পর্ব ২: বিস্ময়ের সে দিনগুলি

মসনী গ্রাম

পূর্ব প্রকাশের পর 

হিন্দুরীতি অনুযায়ী পিতা-মাতা বা বংশের কেউ মারা গেলে গুরুদশা হয়। পিতা বা মাতা মারা গেলে ত্রিশ দিন (কেউ কেউ কমও করে) অশৌচ পালন করতে হয়। অশৌচ পালন হচ্ছে—কিছু কঠোর নিয়ম মেনে চলা।

বিষয়টাকে আমি এভাবে দেখি—মানুষকে একটা নিয়মে বেঁধে দেয়া, যাতে সব ভুলে গিয়ে খুব দৃষ্টিকটুভাবে অাপনজন মারা যাওয়ার অল্পদিনের মধ্যে এমন কিছু করতে না পারে যা মানুষ হিসেবে শোভন নয়।

বিষয়টা হচ্ছে, আপনজনের সম্মানার্থে বাড়িতে কিছুদিন অন্তত বিষাদের একটা আবহ বজায় রাখা। কারণ, মানুষের বৈশিষ্ট হচ্ছে মানুষ দ্রুত সব ভুলে যায়। মাসিক অশৌচ ছাড়া বাৎসরিকও কিছু নিয়ম আছে, যেমন বছর না ঘুরলে বিয়ে করা যায় না, এরকম। 

তখন অামি না বুঝে পালন করেছি, আর সমাজের মানুষ নিয়মগুলো চাপিয়ে দিয়েছিল ধর্মীয় নিয়ম হিসেবে। সাধারণ মানুষের জানার গণ্ডি অতটুকুই এবং তা তাঁরা চাপিয়ে দিতে পেরে এক ধরনের গর্ব বোধ করে, আমার বেলায়ও তাই হয়েছিল।

পুরো পরিবার কী খাচ্ছে, কীভাবে থাকছে এসব বিষয়ে কারও কোনো আগ্রহ না থাকলেও অশৌচ পালন বিষয়ে সবারই যথেষ্ট আগ্রহ। নিয়ম ভাঙলেই কথা। এখন আমি চিন্তা করি, ঐ বয়সে এক খণ্ড কাপড় পরে এক মাস থেকেছি, মাটির পাত্রে তেল মশলা ছাড়া সেদ্ধ ভাত নিজে রান্না করে খেয়েছি। অবশ্য নিজেই রান্না করেছি সব সময় এমন নয়, দিদিমা, বা কোনো এক মাসি সম্ভবত রান্না করে দিত। কিন্তু আয়োজনটা ওরকমই। দিনে একবার খেতে হবে। স্নান করে এসে কাপড় প্রায় গায়েই শুকাতে হবে, এক পাশ কোমরে পেঁচিয়ে রেখে আর এক পাশ মেলে ধরে শুকাতে হবে, বিষয়গুলো এরকম।  

পিতা মারা যাওয়ার পর থেকে মামাদের বাড়িতেই আমরা পাকাপোক্তভাবে থাকা শুরু করি। আবার বাড়িতেও থাকি। বাড়িতে সুপারি হয়, সেগুলোর জন্য অন্তত বাড়ি থাকা দরকার। ঘরের অবস্থা ভালো নয়, খড়ের ঘর, বৃষ্টি হলে পানি পড়ে, রান্না ঘরে ডোঙা ফুটো, শুকনো কাঠ নেই, রান্নার কষ্ট, মায়ের মানসিক সমস্যা, ফলে সকল সমস্যা বেড়ে দিগুণ চারগুণ। এই যখন অবস্থা তখন বাড়ি থাকা আসলে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। 

এর মধ্যে শুরু হলে এক বিশাল ঝগড়া বিবাদ, গুরুদশার এক মাস না যেতেই দুই পাশে দুই ‘সুহৃদ’ শুরু করলো ফ্যাসাদ। আজ তাল গাছ কাটে তো কাল সুপারী পাড়ে, পরশু মাছের ঘের দখল করে, এরপর পুকুর, এভাবে সবকিছু তারা দখল করে নিলো এক মাস না যেতেই।

আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, প্রতিবেশীরা প্রায় সবাই তাঁদেরই পক্ষে, কেউ মৌনে, কেউ সরবে। শত্রুর শত্রু বন্ধু এই থিওরিতে আমরা হয়ে গেলাম সবার শত্রু, কারণ, আমার মামাদের এলাকার প্রায় সবাই শত্রুজ্ঞান করে, তা যেমন তাঁদের অহমিকার কারণে আবার অনেক ভুলের কারণেও, সবচে বড় কারণ হিংসা। পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত মামাদের সম্পদ-সম্পত্তি এবং প্রতিপত্তির ঠাঁট তাঁদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবং নিরাপত্তা ব্যুহ সঠিকভাবে তৈরি করতে না পারার কারণে দ্রুতই তাঁরা সবকিছু হারিয়ে ফেলে। আমরা যখন তাঁদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি তখন তাঁরা আসলে নিঃস্ব, মামলা মোকদ্দমায় সর্বস্বান্ত। পরিবারে চারপাঁচজন মানসিক রোগী আত্মপ্রকাশ করায় তাঁরা আরও বেশি শেষ হয়েছিল এবং অন্যরা সুযোগ পেয়েছিল।     

কেউ পাশে না দাঁড়ানোর কারণ হিসেবে আমাদের বেলায় অবশ্য আরেকটা কারণ যোগ হলো, সেটি হচ্ছে ‘দুর্ব ল’। মা ‘পাগল’ আর সাথে চারটে দুধের বাচ্চা, সহায় সম্পদ নেই, এদের পক্ষ নিয়ে লাভ কী? সংকীর্ণ স্বার্থপর ক্ষুদ্র মানুষের ভাবনার অবচেতন রূপটা এমনই হয় আজীবন, তাঁরা এভাবেই  লাভের অংকে বাঁচতে চায়, যদিও মরতে থাকে প্রতি মুহূর্তে।

পিতার মৃত্যুর এক মাস না যেতেই পিছনের পুকুরের ঘাট পাকা করার প্রযোজনিয়তা বোধ করে ফেলল দুই শরিক! দুই পাশের পিতার কাকাতো ভাইয়েরা। যেহেতু ভাগের পুকুর এবং আমাদের ভাগে অর্ধে ক, তাই সিঁড়ি বানানোর খরচ আমাদের দিতে হবে অর্ধেক। যদিও এই সিঁড়ি ব্যবহার করার সুযোগ এই মুহূর্তে  আমাদের নেই, বাড়িতে থাকা আমাদের পক্ষে আর সম্ভব হবে না। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।

ইতোমধ্যে সব তাঁরা দখল করে নিয়েছে, অজুহাত, অামার পিতার কাছে তাঁদের টাকা পাওনা আছে। তাহলে এখন ভাগের সিঁড়ি বানানের খরচ অাসবে কোথা থেকে? পাকা সিঁড়ি বানানোর অর্ধেক খরচ আমরা কোথা থেকে দেব? সমাধান তাঁরা নিজেরাই বের করে নিল।

পুকুর পাড়ে এবং রাস্তার ধারে ভাগের কয়েকটি তালগাছ ছিল, সেগুলো তাঁরা বেঁচে দিলো। ও দিয়ে শুরু হলো সিঁড়ির কাজ। যখন আমাদের পেটে ভাত নেই, পড়াশুনার খরচ নেই, স্কুলে যাওয়া নেই, ঘর থেকে পানি পড়ছে, তখন দেখতে হচ্ছে পুরাতন সিঁড়ি ভেঙে নতুন সিঁড়ির কাজ!

সুপারি বাগান নিয়েও শুরু হলো সমস্যা। এখন সুপারি পাড়তে চায় শরিকরা, ঘের পুকুর জমি দিয়ে পাওনা উুসুল হচ্ছে না। তখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে—মামা বাড়ি থেকে আমরা ল্যান্ডাপান্ডারা তখন বাড়ি আসি নিজেদের বাড়ি পাহারা দিতে, পিতা মারা গেলেন শ্রাবণ মাসে, তার পরেই সুপারির সিজন। একরাতে তো এক মামার সাথে খুড়োতো কাকাদের শুরু হলো ধাওয়াধাওয়ি। বিশ্বাস করুন, ওটা ভাবলে এখনও আমার বমি ঠেলে আসে।

মানুষ কতাট সংর্কীর্ণ অশালীন ও বর্ব র হয়ে রয়েছে পৃথিবীতে এখনও! ক্রমাগতভাবে দারিদ্র্য এবং অশিক্ষার মধ্যে থাকতে থাকতে  কিছু মানুষ যে ভীষণ অমানুষ হয়ে থাকে ভেতরে ভেতরে সেটি প্রথম টের পেয়েছিলাম সেই কাঁচা বয়সেই। আবার তাঁদের এই ‘মুর্খতার’ জন্য তাঁদের জন্য যে মায়াও তৈরি হয়েছিল তা এখন বুঝি।

সিঁড়ি বানিয়েই তাঁরা খান্ত হলো না। মাঠে গিয়ে জমি ঠেলে ঠেলে আটের এবং ভেতরের চারটা তাল গাছ নিজেদের মধ্যে নিয়ে নিলো। এরপর সেগুলো বিক্রি করে দিলো। গেলাম আমরা বাধা দিতে, বাঁশের বাড়িও খেলাম। তখনও মাসের অশৌচ শেষ হয়েছে কিনা ঠিক মনে নেই। ঐ শ্রাবণ মাসেই সম্ভবত। 

কিছুদিন পরেই আমার পঞ্চম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষা, বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার চাপ। তখন আগস্ট মাস। অশৌচ শেষ হয়ে আসল সেপ্টেম্বর মাস, পড়াশুনা শুরু করতে হবে, স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম, কিন্তু পড়াশুনা আর হয় না, ধীরে ধীরে ছাড়া গরু হয়ে যেতে থাকলাম।


চলবে।