কক্সবাজারে শত কোটি টাকার খাস জমি ও পাহাড় অবৈধ দখলে যাচ্ছে। গভীর রাত থেকে শুরু করে কাকডাকা ভোর পর্যন্ত পাহাড় কেটে স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে। অবৈধভাবে পাহাড় কাটায় কলাতলীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা মাইক্রোওয়েভ স্টেশন হুমকির মুখে পড়েছে। স্টেশনের শত কোটি টাকার জমির বেশির ভাগ দখলবাজ চক্রের কবলে চলে গেছে। নোটিশ, জরিমানা, মামলা ও অভিযান চালালেও দখল কার্যক্রম বন্ধ হচ্ছে না।
নির্বিচারে পাহাড় কাটার কারণে টেলিযোগাযোগ কেন্দ্রের ৮৩ ফুট দীর্ঘ সম্প্রচার টাওয়ার চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। যে কোনো মুহূর্তে এ টাওয়ার ধসে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা। সম্প্রচার টাওয়ারের নিচে পাহাড় কেটে স্থাপনা তৈরি করছিলেন লায়ন মুজিবুর রহমান। এক মাস ধরে তার শতাধিক শ্রমিক কাজ করে আসছিল। সম্প্রতি সেখানে অভিযান চালান কক্সবাজার সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরিয়ার মোক্তারের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরপর সেখানে স্থাপনা নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। এ সময় তিন শ্রমিককে আটক করা হয়। পাহাড় কাটার কিছু সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। অভিযুক্ত মুজিবুর রহমানকে এক লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরিয়ার মোক্তার বলেন, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা মাইক্রোওয়েভ স্টেশনের পাদদেশে পাহাড় কাটা ও অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের সত্যতা পাওয়া গেছে। এজন্য তাৎক্ষণিক নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অভিযানে অংশ নেয়া পরিবেশ অধিদফতরের কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নুরুল আমিন বলেন, সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও রেহাই পাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও সম্ভব হয় না। এসব সংঘবদ্ধ চক্র নানা ভুয়া দলিলপত্র নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করে।
সরেজমিন দেখা যায়, মাইক্রোওয়েভ স্টেশনের পশ্চিম পাশে পাহাড়ের পাদদেশে বিশাল আয়তনের জায়গা দখল করে ৬০ থেকে ৭০ ফুট দৈর্ঘ্যরে সেমি পাকা স্থাপনা নির্মাণকাজ চলছে। এরই মধ্যে ইটের দেয়াল ও টিনের ছাউনির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। আছে বিদ্যুৎ সংযোগও। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুর রহিম জানান, স্থাপনাটি নির্মাণ করছেন কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা লায়ন মুজিবুর রহমান। রমজানের ঈদের পর থেকে স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। শ্রমিকরা দিনরাত কাজ করছেন। নির্মাণকাজের শুরুর দিকে পুলিশ কয়েকবার নিষেধ করেছে। প্রশাসন তাকে দমানোর অনেক চেষ্টা করেছে। জরিমানা, মামলা, আটক করা হলেও দখলবাজি থামছে না।
একটি সূত্র জানায়, মুজিবুর রহমান নকল দলিল দেখিয়ে মাইক্রোওয়েভ স্টেশনের সরকারি জমি দখল করে পাহাড় নিধনে নেমেছেন। প্রতি রাতে অর্ধশতাধিক শ্রমিক দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। স্থাপনা নির্মাণকাজ শেষের দিকে। পুরো জায়গা দখলে রাখতে ছোট ছোট কয়েকটি ঘর নির্মাণ করে ২০টি পরিবারকে থাকতে দিয়েছেন নায়ন মুজিবুর। পুরো জায়গা ও স্থাপনা নির্মাণকাজের দেখভাল করেন আরিফ নামে একজন। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ক্রয়সূত্রে ওই জায়গায় মালিক মুজিবুর রহমান। এখানে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আলাদা বিভাগ হবে। সোমবার থেকে এখানে পাঠদান প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।
এ ব্যাপারে লায়ন মুজিবুর রহমান বলেন, ‘জমি কিনে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এখানে কোনো পাহাড় কাটা হয়নি। তবে পাহাড়ের ঢালু কিছুটা সমান করা হয়েছে। এতেই অনেককে ম্যানেজ করতে হচ্ছে। আপনিও পারলে ওমুক-তমুককে একটু ম্যানেজ করে দেন।’ ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক আশরাফুল আফসার যুগান্তরকে বলেন, কলাতলীতে পাহাড়ের আশপাশে অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে কয়েক দফা অভিযান চালানো হয়েছে। পাশাপাশি এ অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের কাজও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এরপরও স্থাপনা নির্মাণে কাজ করলে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সূত্র আরও জানায়, শুধু মুজিবুর রহমান নন, মাইক্রোওয়েভ স্টেশন টাওয়ারের নিচে পাহাড় দখল করেছেন ইলিয়াছ সওদাগর, রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, মাহমুদুল হকসহ অনেক প্রভাবশালী। পাহাড়ের চারপাশ ঘিরে রয়েছে অবৈধ দখলদারদের বসতি। এর আগে পাহাড় কাটার দায়ে ইলিয়াছ সওদাগরকে ৯ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদফতর। জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত কয়েক দফা সেখানে অভিযান চালিয়ে ঘরবাড়িও উচ্ছেদ করেন। তবুও দখলযজ্ঞ থামেনি। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে হাত করে দখল প্রক্রিয়া বজায় রেখেছেন প্রভাবশালীরা। কক্সবাজার টেলিকম উপবিভাগের সরকারি ব্যবস্থাপক মুহাম্মদ কাউসার হামিদ মিজি জানান, ১৯৭৬ সালে পাঁচ দশমিক ছয় একর জমিতে মাইক্রোওয়েভ স্টেশনটি স্থাপন করা হয়। টাওয়ারে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন টেলিকম অপারেটর এবং গোয়েন্দা সংস্থার রেডিও অ্যান্টেনা বসানো আছে। ‘মহেশখালী ডিজিটাল আইল্যান্ড’ প্রকল্পের অ্যান্টেনা এবং বিটিভির সম্প্রচার যন্ত্রপাতিও সেখানে রয়েছে। তিনি বলেন, পাহাড়ের মাঝখানে কিছু জায়গা বাদ রেখে চারপাশের ভূমি দখল করে নিয়েছেন প্রভাবশালীরা। পাহাড় কেটে অনেক স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। ফলে ভবনসহ পুরো মাইক্রোওয়েভ স্টেশন এখন চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যে কোনো সময় স্টেশনটি ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
খবরটি ৪ আগস্ট ২০১৯ তারিখে যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।