ছেলেটা র্যাকেট হাতে বাসা থেকে বের হলো। কিন্তু আর বাসায় ফিরল না। তাকে নিতে এখন আমরা মর্গে দাঁড়িয়ে আছি। বুকের ভেতরে পাঁজর ভাঙার শব্দগুলো যদি শোনানো যেত আপনাকে, তাহলে বুঝতেন সেখানে কী হচ্ছে। যে বাচ্চাটাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি, সে এখন চোখের সামনে লাশ হয়ে পড়ে আছে। এমন দুর্ভাগ্য যেন আর কোনও মামার না হয়।
চোখের কোণে জমে ওঠা অশ্রু মুছতে মুছতে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে কথাগুলো বলতে থাকেন সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী আদনান কবিরের মামা জিয়াউল হক। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গের সামনে ভাগ্নের মৃতদেহ গ্রহণের জন্য অপেক্ষারত জিয়াউল হক এক সময় আর কথা বলতে পারেন না। সরে যান এ প্রতিবেদকের সামনে থেকে।
আজ শনিবার (৭ জানুয়ারি) ঢামেক মর্গে গিয়ে দেখা যায়, আদনানের মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন জিয়াউল হকসহ আদনানের স্বজনরা। ভেতরে তখন ১৪ বছরের কিশোর আদনান করীমের ময়নাতদন্ত চলছে।
গতকাল শুক্রবার (৬ জানুয়ারি) উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবীরকে সন্ত্রাসীরা খেলার মাঠে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে এবং কুপিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে। চিকিৎসার জন্য তাকে উত্তরার একটি হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে গতকাল রাতেই ময়নাতদন্তের জন্য মৃতদেহ নিয়ে আসা হয় ঢামেক মর্গে। সেখানেই আজ আদনানের মৃতদেহ নেওয়ার জন্য এসেছেন স্বজনরা।
আদনানের মামা মামা জিয়াউল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি পুরান ঢাকায় থাকি। ওরা (আদনানের পরিবার) থাকে উত্তরাতে। ঘটনা ঘটেছে মাগরিবের নামাজের পরপর। আমরা এশার নামাজের পর খবর পাই। খবর পেয়েই আমরা উত্তরার ১৩ নম্বরের লুবনান হাসপাতালে ছুটে যাই। কিন্তু ততক্ষণে আর বেঁচে নেই আদনান।’
জিয়াউল হক জানান, ব্যবসায়ী বাবা কবীর হোসেন ও মা কাওসার বেগমের তিন ছেলের মধ্যে আদনান ছিল মেজ। তার বড় ভাই দশম শ্রেণি আর ছোট ভাইটি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। জিয়াউল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওর মা আমার বড়। বড় বোনের বাচ্চারা এমনিতেই মামা-খালাদের খুব আদরের হয়। আদনানও তাই ছিল। লেখাপড়ায় ভালো ছিল, শান্ত-চুপচাপ। ও অসুস্থ থাকত একটু বেশি। তাই ওর প্রতি আলাদা একটা খেয়াল সবসময়ই আমাদের ছিল। ওকে নিয়ে টেনশন হতো সবার। সেই টেনশন আর করতে হবে না।’ বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন জিয়াউল।
পাশে থাকা আদনানের চাচা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ওরে (আদনান) কেমন করে এভাবে মারতে পারল? ওরে দুইটা থাপ্পড় দিলেই আর উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। সেই ছেলেটারে এইভাবে মারলো! ওরাও (হামলাকারীরা) তো কারও সন্তান, কারও ভাই। তারা কি জানে তাদের ছেলে আরেকটা মায়ের কোল খালি করে দিল?’
ঘটনার কারণ জানতে চাইলে নিহত রফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খেলার মাঠে যারা সিনিয়র ছিল তাদের সঙ্গে বাইরের কোনও এক গ্রুপের সঙ্গে বিরোধ ছিল। ওদের কথা কাটাকাটিতে এক সময় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এসময় বড়রা দৌড়ে পালিয়ে গেলেও আমাদের ছেলেটা পালাতে পারেনি। ওকে ধরতে পেরে ইচ্ছামতো কুপিয়েছে সন্ত্রাসীরা।’
যারা এই কাজ করেছে তারা অল্পবয়সী বলে জানান জিয়াউল হক। তিনি বলেন, ‘শুনেছি, উত্তরার এই সন্ত্রাসী গ্রুপটি গত তিন-চার মাসে বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দু’দিন আগেও তারা আরেকটি ছেলেকে মেরেছে। ওই ছেলেটিও শুনেছি রাজনীতি করে। তাদের হয়তো অন্য কোনও হিসাব ছিল। কিন্তু আমার ভাগ্নে তো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না।’ তারপরও কেন আদনানকে এই পরিণতি বরণ করতে হলো?, প্রশ্ন রাখেন আদনানের চাচা।
জিয়াউল হক ও রফিকুল ইসলাম জানান, শুক্রবার রাতেই আদনানের বাবা কবীর হোসেন বাদী হয়ে মামলা করেছেন। মামলায় দু’জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। উত্তরাতেই আদনানকে দাফন করা হবে বলে জানান তারা।
সংবাদ ও ছবি : বাংলা ট্রিবিউন