Headlines

ছোটগল্প: নৈর্ব্যক্তিক । আঁখি সিদ্দিকা

অাঁখি সিদ্দীকা

বেশ কিছুদিন ধরে শুভেন্দুর জ্বর আসছে আবার ছেড়ে যাচ্ছে। সিজন চেন্ঞ্জের জন্য? না দীর্ঘদিন রিমোট এলাকায় থাকায়, আবাহাওয়া-পরিবেশ খাপ খাওয়াতে পারেনি সেজন্য?

নাহ! ওখানে তো বেশ ছিল, তবে? আজকাল কি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসছে? কাশির দমকে খাট নড়ে যাওয়ার জোগাড়। একটু আদা-চা হলে ভালো হতো। কিন্তু কে করবে? উঠে গিয়ে নিজের জন্য চা তৈরী করা অসম্ভব। তার চেয়ে বরং স্বপ্নে বলা যাক, সিলেটের চা বাগানে গিয়ে কোন এক সাঁওতাল লসমীলতাকে বাগান থেকে চা তুলে এক কাপ বানিয়ে দিতে। নাবিল ধাক্কা দিতেই ঘুম ভাঙ্গলো।

– কি রে শুভ কী হয়েছে তোর? তোর তো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।

– কোনোরকমে বললাম, কয়টা বাজে রে নাবু ?

– এই তো দুটো বেজে গেছে।

– ডাক্তার ডাকছি।

– না, এখন কোথায় ডাক্তার পাবি? অভি আজ ফেরেনি?

– নাহ! একটু আগে ফোন করলো, উত্তরা এক বাসায় ফ্রেন্ডদের সাথে আটকে গেছে, বড় ভাইদের কামলা খাটতে হবে আজ রাতে। আকির্দের এই এক ঝামেলা !

– কাল কি ওর ভার্সিটি খোলা?

– হ্যাঁ, ওখান থেকেই যাবে।

– তোর আজ অফিস ছিলো না? কোথায় কোথায় ছিলি সারাদিন?

– তোমার কি হলো বলো তো , এতো কথা বলছো কেন? একটু ঘুমাবার চেষ্টা করো। কি করে এমন জ্বর বাধালে?

আমি এখন কী করি বলতে বলতে নাবিল রান্না ঘরের দিকে গেলো, ওকে তো বলি নি চা খেতে ইচ্ছে করছে, ওকি চা করতে গেলো, একটু পরে নাবিল ফিরে এলো , দুটি মগ হাতে। আহঁ চা ।

নাবিল যেন লসমীর প্রতিরুপ । এই মধ্যরাতে চা। মুখে নিতেই তিতায় মুখ ফিরে এলো। জিহবা আড়ষ্ঠ হয়ে এলো।

– কী রে নাবিল? কী এটা?

– কী করবো, কৌটোটা ঢেলে পড়ে গেলো চায়ের হাড়িতে, তারপর তাড়াহুড়োয় নামাতে গিয়ে পড়ে গেলো খানিকটা চা।

আজ রাতে দুটি মানুষ প্রায় উপোস। খালার ছেলের জ্বর, আসেনি। রান্না হয়নি। শুকনো পাউরুটি আর ডিম । আজকাল খালা প্রায়ই কামাই করে। অভি প্রায়ই রেগে যায়, কিন্তু কী করবো, আজকাল সৎলোক পাওয়া যে মুশকিল তা ও কী করে বুঝবে?

মা’র কথা মনে নেই কিছুই। কখনও ছবি দেখতে দেখতে মনে হয় এতো সুন্দরী একজন আমার জন্মদাত্রী ছিলেন। মা নাকি ভীষন কড়া শিক্ষক ছিলেন আর ঘরে ঠিক উলটো ছিলেন। বড়দির কাছেই বড় হয়েছি। মায়ের অভাব বড়দি বুঝতে না দিলেও মা হতে চাননি কখনও, সব সময় মায়ের গল্প বলতো আর প্রতিবছর মায়ের প্রিয় জায়গাগুলোতে বেড়াতে নিয়ে যেতো দিদি।

ছোটবেলা থেকে অসুখবিসুখ খুব একটা হয়নি, কিন্তু কখনও জ্বর হলে বড়দি কোমরে কাপড় পেচিঁয়ে বলতো দেখ বাপন এবার আমি আর তোর জ্বরের দুপক্ষ, দেখি কে জেতে? সত্যিই একদিনের বেশি কখনই জ্বর থাকতে পারতো না। ওর হাতে যাদু ছিলো। শক্তসেবায় যেকোন অসুখ দৌড়ে পালাবে। যেমন খাওয়াবে, তেমনি শাসন করবে।

বলতো শুয়ে থাকলে যেকোনো অসুখ সুযোগ পায় শরীরে আসন গাড়তে। মায়ের জন্য ওর আফসোসের শেষ নেই। কেন ও আরও একটু তখন বড় হয়নি, কেন হোমস্‌ থেকে বাবা তাড়াতাড়ি নিয়ে আসেনি, এসব বলে বলে জামাইবাবুর কানঝালাপালা করবে সারাক্ষণ। মিথী, তিথিও বলে মামা আমরা তখন থাকলে দিদাকে কিছুতেই যেতে দিতাম না।

– নাহ! শুয়ে থাকবো না, উঠি। উঠতে গিয়ে পা টা টলে উঠলো।

– নাবিল কি করছে? শুয়ে পড়েছে অভিকের ঘরে। ভালো করেছে, আমার ডির্ষ্টাব হবে ভেবে এখানে শোয়নি। অফিসের ফাইলটা শেষ করে রাখি, কাল যেতে না পারলেও পাঠিয়ে দেয়া যাবে। বস্‌ ইদানিং এমন ব্যবহার করছে কেন, জানি না নাকি জানাটাকে প্রশ্রয় দিতে চাই না। বার বার রিমোট এলাকায় আমাকেই ভিজিটে পাঠাচ্ছে, বেশির ভাগ অফিসের বাইরের কাজে পাঠাচ্ছে। আমি তো ডেস্ক ওয়ার্কেই জয়েন করেছিলাম, কিছু বলতে গেলেই বলবে, শুভেন্দু, ইয়াং ম্যান, আপনি এখন ঘুরবেন  নাতো কবে ঘুরবেন?

কিন্তু আমি যে ভীষন টার্য়াড। সেদিন অভিকের সামনে বলতে ও কিন্তু দারুণ লজিক দিয়েছে, আমার মাথায় কেন আসেনি? ইবানা জয়েন করেছে লাস্ট জুলাই এ। মানে প্রায় ১০ মাস। আরে বিগত ৭ মাসই তো আমাকে সে এখানে ওখানে পাঠাচ্ছে, এমনকি ঢাকায় থাকলে হয় গুলশান, না হয় উত্তরা, না হয় গাজীপুর ক্লাইন্ট ভিজিট না হয় প্রজেক্ট ভিজিট। অফিসে শেষ টাইমে কখনও ঢুকি কখনও ফোনে জানিয়ে দেই। এভাবেই চলছে।

ওহ! মাথাটা ঝিমঝিম করছে। জল। জল খেতে পারলে …

– কী রে শুভ, খুব দেখালি দোস্ত! এই বয়সে হসপিটাল টসপিটাল করে ছ্যাড়াবেড়া। বলতে বলতে এগিয়ে আসলো ছেলেবেলার বন্ধু বিপুল। দ্যাখ! তোকে দেখতে অপরুপা হাজির।

-কী ভাইয়া, আপনি অসুস্থ হলেন কী করে? কী অবস্থা! জ্বরে কেউ এভাবে কাহিল হয়, ইবানার মিষ্টি হাসিটা যেন অনেক দূরের কলের গান মনে হলো।

– আজই রিলিজ দিয়ে দেবে মাহতাব এগিয়ে আসলো ইবানার দিকে, চলো যাওয়া যাক। হাসপাতাল মানেই অস্বস্তিকর অবস্থা। পেছন ঘুরে যাওয়ার সময় ওহ! মিষ্টার শুভেন্দু, একটি খাম এগিয়ে দিয়ে এটা আপনার জন্য, বস দিতে বললেন। ঠিক আছে আসি, টেককেয়ার । ইবানারা চলে গেলো।

– বিপুল এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রেখে বললো, চল তবে বাড়ী যাওয়া যাক।

– মানে কী! বাসায় যাবো না? অফিস!

– ধ্যাততেরি তোর অফিস! বড়দির কান্না আমি শুনেছি, নাছোড় বান্দা, আসবেই ঢাকায়, আমি জোর দিয়ে বললাম, আমরা সবাই তোর পাশে আছি, আর রোজ যে কতবার ফোন তুই  কি করে বুঝবি গাধা, বুঝলে তো আর শরীরের এই অবস্থা হতো না। অভিক, নাবিল সব নিচে গাড়ী নিয়ে বসে আছে। আমি রিলিজ পেপার রেডি করে নিয়ে আসছি, যা হলো না একটা !

বিপুলটা বরাবরই এমন। পিলপিল করে সবার পাশে আছে। ও কি কখনও একটুও বদলাবে না? বদলালে কী হতো? আদৌ কি আমরা বদল চাই? এই যে আমার দিনদিন বদল একি কাছের মানুষেরা মানতে পারছে?

– ওঠ মামা। নার্সদের দিকে এমন ড্যাব ড্যাব করে তাকাস না। এক হাতে কালো একটি ব্যাগ, কাগজপত্র আর এক হাতে আমায় ধরে বিপুল লিফটে উঠালো।

 লিফটের আয়নায় নিজেকে দেখে যেন আর চিনতে পারি না।

– আরে বিপুল এ কে?

– ওটা তুই মামু! বোঝ ঠ্যালা। যা আরও কই কই। ভিজিট টিজিটে। চাকরী আর কেউ করে না, উনি একাই করেন ! যত্তোসব! চল।

বাড়ী পৌছঁতে প্রায় সন্ধ্যা হলো। বড়দির স্বভাবসুলভ কান্নাকাটি। মিথী, তিথিও জড়িয়ে ধরে রাখলো খানিকক্ষণ।

– জামাইবাবু মুখ বেজার করে বলল, তুমি তো জানো শুভ তোমার কিছু হলে পুষ্প কি কাণ্ডটাই না করে। তবুও একটু কেয়ারফুল হবা না? ডেঙ্গু বাঁধিয়ে ফেললে? এবার কোথায় প্রজেক্ট ভিজিটে গেছিলে? একটানা কথাগুলো বলে জামাইবাবু উঠে গেলেন ব্যাগ হাতে, উত্তর না দিয়েই।

– বড়দি কান্না থামিয়ে বললেন, নে তোর সংসার তুই সামলা, আমি আর পারবো না। বেশী বাড় বেড়েছে, তোর বাবা দিনরাত ইশারায় তোর ছবি দেখিয়ে জানতে চাইবে, আর চোখের জল ফেলবে, কী রে তুই বাপন?

– ছোট দি কেমন আছে? ওদের একটু আসতে বলো না, বলতে বলতে বাবার ঘরের দিকে উঠবো এমন সময় অভীক চৌকাঠের কোনে এসে ফিসফিসয়ে বললো,

– শুভ দা, তুমি তো কখনও কাকাবাবুর কথা বলোনি?

– বলা হয়নি অভি?

– আমি আসি তোমার সাথে?

– আয় …

বাবা পাশ ফিরে শুতে গিয়ে পারলেন না, আমি আর অভি শুয়ে দিলাম, বাবার চোখের হাসিতে চোখে জল এসে গেলো। উঠোনটা কি দিনদিন ছোট হয়ে আসছে? ভালো লাগছিলো না, মনে হচ্ছিল এক দৌড়ে ঢাকায় ফিরে যাই আর কাজে ডুবে যাই।

দশটার গাড়ীতে অভিক, বিপুল আর নাবিল চলে গেলো।

ছোট দি সুপ্তিকে নিয়ে কদিন হৈহৈ করে কাটিয়ে গেলো, বাবাও যেন অনেকদিন পর জীবনে নয় প্রানে বাঁচলেন। বড়দির সেবায় পুরোপুরি ফিট হয়ে গেলাম। বড়দিকে মনে হয় যেন দিদি নয় আমাদের বড়দা। এমন দি থাকলে কি আর দাদা প্রয়োজন হয়?

গুছিয়ে নিচ্ছি ফিরতে হবে, ছুটি প্রায় শেষ, বসের দেয়া খামের ভেতরের ঈশ্বরও ফুরিয়ে আসছে। বস্ কেন আমায় এতো বাইরে পাঠায়? ভাবনটা আবার মাথায় ঢুকতেই ইবানা চলে এলো সামনে। ও এখন কী করছে? কেমন বদলে গেলো হঠাৎ!

তখন প্রোডাকশন দেখছিলাম, কোন সার্কুলার ছাড়াই নিয়োগ হলো শেষবার জুনে। জুলাই এর সেই বৃষ্টিবিকেলে বস্ ইবানাকে নিয়ে ঢুকলেন, সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন ।অনেকদিন পর যেন অফিস পাশ ফিরে শুলো, আড়মোড়া ভাঙলো টেবিলে টেবিলে। ইবানা’র টেবিল হলো আমার পাশের টেবিলটাতে । সেদিন কি নিজেকে রাজা রাজা মনে হয়েছিল, মনে নেই। তবে কলিগরা ধরেছিলো মিষ্টি খাওয়া বলে। ইবানাও রোজ লাঞ্চ শেয়ার করতে থাকলো আমার সাথে, আমিও ওকে বাড়ী পৌছেঁ দেই, মাঝে মাঝে লাঞ্চে নিয়ে যাই।

একটা আহলাদিপনা থাকলেও শরীরের আকর্ষণ ছিলো তীব্র। ইবানাকে দেখার পর কেমন একটা ভাবনার দোল খেলে যেতো যেন, ওই কটা দিন আমি যেন আমি ছিলাম না, অফিসে যাওয়ার প্রতি অন্য টান, তীব্রতা কাজ করতে লাগলো, আলাদা পারফিউম, বাড়ীতে একটু কম টাকা পাঠিয়ে একজোড়া এ্যপেক্স এর জুতোয় কিনে ফেলেছিলাম। তবে কি শরীরের টান মনের যন্ত্রনাকে কখনও ভুলিয়ে দিতে পারে?

ইট চাপা পরা ঘাসের মতো কি মনে হয় পুরোনো স্মৃতিকে? যেন একঝটকায় রুবা চলে গেলো খানিকটা দুরে। অনেকদিন ওর ছবির ধুলোও মোছা হয়নি, এ নিয়ে অভি, নাবু কম বলেনি। রাতে আয়েশ করে ধ্রুম উদগীরনের সময় অভি বলতো দাদা, এভাবে কি উদগীরণ হয়?

রুবার আসা, চলে যাওয়া, সব কি নিছক দূঘর্টনাই ছিলো, যদিও সাইক্রিয়াটিক কামাল ভাই কাউন্সিলিংএর সময় কত কী না বুঝিয়েছিলেন, গরীবের ঘোড়া রোগের মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিলো রুবার স্মৃতি, সাইলেন্স ডিজওর্ডারে মনে হতো রোজ, আজই শেষদিন।

কিন্তু শেষ না হয়ে শেষ হওয়ার মতো এক ঝটকায় একা জীবনের অভ্যাসে এসে দাঁড়ালো ইবানা। ইবানা কি এসেছিলো, না আসেনি। আসলে এমন করে বসের কথায় এড়িয়ে যেতো না। অফিসে চাউড় হতে বেশি সময় লাগেনি। ইবানা এসে বলেছিল, ভাইয়া চাকরীটা আমার খুব দরকার। আমাকে অনেক মূল্য দিয়ে চাকরীটা পেতে হয়েছে। আজ বুঝতে পারি আমি কেন রোজ দূরে দূরে প্রজেক্ট ভিজিটে যাই আর ইবানাকে কোন মূল্য দিতে হয়েছিল, আমাদের দুজনেরই যে চাকরীটা খুব দরকার, ইবানা।

কী রে, তোর হলো? বাইরে ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে, বাবাকে আজ বারান্দায় শোয়ানো হয়েছে, আমার বিদায় দেখানোর জন্য? একটু বিরক্ত হলাম। বেস্ট শিক্ষকের পুরুস্কারপ্রাপ্ত, মফস্বলের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক আজ কোনো কথাই বলে না। ইশারায় খুব কষ্টে বোঝালেন তিনি বাসস্ট্যান্ডে যাবেন, কী আর করা, তাকে সবাই মিলে ভ্যানে শুইয়ে দেয়া হলো। বাস ছেড়ে দেয়া পর্যন্ত তার সবল বাম হাতটা নাড়তে লাগলেন। অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসলো, বাবা! পাশের সিটের ভদ্রলোক  জানতে চাইলেন কিছু বললেন ভাই?


Ankhee Siddika     ankhee.siddika