রাজধানীর শ্যামলীতে আশা ইউনিভার্সিটির বাথরুমে মাসের পর মাস গোপনে ছাত্রীদের ভিডিওধারণ করা হয়েছে। সেই ভিডিও দেখিয়ে রেজিস্ট্রার অফিসে ডেকে ছাত্রীদের দেওয়া হয়েছে নানা অশোভন প্রস্তাব। প্রস্তাবে রাজি না হলে ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার আশরাফুল হক চৌধুরী ওরফে তানভীর চৌধুরী ছাত্রীদের মানসিকভাবে নাজেহাল করেছেন, হুমকি দিয়েছেন। এমনকি রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিতেও গড়িমসি করেছেন। এতকিছুর পরও তিনি রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ পদে বহাল তবিয়তেই রয়েছেন তিনি।
গোপনে ভিডিওধারণের অভিযোগ নিয়ে ওই ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী মামলা করেন। ওই শিক্ষার্থীর প্রাথমিক এজাহারে রেজিস্ট্রার অফিসের এমএলএস আমিনুল ইসলাম ও রেজিস্ট্রার তানভীর চৌধুরী— দু’জনের বিরুদ্ধেই অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে চূড়ান্ত এজাহারে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আসামির তালিকা থেকে বাদ গেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আশরাফুল হক চৌধুরী আশা ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা সফিকুল হক চৌধুরী আশার ছেলে। সফিকুল হক আশার আরেক ছেলে আরিফুল হক চৌধুরী আশা এনজিও’র গভর্নিং বডির সচিব। বাবার মৃত্যুর পর আশা ইউনিভার্সিটির হাল ধরেছেন আশরাফুল হক চৌধুরী। তার ইশারাতেই চলে সবকিছু।
আশা ইউনিভার্সিটির এমএলএস আমিনুলের দাবি, রেজিস্ট্রারের পরামর্শেই বাথরুমে তিনি মোবাইলে ভিডিও ক্যামেরা চালু করে রেখে আসতেন। এরপর মোবাইলে ধরা পড়ত ছাত্রীদের নানা ভিডিও। সেই ভিডিও দেখিয়ে ছাত্রীদের ব্ল্যাকমেইল করতেন রেজিস্টার আশরাফুল হক চৌধুরী।
অভিযোগ রয়েছে, ভুক্তভোগী ছাত্রী মামলা করলে তাকেও নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি তার বাড়িতেও পাঠানো হয়েছিল আশা এনজিও’র প্রতিনিধি। এভাবে ওই ছাত্রীর পরিবারকে চাপের মধ্যে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ মামলার ওই বাদীর।
মামলাটি ডিবি তদন্ত করলেও ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য তা এখন রয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে। সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন হাতে এলে মামলার বিষয়ে প্রতিবেদন দেবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী বলেন, পারিবারিক ঝামেলার কারণে আমার দু’টি সেমিস্টার ড্রপ হয়। তাই পরে টিউশন ফি’র ৭৫ হাজার টাকা জমা দিয়ে নাম নিবন্ধন করতে যাই। রেজিস্ট্রার অফিস নানাভাবে আমাকে ঘোরাতে থাকে। একদিন রেজিস্ট্রারের কাছে গেলে তিনি জানান, নাম নিবন্ধন করতে পারব না। তিনি বলেন, আমার নাকি কী সমস্যা রয়েছে। এরপর আরেকদিন গেলে রেজিস্ট্রারের পিএস আমিনুল ইসলাম আমাকে একটু নির্জন স্থানে ডেকে নিয়ে যান। বলেন, তিনি আমার কাজ করে দিতে পারবেন। কিন্তু তার জন্য আমার কাজ করতে হবে।
ওই শিক্ষার্থী বলেন, এরপর আমিনুল আমাকে একটি ভিডিও দেখিয়ে জানতে চান, ওই ভিডিওতে আমাকেই দেখা যাচ্ছে কি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাথরুমে ধারণ করা সেই ভিডিওতে আমিই ছিলাম। তখন আমি প্রশ্ন করি, ‘এই ভিডিও আপনার কাছে কীভাবে এলো?’ তখন তিনি (আমিনুল) বলেন, ‘পরীক্ষার জন্য নাম নিবন্ধন করতে চাইলে রেজিস্ট্রার স্যারের সঙ্গে একান্তে সময় কাটান। না হলে ভিডিও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এরকম অনেক ভিডিও আছে রেজিস্ট্রার স্যারের কাছে।’
ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘আমি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে অভিযোগ করি। অভিযোগ পেয়ে আমিনুল ও রেজিস্ট্রার তানভীরকে ডেকে নেয় ডিবি পুলিশ। আমিনুল ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। আমিনুলকে আটক করা হলেও এরপর তানভীরকে তার মা ডিবি থেকে ছাড়িয়ে নেন। পরে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা হয়। সেই মামলায় তানভীরকে বাদ দিয়ে পুলিশ শুথু আমিনুলকে আসামি করে।’
এক প্রশ্নের জবাবে ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি এজাহারে দু’জনের নামই উল্লেখ করেছি। সেই এজাহারের কপি আমার কাছে আছে। কিন্তু কী কারণে রেজিস্ট্রার তানভীর চৌধুরী এজাহার থেকে বাদ পড়ল, তা জানি না।’
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বলেন, এ ঘটনার পর পারিবারিক ঝামেলায় আমি শ্বশুরবাড়িতে চলে যাই। আমাকে আশা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডেকেছিল। নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় আমি সেখানে যাইনি। পরিচিত এক স্যারকে নিবন্ধনের বিষয়ে জানালে তিনি আমার সেমিস্টার, নাম-রোল সব জানিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমি পারব না। ওরা সব জায়গায় সমস্যা তৈরি করে রেখেছে।’
মামলার পর পুলিশ ভিডিওধারণে ব্যবহৃত একটি ওয়ালটন প্রিমিও মোবাইল ফোন, দুইটি সিম, একটি মেমোরি কার্ড ও নগ্ন ভিডিও জব্দ করে। মামলার জব্দ তালিকাতেও এগুলোর উল্লেখ রয়েছে।
এ ঘটনার সাক্ষী আশা ইউনিভার্সিটির বঙ্গবন্ধু আইন ছাত্র পরিষদের সভাপতি আল কাইয়ুম বলেন, ‘করোনা পরবর্তী বেশ কয়েকজন ছাত্রী আমার কাছে এরকম ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ঘটনা আমার কাছে বলেছিল। সবশেষ এই শিক্ষার্থী আমার কাছে প্রথমে ঘটনা খুলে বলে। এরপর বিষয়টি নিয়ে তাদের কাছে গেলে তারা প্রথমে অস্বীকার করে। এরপর ডিবিতে অভিযোগ করলে তাদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সবকিছু স্বীকার করে। রেজিস্ট্রারকে দুদিন ডিবিতে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদও করে। পরে তার মা লিখিত মুচলেকা দিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। তিনি লিখে যান, পরবর্তী সময়ে তদন্তে ছেলের নাম এলে আইনি ব্যবস্থা নিতে আপত্তি থাকবে না।’
আল কাইয়ুমের দাবি— ডিবির কাছে এরকম অনেক ভিডিও রয়েছে, যেগুলো আমিনুল ইসলাম ও রেজিস্ট্রারের ফোন থেকে জব্দ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, আমিনুল জানান, ডিবি পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি সবকিছু বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। বলেছেন, তিনি রেজিস্ট্রারের কথামতো এবং সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে এরকম কাজ করেছেন। একইসঙ্গে তিনি এরকম কাজ আর কোনোদিন করবেন না বলে ওয়াদা করেন। তিনি বলেন, ‘রেজিস্ট্রার স্যার বলতেন, চাকরি করতে হলে এরকম দু‘চারটা ভিডিও করতে হবে।’ প্রতি ভিডিও বাবদ দুই থেকে তিনশ টাকা করেও রেজিস্ট্রারের কাছ থেকে তিনি পেতেন বলে জানান আমিনুল ইসলাম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. ছানোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘মামলায় রেজিস্ট্রারের নাম আসেনি। তবে ফরেনসিক প্রতিবেদন পেলে বোঝা যাবে রেজিস্ট্রার আসামি হবেন কি না?’
সিআইডির ফরেনসিক প্রতিবেদনের আবেদনপত্রে বলা হয়েছে, যেহেতু আমিনুল ইসলাম তার মোবাইল ফোন থেকে রেজিস্ট্রার তানভীরের মোবাইলে ভিডিও পাঠিয়েছেন এবং আমিনুল বারবারই বলেছেন, রেজিস্ট্রারের নির্দেশেই গোপন ভিডিও করেছেন, তাই দু’জনের ফোনই জব্দ করে ফরেনসিক প্রতিবেদনের জন্য পাঠানো হলো।
ডিবি সূত্র জানিয়েছে, রেজিস্ট্রার তানভীরের জব্দ করা মোবাইল ফোনেও ওই শিক্ষার্থীর নগ্ন ভিডিও পাওয়া গেছে। একই ভিডিও আমিনুলের মোবাইল ফোনে থাকা ভিডিও’র সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে। সব জায়গায় তানভীরের জড়িত থাকার প্রমাণ মিললেও মূল এজাহারে তানভীরের নাম না থাকাটা অন্য কিছু ইঙ্গিত করে বলে জানায় ডিবি সূত্র।
ডিবি পুলিশ জানিয়েছে, আমিনুল ইসলাম সুকৌশলে বাথরুমের ওপরে ক্যামেরা সেট করে রাখত। এরপর ভিডিওধারণ শেষে তা কম্পিউটারে নিয়ে এডিট করে ফাঁকা অংশ কেটে ফেলে ছাত্রীদের ভিডিওটুকু রেখে দিত। এরপর ব্ল্যাকমেইল করত। অনেক শিক্ষার্থীকে তাদের ফাঁদে পড়তে হয়েছে। তবে একাডেমিকসহ সামাজিক বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তারা কোনো ব্যবস্থা নিতে সাহস পাননি।
এদিকে, রেজিস্ট্রার অফিসের আমিনুল কারাগারে থাকা এবং রেজিস্ট্রার তানভীরের বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ ওঠার পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি উল্টো ওই শিক্ষার্থীর গ্রামের বাড়িতে আশা এনজিও’র লোক পাঠিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে।
ওই শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, তারা আমাকে চাকরির প্রলোভন দেখাচ্ছে। আমার সার্টিফিকেট নিয়ে টালবাহানা করছে। আমার রেজাল্ট নিয়েই এখন সংশয়ে রয়েছি। তারা দেখাল যে আমার গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত তারা আসতে পেরেছে। প্রয়োজনে অন্য কিছুও করতে পারবে, এমনটিই বুঝাতে চায় বলে মনে করছি।
আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রেজিস্ট্রারের এরকম অনৈতিক চরিত্রের কথা কারও অজানা নয়। তবে চাকরি হারানোর ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না। কারণ তিনি একাধারে মালিক ও রেজিস্ট্রার। তার ইশারাতেই সবকিছু চলে।’
ওই শিক্ষকের দাবি— রেজিস্ট্রোর অনেক শিক্ষার্থীর জীবন নষ্ট করে দিয়েছেন। পরীক্ষার ফল আটকে রেখে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছেন। যৌন হেনস্তার অনেক ছাত্রী লোকলজ্জার ভয়ে আইনি ব্যবস্থা নেননি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব জানার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
জানতে চাইলে বেসরকারি আশা ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার তানভীর বলেন, ‘এ বিষয়ে আপনার কোনো তথ্য জানার প্রয়োজন হলে জনসংযোগ শাখায় কথা বলুন।’ জনসংযোগ কর্মকর্তা মেহেদি হাসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী আমিনুল ইসলামকে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আর রেজিস্ট্রারের কোনো সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।’
আমিনুল ইসলাম নিজে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, রেজিস্ট্রার নির্দেশক্রমেই গোপন ক্যামেরায় ছাত্রীদের নগ্ন ভিডিও করেছেন, তার ফোন থেকে রেজিস্ট্রার ফোনে সেই ভিডিও ট্রান্সফারও করেছেন, ভুক্তভোগী ছাত্রীর অভিযোগেও রেজিস্ট্রার নাম রয়েছে, সিআইডির ফরেনসিক আবেদনেও রেজিস্টারের নাম রয়েছে। এত কিছুর পরও কেন রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে ন্যূনতম ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি— জানতে চাইলে মেহেদী হাসান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে একটি কমিটি করা হয়েছিল তদন্তের জন্য। তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ায় কমিটি তানভীর চৌধুরীকে অব্যাহতি দিয়েছে।’
ভুক্তভোগী ছাত্রীর দাবি, আশা ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতার ছেলে মো. আসফাক হক চৌধুরী ওরফে তানভীর চৌধুরী। ফলে তিনি কেবল রেজিস্ট্রার নন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকও। তার প্রভাব ও ক্ষমতার কারণেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এ অভিযোগ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মেহেদি বলেন, ‘এটি একটি পুরনো বিষয় এবং নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। আপনারা পুরনো বিষয় নিয়ে কেন নাড়াচাড়া করছেন? আমিও সাংবাদিক ছিলাম। এখন জনসংযোগ কর্মকর্তা হয়েছি।’ এরপরই তিনি উপাচার্যের বক্তব্য নিতে বলে ফোন কেটে দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আশা ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য মো. ইকবাল খান চৌধুরী মোবাইল ফোনে কথা বলতে রাজি হননি। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘সামনাসামনি আসেন, এ বিষয়ে কথা বলব। ফোনে এ বিষয়ে কথা বলতে চাইছি না।’