যেন পৃথিবীর উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে এক ঝাঁক পাখি, সবকিছু দেখে দেখে, কোনোকিছু গায়ে না মেখে, নিরন্তরের উদ্দেশ্যে। এভাবে সবকিছু দেখা হলে দুঃখগুলোও হেসে ওঠে সুগভির উপহাসে। ধরা যায় না ঠিক, প্রতিচ্ছবির আড়ালে মূল বক্তব্য লুকিয়ে থাকে, তবু প্রতিটা কবিতা শেষ হয় পাঠককে নির্ভার করে—যেন কিছুই হয়নি কারো জীবনে, শুধু পলকা হাওয়ায় উড়ছে সব, ভাসছে সব, সবই গান সবই শুধু কাব্যকথা। দ্বিতীয় মৃত্যুর অপেক্ষায় কবি বলে যায় তাঁর বিষাদছোঁয়া প্রথম মৃত্যুর কথা—পাঠক বুঝে নেয় এখনো তাঁর আকাঙ্ক্ষার অপমৃত্যু হয়নি। দ্বিতীয় মৃত্যুর গান কবিতাটি তাই জীবনেরই জয়গান।
শাহিদা সুলতানার কবিতাগুলো পরিশুদ্ধ প্রেমের, বিষাদের, বিরহেরও; তবে কোথাও এতটুকু বিপন্নতাবোধ নেই। ‘আজ রাতে’ কবিতার শুরুতে কবি বলছেন,
“আমি চলে যাচ্ছি
আমার চিরচেনা চন্দ্রনিবাস ছেড়ে
অন্ধকার কেটে,
বাতাসে ভর করে,
ডানায় ভেসে ভেসে
শীত শেষে যেমনটা ফিরে যায় অতিথি পাখি।”
শেষে এসে তিনি বলছেন,
“প্রিয়তম আমার,
তুমি কি আজ রাতে জ্বেলেছো মোমের আলো
আমার মঙ্গল কামনায়?
রেখেছো কি পানপাত্র হাতের নাগালে?”
চিরচেনা চন্দ্রনিবাস ছেড়ে চলে যাবার কথা বললেও, কবিতার ‘প্রিয়তমা’ নিজেকে অতিথি পাখির সাথে তুলনা করলেও পাঠক বুঝে নেয় অবিরত ভালোবাসার প্রত্যাশা রয়েছে কবিতাটিতে। নিজেকে আড়ালে করে ‘প্রিয়তমকে’ নিমগ্ন দেখতে চেয়েছেন তিনি পানপাত্র হাতে।
পৃথিবীর যত সাহিত্যপাঠ তার অধিকাংশই পুরুষের উক্তি। পুরুষ লেখক যখন তাঁর কাব্যে-উপন্যাসে নারীকে দিয়ে কিছু বলিয়েছেন সেটি হয়েছে কল্পনা নির্ভর—সম্পূরণ নারীর কথা হয়নি কখনো। কাব্যে নারী পুরুষের ভেদরেখা নেই, কবিতার লিঙ্গান্তর হয় না নিশ্চয়ই, কিন্তু শাহিদা সুলতানার ‘এক বিষণ্ণ রোববারে’ কাব্যগ্রন্থটিকে নারীর উক্তি বললে অত্যুক্তি হবে না।
কবিতাগুলো পরাবাস্তব, দৃশ্যত কল্পনাশ্রয়ী, প্রতিটি কবিতার প্রতিটি স্তবকে রয়েছে অন্তঃসলিলা জীবনকথা—সে জীবন প্রধানত নিকষিত নারীর, সে জীবন মানুষের।
এরপর ‘নষ্টস্বপ্ন’ কবিতায় কবি লিখেছেন—
“পড়ে থাকে শূন্য ঘর
পরিত্যক্ত আশীর্বাদ,
ছেড়াঁ পাতা
শীতল কোকের খালি ক্যান
পড়ে থাকে অনুচ্চারিত শব্দের
ভুল বোঝা মিথ।”
কবি এখানে কিন্তু ‘প্রিয়তমার’ হাতে পানপাত্র তুলে দেননি, যুক্তিবোধে নিভৃত করতে চেয়েছেন কবিতার প্রিয়তমাকে।
প্রেম শুধু স্বর্গীয় নয় শাহিদা সুলতানার কবিতায়, লোক চক্ষুর আড়ালে বয়ে যাওয়া নেশা আছে, সে শুধু ধ্রুপদী প্রেমের নিমিত্তে নয়, দৈনন্দিন প্রয়োজনেও।
‘অপেক্ষা’ কবিতাটি শেষ হয়েছে বৃষ্টি ঝরা রোমান্টিক দিনের প্রত্যাশায়। অপেক্ষার অবসান হয় না তাঁর—বৃষ্টি নামে অঝোর ধারায়, কিন্তু সে ভিজতে পারে না, দ্বিধান্নিত মন উচাটন হয়েও অবশেষে মেনে নেয় বন্ধন।
‘একইভাবে দোল খায় সমুদ্র’ কবিতায় কবি লিখেছেন,
“তোমার কাছে কিছু চাইতে আমার সময় লাগবে,
কিছু দিতেও,
এক দ্বিধার সাগর পেরিয়ে
আমরা এসেছি,
তুমি আমি দু’জনেই।”
কবিতাটির শেষ স্তবক পড়ে পাঠক দ্বিধান্নিত হয়—
“এখনো রাতভর শিশিরের মায়ায়
শান্ত হয় উত্তপ্ত ব্রক্ষ্মাণ্ড,
সন্ধ্যায় ডুবে যাওয়া সূর্য
পা টিপে বেরিয়ে যায়
সমুদ্রের দরজা ঠেলে
ভোরের লাজুক আলোয়।”
পাঠক দেখতে পায় এভাবে সমুদ্র শুধু তীরে দোল খায়, অবশেষে গভীরে গিয়ে শান্ত হয় দার্শনিকের ভাবে। উত্তপ্ত ব্রক্ষ্মাণ্ড শান্ত হলে আবার বিষাদ ঘিরে ধরে তাকে। নিরন্তর অজ্ঞাত যে অপেক্ষায় ছেদ পড়েছিল আদী অকৃত্রিম যতিচিহ্নে বারংবার তাকে তা ঘিরে ধরে দিগুণ হয়ে।
“তারপর?
কলম্বাসের জাহাজে
আবার সেই পুরানো
একলা ভ্রমণ,
অজানা অপেক্ষায়।”
ঘুরেফিরে কবি ফিরে গিয়েছেন নির্জনতায়। বিজলী আলোর ঝলকানির মতো কিছুক্ষণ জীবন প্রদীপ জ্বেলে আবার তিনি ডুব দিয়েছেন তাঁর প্রথম মৃত্যুর গানে।
“আমিও বাঁচার আনন্দে
বাঁচবো সারাবেলা
নীড়ে ফেরা পাখির মতো,
অথবা বাঁচবো ইঁদুরের মতো
মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে।
প্রতিটা গভীর রজনীতে গলায় ঢেলে দেয়
অমৃত গরলের তলানী বিন্দু
হয় তীব্র আনন্দের নয় গভীর বিষাদের।”
তাঁর কাছে আনন্দ-বিষাদ মিলেমিছে একাকার হয়েছে, জীবন যেন ঠিক উপসংহারে পৌঁচেছে। কোনো দুঃখ নেই, দুঃখবোধের কারণগুলো পরিণত হয়েছে জীবন কাব্যে, তা শুধু কবিতায় নয়, পাঠক মনে করতে বাধ্য হয় কবি নিজেও যেন ডুবে রয়েছেন এমন কোনো বিষাদছোঁয়া আনন্দে।
সবই যেন রঙ, শাহিদা সুলতানার কবিতায় দুঃখগুলো রঙীন, সুখেরও নেই ভিন্ন কোনো আকর। সুখ-দুঃখ মোহনায় গিয়ে মিশে সৃষ্টি করেছে বিশেষ এক জৈবনিক ঘুর্ণাবর্ত। কবিতাগুলো রঙধনুর মতো একটা প্রতিচ্ছবি এঁকেছে শুধু।
কাব্যগ্রন্থটি পাঠককে চিনিয়েছে একটি ভ্রমণপথ, যে পথে পথিক শুধু স্মৃতি বয়ে নিয়ে যায়—প্রবল অনিচ্ছায়।
“এসো শেষ করি
পুরানো জং ধরা কাঠে
অবেলায় এই সেতু বানানোর খেলা,
বহতা নদীর বুকে
যা কেবল বাড়ায় ওজন।”
এক প্রকার বিষাদের ছায়া আছে সমগ্র কাব্যগ্রন্থজুড়ে, প্রতিটি কবিতায়। পাঠক, একটু গভিরে দৃষ্টি দিলে বুঝতে পারবেন কবির ‘প্রিয়তমা’ মোটেও দুঃখপিয়াসী নয়—শুধু তীব্র স্রোতে ভালোবাসার টানে ভাসিয়ে নিতে হয় তাকে, ভণিতাটুকুও হতে হয় ধ্রপদী, যেন কিছুতে সে তা বুঝতে না পারে।
“কতো প্রজন্ম পর আমি ভিজলাম,
ত্বকের রন্ধ্রে যে চৈত্রের ফাটল,
ভেবেছিলাম এক কালবৈশাখীর আবির্ভাব ছাড়া
মিটবে না সেই তৃষ্ণা,
কোথ্থেকে এলো এই বরষা কে জানে,
অভাবিত অথচ প্রিয় আমন্ত্রণ পত্রের মতো।”
জীবন জীবনের মতোই থাকে ‘এক বিষণ্ণ রোববারে’ কাব্যগ্রন্থে। নিষ্কলুষ হবার বাসনা নেই, আবার আকাঙক্ষাই একমাত্র গন্তব্য হয়ে ওঠেনি। কাব্যগ্রন্থটি যেন একটি পরিক্রমা, ক্লান্তি-অবসাদ-দুঃখবোধ জমে জমে স্তুপাকার হলে ভূমিকম্পে হিমালয় ধ্বসে পড়ার মতো হঠাত তা মিলিয়ে গিয়েছে—ইংরেজিতে বলায় যায় ‘টারবুল্যান্ট হ্যাপিনেস’ এ।
“বৃষ্টিতে ভিজেছো তুমি,
বৃষ্টিতে ভিজেছি আমি,
জলের তোড়ে চুপসে গেছে চুল, ভ্রু,
স্বপ্ন এসে সপ্তর্ষির গলুয়ে ভর করে।”
তবু দূরত্বটুকু যেন কোনোভাবেই ঘোচে না—কখনো জীবন বাস্তবতায়, কখনো সম্ভ্রমের ত্রস্থতায়।
‘ভার্চুায়াল প্রেম’ কবিতায় কবি বলছেন,
“এই উচ্চ প্রযুক্তির অভ্যস্ত জীবনে,
প্লেটনিক প্রেমের স্লোগান উপক্ষো করে
এরকম মাতাল বর্ষায়
কেন যে তোমার বুকে কান পেতে
হৃদপিণ্ডের গল্প শুনতে ইচ্ছে করে কে জানে।”
অভ্যস্ত জীবন, নিয়ম-অনিয়মের সবই তাঁর চেনা, কিন্তু কোথাও সে অবস্থান করে না, চলতে থাকে গ্রান্ড ক্যানিয়নের মধ্য দিয়ে চলতে থাকা পরিব্রাজকের মতো অজানা এক গন্তব্যের নেশায়।
বিষণ্ণ রবিবার
বিষণ্ণ বিয়োগ ঘণ্টা
বিষণ্ণ মোমবাতি
বিষণ্ণ লেসফিতা
বিষণ্ণ গাউন
বাঁশের ঝুড়িতে বসে
বিষণ্ণ বিড়াল
বিষণ্ণ গোলাপ, বিষণ্ণ পানীয়
বিষণ্ণ অর্কেষ্টায় বাজে
বিষণ্ণ সুর
বিষণ্ণ কুয়াশায়
বিষণ্ণ গমক্ষেত
বিষণ্ণ ডায়েরি
আর বিষণ্ণ মুক্তির গান।