমে শত্রু ও পরবর্তীতে অর্পিত সম্পত্তি নামে রেকর্ড করা হয়। পরে এসব সম্পত্তিতে বসবাসকারী লোকজনের কাছ থেকে সরকার এক সনা ইজারা প্রথা চালু করে অর্থ আদায় করে থাকেন। সম্প্রতি এই অর্থ আদায় কয়েকগুণ বাড়ানো হয়। এতে থমকে যায় সারাদেশে ভাড়া আদায়। বিষয়টির সঙ্গে সংখ্যালঘু শ্রেণির স্বার্থ জড়িত থাকায় বাংলাদেশের গণমাধ্যম এটা নিয়ে সরব নয়।