রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এটিএম এনামুল জহিরকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ইন্টার্নদের মারধরের ঘটনায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। গত শুক্রবার ‘রাবি শিক্ষককে ইন্টার্নদের মারধর’ শিরোনামে অনেক পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়। তবে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন না করায় সত্য আড়াল হয়।
গত বুধবার রাতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে চিকিৎসারত মেয়ের দেখতে যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক এনামুল জহির। রাত সাড়ে ১১টার দিকে মেয়ের ওষুধ নিয়ে ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে প্রবেশের সময় মেরি প্রিয়াঙ্কা নামের এক ইন্টার্ন চিকিৎসকের শরীরে ওই শিক্ষকের ধাক্কা লাগলে ঘটনার সূত্রপাত হয়।
প্রিয়াঙ্কা তাকে দেখে পথ চলতে বলেন। এ প্রেক্ষিতে এনামুল জহির প্রিয়াঙ্কাকে “ইউ ননসেন্স” বলে গালি দেন। অারও বলেন, “ফাক ইউ ফার্কি গার্ল, ডু ইউ নো হু আই এম?” এই ঘটনার পর প্রিয়াঙ্কা অন্য ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ফোনে ডেকে এনে ওই শিক্ষককে আটকে রাখেন।
পরে শিক্ষকের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় ইভ টিজিং-এর অভিযোগে অভিযুক্ত রাবীর এ শিক্ষককে। ঘটনা চুকেবুকে গেলেও এনামুল জহীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের উস্কে দেন, রাস্তা অবরোধ করান এবং বিভিন্ন পত্রিকায় মনগড়া রিপোর্ট করান বলে অভিযোগ করছেন রামেকের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা।
রাবীর আইন বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জনাব এনামুল জহীর মানসিকভাবে সুস্থ নন। তাকে অনেকে পাগলা শিক্ষক বলে জানে। তবে ওই বিভাগের কয়েকজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী বলছেন, “এনামুল জহীর জামাত শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি আসলে মানসিকভাবে অসুস্থ নন, বরং তিনি বিকৃত একজন মানুষ।”
১৯৮৮ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্রমৈত্রীর সাবেক সভাপতি জামিল আক্তার রতন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অন্যতম আসামি ছিলেন এটিএম এনামুল জহির। তার বাবা জেলা জজ হওয়ায় প্রভাব বিস্তার করে ওই শিক্ষক আশির দশকের সেই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন।
এ প্রসঙ্গে গত শুক্রবার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও যুক্তরাষ্ট্রের বল স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক রহমতউল্লাহ ইমন। তিনি লেখেন, ‘আমরা বলি কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন, এমনকি তিনি যদি হন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তবুও। আমি এমন শিক্ষকের কথা জানি যে, শিবিরের কিলিং টিমের প্রধান হিসেবে প্রকাশ্য দিবালোকে শিক্ষকদের সামনেই সতীর্থ একজন ছাত্রকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তারপর স্বৈরাচারী এরশাদের অনুগত এক জজ বাবার সন্তান হওয়ার সুবাদে হত্যা মামলা থেকে রেহাই পেয়ে বনে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। মানসিক বিকারগ্রস্ত, নির্যাতক এবং যেখানে-সেখানে সিন ক্রিয়েটকারী এসব মানুষের অপকর্মের দায়ভার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রী কেন বহন করবে?’
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস প্রমথেশ শীল লিখেছেন, “রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এটিএম এনামুল জহির রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শহীদ ডা. জামিল আখতার রতন হত্যা মামলার চার নম্বর আসামি। ইসলামি ছাত্রশিবিরের সাবেক সশস্ত্র ক্যাডার জহির ১৯৮৮ সালের ৩১ মে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গিয়েছিল ছাত্রমৈত্রীর সে সময়ের মেডিকেল কলেজের সভাপতি ডা. রতনকে হত্যা করতে। গত বুধবার রাতে ধাক্কা লাগার পর ডা. প্রিয়াঙ্কাকে জহির বলেছিল, ‘ফাক ইউ ফাকিং গার্ল, ডু ইউ নো, হু আই এম?”
খোলা কাগজ নামক একটি পত্রিকার বরাতে জানা যায়—
২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিমপাড়ায় ৭৪ নম্বর কোয়ার্টারে থাকতেন শিক্ষক এনামুল জহির। এর পাশের ৭২ নম্বর কোয়ার্টারে থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক মো. আফসার আলী। এনামুল জহির ওই এলাকার সব গাছ কেটে ফেলায় আফসার আলীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব বেঁধে যায়। পরে তিনি এনামুল জহিরকে মারধর করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য এম আবদুস সোবহানের প্রথম মেয়াদে (২০০৯-১৩) একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটির প্রধান ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুশফিক আহমদ। ওই কমিটির প্রতিবেদনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সিন্ডিকেট সভায় এনামুল জহিরকে ক্যাম্পাস থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। পরে অবশ্য তিনি আদালতের আদেশ নিয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থান করছেন।
ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের চিকিৎসক মাশিহুল আলম হোসেন থাকতেন পশ্চিমপাড়ায় এনামুল জহিরের ওপরের তলায়। শিক্ষক এনামুল জহির ওই চিকিৎসককে বন্দুক নিয়ে মারতে গিয়েছিলেন।
২০১৪ সালের ১০মে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গাছ থেকে বেল পাড়া নিয়ে মিন্টু নামের এক কর্মচারীকে ইট দিয়ে পিটিয়ে হাত ও মাথা থেঁতলে দেন এটিএম এনামুল জহির। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পশ্চিমপাড়ার কোয়ার্টারে এ ঘটনা ঘটে। এর আগে ২০১১ সালের ২৩ জানুয়ারি নিজের পোষা খরগোশ খেয়ে ফেলার অপরাধে অন্য শিক্ষকের ঘুমন্ত কুকুরের চোখ তুলে নিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একজন শিক্ষক, রিকশাচালকসহ একাধিকজনকে বিভিন্ন সময় মারধরের অভিযোগ রয়েছে। ওই শিক্ষক নিজের সন্তানের পায়ে শর্ট গান দিয়ে গুলি করেছিলেন। পরে নিজেই চাকু দিয়ে সন্তানের পা থেকে গুলি বের করেন।