Headlines

পুলিশ বিভাগের অন্তর্নিহীত নৃশংসতা: এবার শিকার একজন নিখিল তালুকদার

নিখিল তালুকদার

ঘটনাটি এমন এক সময়ে ঘটেছে যখন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা রাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরে পুলিশের নির্যাতনে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের (২৫ মে) মৃত্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর সেই ক্ষোভ বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে।

গত ২ জুন গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার রামশীল বাজারের কাছে সেতুর পাশে স্থানীয় কৃষক নিখিল তালুকদার (৩২) তিন সহযোগীকে (চিত্ত রঞ্জন হালদার, রতিকান্ত তালুকদার, ঝণ্টু হালদার) নিয়ে তাস খেলছিলেন। তাদের সবার বাড়ি রামশীল গ্রামে, এবং তারা পরস্পর আত্মীয়। খবর পেয়ে কোটালীপাড়া থানার এএসআই শামীম উদ্দিন দুই যুবকসহ সেখানে যান এবং মোবাইলে তাদের ছবি ধারণ করতে থাকেন। টের পেয়ে চারজন সেখান থেকে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। অপর তিনজন পালিয়ে যেতে পারলেও নিখিলকে ধরে ফেলেন এএসআই। এরপর তার উপর নির্মম নির্যাতন করা হয় এবং এতে তার মেরুদণ্ডের কয়েকটি হাড় ভেঙে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় নিখিলকে প্রথমে বরিশালের শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ৩ জুন বিকেলে নিখিল তালুকদার মারা যান। (প্রথম আলো, ৮ জুন ২০২০)

ইতি তালুকদার
ফলোআপ নিউজের কোটালীপাড়া প্রতিনিধি বাড়িতে গেলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এএসআই শামীম হাসানের নির্যাতনে নিহত নিখিল তালুকদারের স্ত্রী ইতি তালুকদার (২৮), মা জয়মালা তালুকদার (৫৮) এবং পিতা নীলকান্ত তালুকদার (৭৩), সাথে নিখিল তালুকদারের দুই শিশু সন্তান। ছবি: বিজন রত্ন

এ বিষয়ে নিখিলের স্ত্রী ইতি তালুকদার বলেন, “আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে, তাকে মারছে এটা সবাই দেখছে। এখন আমি দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে কোথায় যাব।” এরপর তিনি বিলাপ করতে থাকেন, আর কোনো কথা বলতে পারেননি। 

তবে নিখিল তালুকদারের স্ত্রীর বক্তব্য বিভিন্ন পত্রিকায় এসেছে—  সমকাল পত্রিকার প্রতিনিধির কাছে তিনি বলেন, “আমার স্বামীকে এএসআই শামীম ধরে মারধর করেন। একপর্যায়ে হাঁটু দিয়ে পিঠে আঘাত করা হয়। এতে আমার স্বামীর মেরুদণ্ডের তিনটি হাড় ভেঙে যায়।” (সমকাল, ৭ জুন ২০২০)

মৃতের চাচাতো ভাই মিলন তালুকদারও এ প্রসঙ্গে একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন,  “তাস খেলার কারণে এএসআই শামীম হাঁটু দিয়ে আঘাত করে নিখিলের মেরুদণ্ড ভেঙে তিন টুকরো করে ফেলেছে। অন্যায় করলে আইনানুযায়ী তাকে সাজা দেওয়া যেত। নিখিলই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। এখন পরিবারটির কী হবে?” (ঢাকা ট্রিবিউন, ৫ জুন ২০২০)

প্রত্যক্ষদর্শী চিত্তরঞ্জন হালদার বলেন, পিঠে আঘাত করা হয়েছে, তার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেছে, এটা সত্য। রামশীল বাজারের লোকেরা তাকে ধরে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। দারোগা শামীম তখন পাঁচ হাজার টাকা দেয়। এ সময় নিখিল প্রায় অজ্ঞান ছিল, তার নিচের অংশ অবশ (চেতনাহীন) ছিল।

আপনাদেরকে টাকা দিয়ে বিষয়টা মীমাংসা করতে চাওয়া হয়েছে কিনা —এ প্রশ্নের জবাবে নিখিল তালুকদারের ভাই মন্টু তালুকদার বলেন, আমাদেরকে উপজেলায় ডাকা হয়েছিল। আমরা জানতাম না কেন ডাকা হয়েছিল, টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তবে আমরা সে প্রস্তাব গ্রহণ করিনি। ৭ জুন থানায় এএসআই শামীম এবং তার সোর্স রেজাউলের বিরুদ্ধে মামলা (মামলা নং- ১৩৪০ (৩)/১) করার কথা উল্লেখ করেন তিনি। যদিও বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদনে টাকা দিয়ে মীমাংসার বিষয়টি উঠে এসেছে।

ঢাকাট্রিবিউন পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মন্টু তালুকদার বলেন, “ঘটনার পর প্রভাবশালী একটি মহল গোপনে ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে আমাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। থানায় মামলা না করে পরে আমরা বাধ্য হয়ে শনিবার সালিশ বৈঠকে যাই। সেখানে ৫ লাখ টাকায় এটি দফারফা করা হয়। সেখানে আমাদের পরিবারের দুই সদস্যকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এতে আমরা সম্মত ছিলাম না। কিন্তু প্রভাবশালীদের সামনে ওই প্রস্তাব প্রত্যাখানের সাহসও আমাদের ছিল না। ২ লাখ টাকা নিয়ে সেখান থেকে আমরা সালিশ মেনে চলে আসি। তাই ন্যায্য বিচার পেতে আমরা মামলা করেছি।” (ঢাকা ট্রিবিউন, ৮ জুন ২০২০)

বিষয়টি মীমাংসা করতে চাওয়া কোটালীপাড়া উপজেলার চেয়ারম্যান বিমল কৃষ্ণ বিশ্বাসের ফোন নম্বরটি সবসময় ব্যস্ত থাকায় তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ধারণা করা যায়— যোগাযোগ এড়াতে তিনি তার নম্বরটি (০১৭২৭৭০১০৬৬) সবসময় ব্যস্ত করে রেখেছেন।

কোটালীপাড়া থানার ওসি শেখ লুৎফর রহমান বলেন, এএসআই শামীম মারধরের কথা অস্বীকার করেছে, প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবেও আমি এখন পর্যন্ত কাউকে পাইনি, তবে মামলা হয়েছে এবং আমরা একটি তদন্ত টিম গঠন করেছি, সাব-ইনস্পেক্টর হিমেল রানার নেত্বত্বে তদন্ত চলছে।   

মীমাংসার বিষয়টি সম্পর্কে ওসি বাংলাট্রিবিউন পত্রিকায় দেওয়া বক্তব্যে বলেছেন,  টাকার বিনিময়ে মীমাংসা —এটা পুলিশের পক্ষ থেকে হয়নি। সভায় যে নেতারা ছিলেন তারা নিখিলের অবর্তমানে পরিবার চালানোর জন্য ব্যবস্থা করেছেন। (বাংলাটিব্রিউন, ৭ জুন, ২০২০)

গোপালগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার জনাব মুহাম্মদ সাইদুর রহমান বলেন, মামলা হয়েছে, এবং আসামীদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। যেহেতু বিষয়টি তদন্তাধীন, তাই এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারি না।

বাংলাদেশের আইনে জুয়া খেলা অপরাধ হলেও তাস খেলা অপরাধ নয়। এ বিষয়ে রামশীল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খোকন চন্দ্র বালা বলেন, নিখিল তালুকদার একজন সাধারণ কৃষক, যাদের সাথে বসে তাস খেলছিল তারাও তাদের একই বাড়ীর লোক। এখানে জুয়া খেলার কোনও বিষয় থাকতে পারে না, আর করোনা ভাইরাসের কারণে যদি ব্যবস্থা নিতেই হয় তাহলে বিষয়টি তাদের বুঝিয়ে বলা যেত। সাধারণভাবেই এ সময়টাতে কৃষকদের কাজ নেই, ফলে তারা বিভিন্নভাবে সময় কাটাতে চায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে তিনি নিখিল তালুকদারকে মারধরের বিষয়টি উল্লেখ করেন।

অনেক অপরাধী এবং নিয়মিত আসামি অবাধে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ অনেক পুরনো যে, তারা এভাবে ঠুনকো অপরাধের অজুহাতে, অথবা অনেক সময় নিরপরাধ মানুষ আসামি হিসেবে ধরে থানায় আনে, এই আসামি তারা ধরে আনে বিচারের জন্য নয়, আসামি ধরলে আসামির স্বজনরা আসবে থানায় ছাড়াতে, টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে। এই নিয়ম অলিখিতভাবে সব থানাতেই আছে বলে মনে করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মানবাধিকারকর্মী।

কৃষক নিখিল তালুকদারের মৃত্যুর  ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন চেয়েছে মানবাধিকার কমিশন।

কৃষক নিখিল তালুকদার হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে বিবৃতি দিয়েছে ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক। বিবৃতিতে বলা হয়, “নিখিল তালুকদার হত্যায় কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনও প্রকার আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে এবং একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সমঝোতা প্রচেষ্টা মানবতাবিরোধী ও আইনের শাসনের পরিপন্থী।” (জাগোনিউজ, ৭ জুন ২০২০)

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নিউইয়র্ক শাখা ৭ জুন জুম ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে একটি সভার আয়োজন করে, যে সভা থেকে পুলিশি নির্যাতনে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড হত্যা এবং বাংলাদেশে কৃষক নিখিল তালুকদার হত্যাকাণ্ডের প্রতি নিন্দা জানিয়ে যথাযথ বিচারের দাবী জানানো হয়। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নিউইয়র্ক চ্যাপ্টারের সভাপতি ফাহিম রেজা নুর-এর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক স্বীকৃতি বড়ুয়ার পরিচালনায় অনুষ্ঠিত এ সভার প্রসঙ্গ ধরে নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, আমরা ভিকটিমের পরিবারকে সাহায্য করতে চাই। কিন্তু তারা যদি অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য বা বিবাদী পক্ষের সাথে সমঝোতা করে ফেলে তাহলে কিছুই করার থাকবে না। আমরা নিখিল তালুকদারের স্ত্রীর কাছে এই বার্তাটা পৌঁছে দিয়েছি, তাদের বাড়িতে আমরা প্রতিনিধি পাঠিয়েছি, যাতে তারা বিচার চেয়ে অনঢ় থাকে এবং মামলার প্রক্রিয়া যথাযথভাবে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমরা সকল ধরনের আইনি সহযোগিতা তাদেরকে দেব। কিন্তু এ পর্যন্ত তারা কেউ আমাদের সাথে যোগাযোগ করেনি।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আইন সহায়ক কমিটির গোপালগঞ্জ চ্যাপ্টারের সভাপতি, রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে আমি জানতে পেরেছি যে, বাদীপক্ষ (নিহত নিখিল তালুকদারের ভাই মন্টু তালুকদার এবং এবং অন্যান্যরা— এলাকার মুরুব্বি রমনী তালুকদার, ভাণ্ডারহাট কলেজের শিক্ষক কমল তালুকদার, রামশীল কলেজের শিক্ষক জয়দেব বালা প্রমূখ) উপজেলা চেয়ারম্যানের অফিশে একটি সালিশি করেছে। পাঁচ লাখ টাকায় বিষয়টি মীমাংশা হয়েছে বলে জানতে পেরেছি, ইতোমধ্যে বাদীপক্ষ দুই লাখ টাকা গ্রহণও করেছে। তারপরেও আমরা নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে মামলা করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে চেয়েছি, কিন্তু বাদী পক্ষের কাছ থেকে এখনপর্যন্ত কোনও সাড়া আমরা পাইনি। 

বাংলাদেশে পুলিশি নির্যাতনের ঘটনা অনেক পুরনো এবং বহুবিধ। ২০১৩ সালে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন পাস হওয়ার পর এখন পর্যন্ত এরকম ঘটনায় মামলা-ই হয়েছে হাতে গোনা। যথাযথ বিভাগীয় তদন্ত হওয়ার নজির খুব কম, ফলে ভুক্তভোগী বা ভুক্তভোগীর স্বজন এ ধরনের ঘটনার প্রেক্ষিতে বিচার পেয়েছে এরকম উদাহরণ খুঁজে বের করা কঠিন। পুলিশ বিভাগ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাকে গুরুত্বহীন মনে করে এসেছে সবমময়, তারা এটিকে বলে থাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কার্যত এক ধরনের দায়মুক্তি ভোগ করে থাকে, দেখার বিষয় এবার সে-ই দায়মুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে কিনা।

প্রতিবেদনটি তৈরি করতে সহযোগিতা করেছেন ফলোআপ নিউজের কোটালীপাড়া প্রতিনিধি— বিজন রত্ন