মৃত্যু পথে প্রতি কদমে জীবনটুকু যাপন করতে চাই সৌন্দর্যে

জীবিকার তাগিদটুকু বাদ দিলে আমি খুব পরিতৃপ্ত মানুষ। এর মানে এই নয় যে আমি অনেক কিছু পেয়েছি, বা পেতে চাইনি কিছুই। জীবনের খুব সুস্পষ্ট একটা মানে খুঁজে পাওয়ার চাইতে বড় লক্ষ্য কিছু থাকতে পারে না। পারে কি?

আপনি সব পাবেন, কিন্তু জীবনের লক্ষ্যে কখনই পৌঁছানো হবে না ঐ দার্শনিকতাটুকু না থাকলে। এটা ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু থাকা চাই। আসক্ত আবার নিরাসক্ত, উদাসীন আবার ভীষণ দায়িত্বশীল, চরিত্রবান আবার চরিত্রহীনও। গড়বড়ে লাগে, কিন্তু এসবই সত্য।

ক্ষমাশীল, যত্নবান —নিজের জন্য বা অন্য কারো জন্য অনেক সুন্দর শব্দ চয়ন করা যায়, কিন্তু জীবনে একটি শব্দের প্রয়োগ ঘটাতে না পারলে সব বুমেরাং হয়ে যায়। তা হচ্ছে— মৃত্যু! মৃত্যুতেই সকল সাম্যবাদ। আমি যদি গান গাইতে পারতাম, তবে মৃত্যুর জয়গানই গাইতাম। মৃত মানুষদের আমার ‍খুব মনে পড়ে। দুঃখ হয়, ঠিক পরক্ষণেই ভাবি— ওরাই সেরা, যে মরে যায় সে সেরা, বেঁচে থাকা মানুষদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর। বুঝতে চাই যে, মৃত্যুর পরে আসলে সবটাই স্বর্গ। এ সম্পর্কে দ্যা টেম্পেস্ট নাটকে শেক্সপিয়র চমৎকার  করে বলেছেন, “যে মরে যায়, সে আসলে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সবকিছু পরিশোধ করে যায়।”

মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়— একটু মরে দেখি। পারি না, নিশ্চিন্ত হতে পারি না কিছুতে। রোজ ভাবি একটু একটু করে রোজ আমি যে লক্ষ্যে পৌঁচাচ্ছি সেটি মৃত্যু বৈ তো কিছু নয়। তাই বলে জীবন থেকে পালাতে চাই না। পৃথিবীর ভোগবাদ আমাকে টানে, ভালোবাসা আমাকে দুর্বল করে। এজন্য মৃত্যু পথে প্রতি কদমে জীবনটুকুও যাপন করতে চাই যথাসম্ভব সৌন্দর্যে।

জীবনের কয়েকটা বৈশিষ্ট আমি মেনে নিয়েছি— যাত্রাপথে আপনি বন্ধু চাইতে পারেন না, কেউ একটু বেশি খাতির দেখাতে পারে মাত্র। সদরঘাট থেকে হুলারহাট যেতে সহযাত্রী যদি পাউরটি কলা খাওয়ায় তার মূল্য আছে, তাই বলে তার কাছে জীবন সঁপে দেওয়া চলে না।

মানুষ জন্মে শ্রেষ্ঠ হয়ে, মারা যায়ও সেভাবে। মাঝখানে শুধু উঁচু-নিচু। নিজের জীবনের মানদণ্ড অন্যের কাছে ছেড়ে দেওয়াটাই বড় বোকামী। সুখে থাকত বাদামওয়ালাও, যদি জানত বাদাম বেঁচা কতটা উপভোগ্য হতে পারে, এবং যদি ওতে পথিকের জীবিকা নির্বাহ হয়ে যায়! ঐ বোধটুকু তৈরি হয় সমাজ এবং জীবন দর্শনে। সমস্যা বোধের, সবসময় তা বিত্তের নয়।

সেদিন খুব মজা হল— এক কাপ কফি খেয়ে ঘণ্টা খানেক এক রেস্টুরেন্টে কাটাতে গিয়ে বাধল বিপত্তি। ওয়েটার আমাকে উঠিয়ে দেয় এক কোণায়। আমি কিন্তু এনজয় করেছি, অবাক হয়েছি বরং ঘাড় ধাক্কা না দেওয়ায়। এক কাপ কফি খেয়ে দোকানের একটা চেয়ার ঘণ্টা খানেক দখল করে রাখা যেতে পারে না। পৃথিবীতে কোথাও দখলদার হওয়া যাবে না, মানুষের দখল তো অবশ্যই না।

মানুষকে আমি চমৎকারই ভাবি। ঐ ওয়েটারকে অনেকক্ষণ দেখছিলাম বলে ও প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। আমি মৃদু হাসি দিতেই বলে, “কিছু লাগবে?” না। আমি তো এমনিতেই মানুষের দিকে তাকিয়ে সম্রাজ্য দেখি। কিছু লাগবে না, কারও কাছ থেকে না। কী বিশাল মহাকাব্য প্রতিটি মানুষ!

যেমন আমাকে মুগ্ধ করে নিখাদ ছলনায় ও এক নারী। সততা ও সতীত্বের ব্যবসাও যে আছে দুনিয়ায়! জীবন আমাকে হাসায়, জিতে যাই প্রতি মুহূর্তে জীবনে হারাবার কিছু নেই বুঝি বলে।


দিব্যেন্দু দ্বীপ