হুবুই নামে চীনের একটি অখ্যাত ছোট শহর আছে। অখ্যাত হলেও এই শহরের কিছু বিশেষত্ব আছে— পুরো শহরটাই প্রাচীরবেষ্টিত। শহরে প্রবেশ করার জন্য মোট বারোটি গেট আছে। গেটগুলো বিশেষভাবে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। শহরে কে ঢুকলো কে বেরিয়ে গেলো সেটি জানা খুব সহজ হলেও হুবেই কর্তৃপক্ষ অযাথা সেটি জানতে চায় না। শুধুমাত্র শহরের মধ্যে কোনো অপরাধ ঘটলে ডাটাবেজ বিশ্লেষণ করে দেখা হয়। অন্যথায় এটি শুধুই একটি নিয়ম। কোনো নাগরিকের অধিকারে হস্তক্ষেপের জন্য নয়, সুরক্ষার জন্য।
আমি হুবেই গিয়েছি চ্যাং-এর সাথে। চ্যাং আমার বিজনেস পার্টনার। চ্যাং বেইজিং-এ থাকে। হঠাৎ ও চাইলো আমাকে চীনের বিশেষ কিছু দেখাবে। তাই হুবেইতে আসা।
আমরা ছয় নম্বর গেট দিয়ে প্রবেশ করেছি। বিদেশী কেউ আসলে এই গেট দিয়েই প্রবেশ করতে হয়। আমাকে ফুল দিয়ে বিশেষ রীতিতে অভ্যর্থনা জানানো হলো। আমাকে একটি ছোট পুস্তিকা দেওয়া হলো, যেটির মধ্যে ছোট্ট হুবেই শহরের কোথায় কী আছে, এবং ঘুরে দেখার সকল নিয়ম কানুন বর্ণনা করা আছে।
হুবেই শহরের মানুষ কেউই বাসায় রান্না করে খায় না। সকল মৌলিক চাহিদা কেন্দ্রীয়ভাবে মেটানো হয়। প্রতি পাঁচশো মিটারের মধ্যে কেন্দ্রীয় লঙ্গরখানা আছে, সেখানেই সেখানে সবাই খায়। কেউ চাইলে বাসায় রান্না করতে পারে, তবে জনগণ তা করে না, কারণ, লঙ্গরখানার খাবার মানসম্মত এবং স্বাস্থ্যকর— নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া যায় এবং মেনুগুলো ডায়েটিশিয়ান দ্বারা ঠিক করা। যাদের বিশেষ কোনো রোগ রয়েছে তাদের জন্য বিশেষ মেনু নির্দিষ্ট করা থাকে। এত সুযোগ ছেড়ে কেউ বাসায় রান্না করে খেতে চায় না। মানুষ কী খাবে সেটি নিয়ে ছয় মাস পরপর গবেষণা হয়, কঠোর পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া হুবেইতে কেউ কোনো খাবার দেশ বা বিদেশ থেকে আমদানী করতে পারে না।
আমরা খাওয়া জন্য হুবেই-৩৭-এ গেলাম। বাংলাদেশি টাকায় নব্বই টাকার মতো দিয়ে দুজনের জন্য টোকেন নেওয়া হলো। বিদেশী বলে খাবারের দাম বেশি রাখা হয় না। হুবেই কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে পৃথিবীর সকল নাগরিকের মৌলিক চাহিদা একই মানদণ্ডে পূরণ হওয়া উচিৎ। অনেক সুন্দর খাবার, তারপরও খাবার খেয়ে কেউ কোনো অসুবিধা বোধ করলে প্রতিটি লঙ্গরখানার সাথে মিনি হাসপাতাল আছে, সেখানে রিপোর্ট করা যায়। রিপোর্টগুলো কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখে।
হুবেইতে কেউ বেকার নেই, ষোলো বছরের বেশি বয়স হলেই শহর কর্তৃপক্ষের সাথে কোনো না কোনো কাজে যোগ দিতে হয়। আমাদের সাথে গাইড হিসেবে উনান নামে যে যুবতী আছে সেও শহর কর্তৃপক্ষেরই প্রতিনিধি। সে মূলত প্রেমবৃত্তিতে নিয়োজিত। একইসাথে বাইরে থেকে কেউ গেলে তার গাইড হিসেবেও কাজ করে। হুবেইতে কেন্দ্রীয়ভাবে নারী এবং পুরুষ প্রেমিক প্রেমিকা রয়েছে। আঠারো বছরের বেশি বয়স হলে যে কেউ এই পেশায় যেতে পারে। তবে শহরের জন্য কতজন এরকম সেবক এবং সেবিকা লাগবে সে হিসেবে নেওয়া হয়। উনান এই কাজের পাশাপাশি ফুড সায়েন্সে পড়াশুনা করছে। হুবেইতে এ ধরনের পেশায় থাকা যায় সর্বোচ্চ পাঁচবছর।
উনানকে আমরা বললাম আমাদের একটি প্রেমালয়ে নিয়ে যেতে। ও আমাদের একটি প্রেমালয়ে নিয়ে গেল। প্রেমালয়টির নাম চীনা ভাষায় যা লেখা রয়েছে তার বাংলা করলে দাঁড়ায় ভালোবাসা-২১। প্রথমেই আমাদের দুটো টিকিট করতে হলে— বাংলাদেশী টাকায় পাঁচ হাজার ছয়শো টাকা। এত বেশি তার কারণ, এই পেশায় যারা নিয়োজিত তাদের বেতন যেমন বেশি আবার এখান থেকে কিছু টাকা (২০%) ভর্তুকি হিসেবে চিকিৎসা খাতে যায়।
আমাদের দুজনকে দুটো রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। রুমে কেউ নেই। টেলিভিশন চালিয়ে দেওয়া হলো। সেখানে সকল নিয়ম কানুন বলে যাচ্ছে— প্রেমবৃত্তিতে নিয়োজিত একজন সেবিকার সাথে কেমন আচরণ করতে হবে, সবকিছু বলে যাচ্ছে। রুমটি খুব সাজানো গোছানো পরিপাটি, কোথা থেকে যেন বেলি ফুলের মতো একটি সুঘ্রাণ আসছে। হঠাৎ রুমে ঊনিশ .বিশ বছর বয়সী একজন তরুণী প্রবেশ করে আমাকে সম্ভাষণ জানায়। উনি প্রথমেই ইংরেজিতে আমাকে যে প্রশ্নটি করে তা
র অর্থ দাঁড়ায়— আপনি কি খুব ক্লান্ত, বিপর্যস্ত? আমি মাথা নেড়ে ‘না’ বলি। একটি তাকে বেশ কিছু বই রাখা আছে, তরুণী একটি বই বের করে দুটো লাইন শোনায়— No one in the world has come to love you, rather to get love. Now you will love me, won’t you? “তুমি যখন টেলিভিশনে নিয়ম কানুন দেখছিলে আমরা তখন একটি রুমে বসে তোমাদের পছন্দ করছিলাম। আমি তোমার কাছে পছন্দ করেই এসেছি। আমরা এখন এক ঘণ্টা গল্প করব। যদি তোমাকে সত্যিই পছন্দ হয়, তবেই আমরা অগ্রসর হব। আমরা সারাজীবন বন্ধু থাকতে পারি, আমাদের যোগাযোগ থাকবে। তুমি রাজি?”
এক ঘণ্টা পার হবার আগেই দুজনেই আমরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি, ফলে আমাকে অভিযুক্ত হতে হয়নি। তিনঘণ্টা সময় শের্তার সাথে আমার কেটেছে। সত্যিই স্মরণীয় মুহূর্ত।
সর্বশেষ যে বিষয়টি জেনে হুবেই শহরকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি— হুবেইতে কারো বাচ্চাই নিজের বাচ্চা নয়। কোনো মা গর্ভধারণ করার সাথে সাথে সেটি কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয়। কর্তৃপক্ষ সবসময় গর্ভবতী নারীদের একটি ডাটাবেজ রাখে। গর্ভধারণের চারমাস পার হলেই কর্তৃপক্ষ লটারির মাধ্যমে সন্তান অদল বদল করে দেয়। মাতা-পিতা জেনেশুনেই অন্যে সন্তান নিজের সন্তান হিসেবে ভালোবেসে যায়, বড় করে যায়। এ কারণে হুবেই তে কোনো সন্তানই অবহেলিত নয়, একটি শিশুও বেওরিশ নয়। সবার প্রতি সবার রয়েছে অসম্ভব মায়া। একবার একটি লোক গাড়ীতে ওঠার সময় ছিটকে পড়েছিল— সাথে সাথে দশ বারো জন হাজির, মুহূর্তের মধ্যে একটি অ্যাম্বুলেন্স চলে আসে, অ্যাম্বুলেন্সেই ছিল প্রাথমিক চিকিৎসার সামগ্রী এবং একজন মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্ট। তারা লোকটিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। পুলিশ এসে সমবেদনা জানায়। এবং হাতে কিছু টাকা দেয়। অথচ লোকটি নিজের দোষেই গাড়ীতে উঠতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল।
সর্বশেষ আমরা ‘অন্যআলো’ তে যাই। ‘অন্যআলো’ হচ্ছে হুবেই-এর আধ্যাত্মিক জগৎ। পাঠাগার, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সব সেখানে মিলেমিলে একাকার। অন্যআলো তে আমরা গিয়েছি দুপুর বেলায়। দুপুরবেলায় সব দর্শণার্থীদের জন্য বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা আছে। তবে দেখলাম— যাদের সামার্থ আছে তারা খেয়ে একটি বাক্সে টাকা ফেলে যায়, তাতে প্রকৃতপক্ষেই যাদের বিনামূল্যে খাবার দেওয়া প্রয়োজন তাদেরকে বিনামূল্যে খাবার দেওয়া সম্ভব হয়। আমরা সন্ধ্যে পর্যন্ত অন্যআলো-তে ছিলাম।
‘মহামিলন’ নামে একটি বড় রুম আছে, রুমটি বড় হলেও সেখানে একসঙ্গে প্রবেশ করতে পারে মাত্র পঁঞ্চাশ জন। এক ঘণ্টা সময় কাটানো যায়। প্রথমে ধীরলয়ের দ’তিনটি গান গাওয়া হয়। কখনও ধারণকৃত গান বাজানো হয় না। কেউ না কেউ গায়। এরপর জীবন, জগৎ, প্রকৃতি এবং আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে পনেরো মিনিটের একটি বক্তব্য দেয়। বক্তব্য দেওয়ার জন্য আগে থেকেই কেন্দ্রীয়ভাবে বিজ্ঞজন আমন্ত্রীত থাকেন। পরের সময়টুকু ইয়োগার জন্য। এ সময় রুমের দেয়ালে ডিজিটাল পর্দা টেনে দেওয়া হয়— সেখানে কখনও ভেসে ওঠে রাতের সমুদ্র সৈকত, কখন গহীন অ্যামাজন জঙ্গল, কখনও মহাকাশ, কথনও পৃথিবীর বিখ্যাত সব চিত্রকর্ম। একটি মোহময় পরিবেশ তৈরি হয় ‘মহামিলন’ রুমটিতে। সত্যিই যেন অংশগ্রহণকারীরা ‘অন্য একটি জগতে’ কাটায় একটি ঘণ্টা। সর্বশেষে সবাই একসাথে একটি গান গায়—
তোমার হাতে আমার হাত
তোমাতেই আমার প্রণিপাত।
তুমি যে-ই হও না কেন
তুমিই আমার প্রভু,
আমরা সবাই
ছুটে যাই যখন কোনো প্রদীপ নিভু নিভু।
আমরা সবাই সবাইকে ভালোবাসি,
আমরা একসাথে বাঁচি কাঁদি হাসি।