কবিতার বিচার, কবিতা শুধু নয়, যেকোনো সাহিত্য কর্মের বিচার কোনোভাবেই কি পরিচিত মহলে বা সমসাময়িক কালের মানুষের কাছে ছেড়া দেওয়া যায়? অবশ্যই যায় না। প্রথম কথা হচ্ছে, সাহিত্যের বিচারভার কোনোভাবেই পাঠকের ওপর নয়, সাহিত্যকর্মের বিচার করবে সাহিত্যিক নিজে, সেটি টিকবে কিনা, পাঠক পড়বে কিনা, সে চিন্তা থেকে সাহিত্যকর্মের বিচার হবে না। সাহিত্যিক যদি নিজে তার লেখা তিনি গুরুত্বপূর্ন মনে করেন, তাহলে তিনি লিখে যাবেন। লিখে যাওয়া উচিৎ।
কবিতার বিষয়টি আরো দুর্বোদ্ধ। কবিতার পাঠক খুব কম হওয়াটা অলৌকিক নয়, কবিতাই হচ্ছে একমাত্র মৌলিক সাহিত্য যদি কবিতার লেখক অকবি না হন। মৌলিক সাহিত্য পড়বে এবং বুঝবে এমন পাঠক খুব বেশি আশা করা যায় না। কেউ যদি বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসটা একটু ঘেটে দেখেন তাহলে দেখবেন পৃথিবীর নামজাদা সাহিত্যেকেরা প্রত্যেকেই একটা লম্বা সময় জনবিচ্ছিন্ন ছিলেন। পারিপার্শ্বিকতা বুঝতে হবে, জনগণের সাথে থাকতে হবে, কিন্তু পাঠকের সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক লেখকের জন্য ভালো নয়।
বর্তমানে অকবিরা কবিতার সর্বনাশ করছে, একথা মিথ্যা নয়, তবে সৃষ্টিছাড়া পাঠকও সর্বনাশ কম করছে না। সবচে বেশি সর্বনাশ করছে ফেসবুক। ফেসবুকের ভোট যদি আপনি আপনার লেখার মানদণ্ড বলে মানেন তাহলে কোনোদিনই আপনি লেখক নন। যে ফেসবুক ব্যবহার করে শুধু ক্রেতা-বিক্রেতা খুঁজতে চায় সেও চলতি পথে আপনার লেখায় একটি লাইক নিক্ষেপ করতে পারে, তাতে আপনি আনন্দিত হলেও সেটি তো লেখার মানদণ্ড হতে পারে না, পারে কি?
ফেসবুক মূলত বাজারের চায়ের দোকানেরই প্রতিচ্ছবি, এখানে কোনো গাম্ভীর্য বা সিদ্ধান্ত আশা করা বোকামী। তবে হুজুগ তৈরি করাতে ফেসবুকের বিশাল ভূমিকা আছে। আমাদের পছন্দ তৈরি হয় মূলত সংখ্যাগরিষ্টের পছন্দ দ্বারা, একটু বিশ্লেষণ করলেই বুঝবেন বেশিরভাগ মানুষের নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত থাকে না, তাদের সিদ্ধান্ত তৈরিতে মূল ভূমিকা রাখে ট্রেন্ড। ফেসবুক মূলত এই ট্রেন্ডই।
“হুমায়ূন অহমেদ” নিজেকে ট্রেন্ডে পরিণত করে ফেলেছিলেন, এজন্য তার কাছ থেকে মূল্যবান তেমন কোনো সাহিত্যকর্ম জাতি না পেলেও তিনি ছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে, তাই বলে তিনি যে ভালো সাহিত্যিক ছিলেন না সে কথা বলা যাবে না।
তবে ট্রেন্ড তৈরি করা এত সহজ নয়, অনেক কম্প্রোমাইজ করা লাগে নিজের সাথে। এটা করতে হলে স্বকীয়তা বিসর্জন দিতে হবেই। সমকালের মানুষের চিন্তা-চেতনা প্রাধান্য দিয়ে সাহিত্য চর্চা করতে গেলে সে সাহিত্য মূলত ‘বাজারের গসিপের লিখিত রূপ’ বৈ কিছু নয়। এখন মানুষকে আপনি এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে চিন্তা করতে শেখাবেন, নাকি মানুষকে তার লেবেলে রেখে শুধু মজাটা দিবেন এবং নিজের লেখা বইয়ের কাটতি বাড়াবেন সেটি শুধু আপনার সিদ্ধান্ত নয়, অভ্যেসেরও বিষয়।
প্রকৃতপক্ষে সাহিত্য মানে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মধ্যে অন্তত একশো বছর দূরত্বের একটি সেতুবন্ধন তৈরি করা। সেখানে কে উঠবে কে উঠবে না সেটি বিচার করার দায়িত্ব সাহিত্যিকের হতে পারে না, সাহিত্যিকের কাজ নির্মোহভাবে লিখে যাওয়া, এবং বাজার তৈরির চেষ্টা না করে একটি সঙ্ঘ তৈরির চেষ্টা করা।
প্রশ্ন আছে তাহলে একজন সাহিত্যিকের জীবন চলবে কীভাবে? কোনো কর্ম বাজারে না ওঠালে তার মূল্য নির্ধারিত এ যুগে হবে কীভাবে? এ কারণে সাহিত্যিককে শুরু থেকেই দ্বিচারী হতে হবে, তাকে ক্ষমতাশালী এবং বিত্তশালী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে, অর্থাৎ লেখালেখির পাশাপাশি তাকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে হবে, যাতে উন্নত চিন্তাগুলোকে বাজারজাত করার জন্য সে কাজ করতে পারে। এটি শুধু ব্যক্তিগতভাবে করলে হবে না, এটা করতে হবে সঙ্ঘের মাধ্যমে।
সমকালের দশজন প্রকৃত সাহিত্যিক একত্রিত হয়ে যদি তাদের চিন্তার প্রসার ঘটাতে চষ্টা করে তাহলে সেখানে যে বাধাগুলো আসবে তা অতিক্রম করার সামার্থ এককভাবে কারও না থাকলেও সম্মিলিতভাবে ঐ দশজনের থাকার কথা। এটা সম্ভব হলে একজন প্রকৃত লেখককে পাঠকের মুখাপেক্ষী হতে হবে না, সমাজের কর্তব্যক্তিদের নির্বোধ মূল্যায়ন শুনে সন্তুষ্ট হওয়ার ভান করতে হবে না, সেগুলো সাথে সাথে অস্বীকার করে প্রকৃত ডিসকোর্স ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।
দিব্যেন্দু দ্বীপ