পুরো পরিবারটা এখন আছে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে, এ কষ্ট ক্ষুধার নয়, অভ্যেসের। কেউ কারো অভ্যেস অনুযায়ী চলতে পারছে না। শহিদুল ইসলাম নিয়ম মেনে দুটো কাজ করে— বিকালবেলা জিমে যায়, জিম থেকে এসে জম্পেস একটা গোসল করে। দামী শ্যাম্পু, দামী সাবান মেখে গোসল করে, গোসল সেরে গায়ে ফরাসী সুগন্ধী মাখে। স্ত্রী রিজিয়া অবশ্য এসব দেখে না— তারও বিভিন্ন ব্যস্ততা, নিজস্ব অলসতা এবং আক্ষেপ রয়েছে। তাছাড়া স্বামীকে সে ভীষণ ঘৃণা করে, যা সে কখনই মুখে বলে না।
শহিদুল ইসলাম সন্ধ্যেয় রোজ আড্ডা দিতে বের হয়, পরিবার এটাই জানে। আড্ডা সে দেয় ঠিকই, তবে তার আগে ঘণ্টাখানেকের একটা কাজ সেরে নেয়। রোজ যে সে এটা করতে যায়, তা নয়, সপ্তাহে দুইএকবার। এর আগে তার এসকর্ট ম্যানেজ করতে অনেক বেগ পেতে হত, এখন আর কোনো কষ্ট হয় না। নেট ঘেটে গোপন একটা সাইটের সন্ধান পেয়েছে, তারা এসকর্ট পাঠায়। ঢাকা শহরের নতুন আবাসিক এলাকা আফতাবনগর, সেখানে একটা ফ্লাট আছে ওদের। শহীদুল ইসলাম সেখানে একটি রুম ভাড়া নিয়ে রেখেছে। ফোন দিলে এসকর্ট পাঠিয়ে দেয়। লেনদেন সব অনলাইনে সারতে হয়। শহীদুল ইসলামের মন বড়, তাই কাজ শেষে কিছু বকশিসও দিয়ে দেয় ললনাকে।
প্রায় একমাস হয়ে গেল জনাব শহীদুল গৃহবন্দী। জিমেও যেতে পারছে না। দালালরা অবশ্য মেইল পাঠিয়ে বলেছে যে, বিশেষভাবে এসকর্টের ব্যবস্থা করতে পারবে, যদি সে চায়। চাইলে করোনার সময়ে একজনকে সে পারমানেন্ট করে নিতে পারবে, ঐ রুমটাতেই সে থাকবে, যখন ইচ্ছে জনাব শহীদুল সেখানে যাবে।
শহীদুল ইসলাম এখনো এ বিষয়ে মনস্থির করতে পারে নাই। বনশ্রী থেকে খালটা পার হলেই আফতাবনগর। রাজী হলে মন্দ হয় না, কোনোভাবেই ঘরে আর থাকা যাচ্ছে না। ছেলেমেয়েগুলোও হয়েছে বেখাউজ, বাপকে একটুও সম্মান করে না। শহীদুল ইসলাম ভেতরে ভেতরে ফোঁস ফোঁস করে, কিন্তু কিছু বলতে পারে না। বললেই, উত্তর আসে— “ঘুষ খেয়ে ধরা পড়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত হইছো, আবার নীতিকথা শেখাইতে আসো।” এই কথা শোনার পর শহীদুলের ইচ্ছে হয় পরিবার ছাড়ে চলে যেতে, কিন্তু পারে না— সম্পদের মোহ, সন্তানদের উপর অধিকারের মায়া ছাড়তে পারে না। তাছাড়া বেশিরভাগ সম্পদ তো স্ত্রীর নামে, শাশুড়ির নামেও আছে, চাকরিকরাকালীন নিজের নামে বেশি কিছু করতে পারেনি, করলে ধরা পড়ার ভয় ছিল। শেষ রক্ষা হয় নাই তাতে, বিশাল একটা দাইন মারতে গিয়ে ধরা খাইয়ে গেছে। তাতে অবশ্য সব শেষ হয়ে যায় নাই। প্রায় একশো কোটি টাকার সম্পদ সে করতে পেরেছে। এখন চেষ্টা করছে যেখানে যা আছে সব নিজের নামে করে নিতে।
দালাল ব্যাটা ই-মেইলে এসকর্টের ছবি পাঠিয়েছে। এক্কেবারে কচি মাল। বয়স পনেরো ষোলোর বেশি হবে না, এই বয়সেই সারা শরীর থেকে যৌবন বাইয়ে পড়ছে। শহীদুল ইসলামের জীভ লকলক করে ওঠে। রাজি হয়ে যায়। আজকে সন্ধ্যেয়ই যাবে সে।
নারীর ঘ্রাণ শক্তি প্রবল। শহীদুলের হাবভাব দেখেই রিজিয়া বুঝতে পারে সব, কিন্তু মুখ খোলো না। স্বামীকে সে নিকৃষ্ট জানে, তাই ফাও কথা বাড়াতে চায় না, একগাদা মিথ্যে কথা শুনতে রোজ রোজ কার ভালো লাগে? ছেলেমেয়েগুলোও জানে তার বাপ কেমন, তবু বাপ তো, তাই কিছুটা শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসা থাকাটাই স্বাভাবিক, তাছাড়া বাপের সম্পদের ওপর ভর করেই তো তারাও যা ইচ্ছে তাই করতে পারছে। কুট্টি ছেলেটাও এই বয়সে একটা ‘গার্ল ফ্রেন্ড’ জোটাইছে। বড় ছেলেটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, রোজ হাত খরচ নেয় এক হাজার টাকা। বনশ্রী হাসপাতাল গলিতে শহীদুল ইসলামের একটা ওষুধের দোকান করা ছিল ভাইয়ের নামে, যখন সে চাকরি করত তখন দোকানটা করেছিল আয় দেখাতে। দোকানটা ভালো চলে বলে এখনো আছে। বলতে গেলে প্রায় বিনালাভে ওষুধ বিক্রি করত দোকানের বিক্রি বাড়াতে, ফলে দিনদিন কাস্টমার বেড়েছে। এখন প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকা ব্যবসা হয়। শহীদুল ইসলাম ওখান থেকে একলাখ টাকা নেয়, বাকী টাকা কর্মচারীরা নেয়। দোকানে বলে দেওয়া আছে– ওখান থেকে রোজ গুণধর ছেলে এক হাজার টাকা নিয়ে যায়।
শহীদুল ইসলাম না পারতে ছেলে মেয়ের সামনে পড়তে চায় না। ডুপ্লেক্স বাসা, একপাশে তার ছেলে মেয়ে এবং জনাব শহীদুল ইসলামের মা থাকে, আরেক পাশে তারা স্বামী-স্ত্রী। মায়ের অবশ্য প্রিয় সন্তান শহীদুল ইসলাম, তাকে এত আরামে আর কোনো ছেলে রাখতে পারেনি যে।
তাড়াতাড়ি গোসল সেরে নেয় জনাব শহীদুল। সুগন্ধীর শিশিটায় চাপ দিয়ে দেখে খালি। কিছুই বুঝতে পারে না। কালকেই তো এটা খোলা হল, তাহলে কীভাবে খালি হয়ে গেল! স্ত্রীকে সে ভয় পায়, তাই কথা বাড়ায় না। দামী সুগন্ধী ছাড়া জনাব শহীদুল বাসার বাইরে যায় না। আজকে কীভাবে যাবে? তাছাড়া কম বয়সী নতুন এসকর্ট, করোনার সময়ে এটা তো বদল করা যাবে না, খুশী করে রাখতে হবে। শিশির মুখটা খুলে টিপে টিপে যতটুকু বের হয় গায়ে লাগিয়ে নেয়।
বাসায় সে নিজেই একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করেছিল যাতে কেউ বাইরে না যায়। অর্ডার দিলে সবইতো দরজায় চলে আসে, বাইরে যেতে হবে কেন? আজকে সে নিজে তাহলে ‘কী’ বলে বের হবে? একটা উপায় বের করে— বলে, করোনার জন্য বনশ্রী এলাকায় ত্রাণ দেওয়া হবে, আমাকে ত্রাণ কমিটির প্রধান করেছে, ওদের আর ‘না’ করতে পারলাম না। একদিন বাদে একদিন দুই ঘণ্টার জন্য বের হতে হবে। রিজিয়া শুধু শোনে, সে ধরেই নিয়েছে শহীদুল সবই মিথ্যে কথা বলে। তাই ছেলেমেয়েদের বলার জন্য শুধু কথাটা শোনে। বিশেষ করে ছোট মেয়েটাকে বলতে হয়।
শহীদুল আর আগেপিছে তাকায় না, একমাস পরে সে যেন মুক্তি পেয়েছে। বনশ্রী এবং আফতাবনগরের মাঝখানের সাঁকোটা পেরিয়ে দ্রুত ফ্লাটে চলে যায়। সুনসান ফ্লাট, একটি মেয়ে এসে দরজা খুলে দেয়। ছবিটি দেখে দেখে জনাব শহীদুলের মুখস্থ হয়ে গেছে, তাই বুঝতে পারে এই মেয়েটি সেই মেয়েটি না। মেয়েটি নাম জিজ্ঞেস করে, শহীদুল ইসলাম ছদ্ম নামটি বলে। সাথে সাথে মেয়েটি তাকে তিন নম্বর রুমে পাঠিয়ে দেয়। করোনা কালের নিয়ম মেনে শহীদুল ইসলাম এবং মেয়েটি এতক্ষণ কথা বলেছে। যদিও শহীদুলের ইচ্ছে করে— হাতে যেটা আছে থাক, আজকে না হয় এই মেয়েটির সাথেই সময়টা কাটিয়ে যায়। করোনার ভয়ে তা আর করে না। রুমে ঢুকে দেখে, মেয়েটি গম্ভীর হয়ে বসে আছে। শহীদুল নাম জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি ছদ্মনাম বলে— সাথী। জনাব শহিদুল একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে, “বুঝছি, তোগো সবার নামই সাথী।”
মেয়েটির বয়স কম, অভিজ্ঞতাও কম, শহীদুল তার দ্বিতীয় কাস্টমার। মেয়েটির খুব গল্প করতে ইচ্ছে করে। সে জনাব শহীদুলকে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কী করেন?” জনাব শহীদুল খুব গম্ভীরভাবে বলে, “আমি একজন স্বেচ্ছায় অবসরপ্রাপ্ত ডেপটি সেক্রেটারি। এখন লেখালেখি করি। মেয়েটি মুচকি হাসি দেয়, বলে, “ডেফটি সেক্রেটারি মানে কী?” “কেন, তুই কি একেবারে পড়াশুনা জানিস না?” “জানি, এইট পর্যন্ত পড়েছি।” শহীদুল বলে, “তাহলে শোন, ম্যাজিস্ট্রেটের নাম শুনেছিস? আমি ছিলাম ম্যাজিস্ট্রেট, এরপর আরো বড়, আরো বড় —তুই তো সেসব বুঝবি না।” আরকিছু বোঝার দরকার পড়ে না, উলঙ্গ নারী দেহ সর্বোচ্চ কেতাবী পুরুষেরও সবটুকু বুঝে নেয়; আর শহীদুল তো ঘুষখোর, নির্যাতনকারী, নিকৃষ্ট, চাকরি থেকে ছাটাই হওয়া একজন ডেফটি সেক্রেটারি মাত্র।
একমাসের ব্যবধানে জনাব শহীদুল ইসলামের শরীরে পশুত্ব ভর করেছে। মেয়েটি অভিমানের সুরে বলে, “আপনি আর আসবেন না।” জনাব শহীদুল মেয়েটিকে একটি ছোট্ট চুমু দিয়ে দুই হাজার টাকা দেয়। প্রায় তিন ঘণ্টা সে মেয়েটির সাথে কাটিয়েছে। সাঁকো পেরিয়ে আসার সময় দেখে কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে। শহীদুল জানতে চায়— তারা রামপুরা থানার অধীনে কিনা। নিজেকে ডেফটি সেক্রেটারি বলে পরিচয় দেয়। পুলিশগুলো একটু আড়ষ্ট হয়, ‘স্যার’ বলে সম্মোধন করে। শহীদুল মাথা নাড়িয়ে বলে, “আপনার কী যে কষ্ট করছেন, এত রিস্ক নিয়ে কাজ করছেন।” নিজের স্বেচ্ছা অবসরের কথাও জানিয়ে দেয়। “দেখুন, সামাজিক কাজ করব বলে চাকরিটা আর করলাম না, আর জানেন তো এদেশে সৎভাবে চাকরি করাও তো খুব কঠিন। আপনারা মনোবল হারাবেন না।” পুলিশ কনস্টেবলগুলো শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ায়। শহীদুল চলে আসে।
বাসার সামনে গলিতে এসে দেখে কয়েকটি ছেলে একটি ভ্যানে কিছু চাল, আলু , পেঁয়াজের প্যাকেট নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। জনাব শহীদুল খোঁজ নেয়। ওরা পাশের ভুইঞাপাড়া বস্তিতে কিছু খাবার দিতে যাচ্ছে। শহীদুল বলে, “মাত্র এই কয়টা প্যাকেট কয়জনকে দিবি?” ব্যস্ত হয়ে পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে তাতে দশ হাজার টাকা লিখে সই করে দেয়। ওষুধের দোকানে ফোন করে দেয়। ওদের বলে রিজিয়া ফার্মেসি থেকে দশ হাজার টাকা নিয়ে আরো কিছু চাল আলু কিনতে। ছেলেগুলো খুব খুশি হয়ে যায়। শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে একসাথে বলে, “চাচা, সালামুআলাইকুম।”
এদিকে বাসায় লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে ফেলেছে শিমুল। বলছে, তারা আব্বা যেন কিছুতেই বাসায় না ঢোকে। ছোট মেয়েটিও বলছে, “মা, আব্বা কেন বাইরে গেল?” আসলে রিজিয়াই আজকে ছেলেমেয়েদের খেপিয়ে তুলেছে যাতে সে স্বামী থেকে আলাদা হতে পারে। দরজা খোলাই ছিল, শহীদুল বাসায় ঢুকে দেখে রিজিয়া নেই। ফোনে চিৎকার করে ডাকে। রিজিয়া জানিয়ে দেয়— আমি এখন থেকে এই পাশেই থাকব, তুমি ওপাশে একা থাকো, তাতে তোমার সুবিধেই হবে। তাছাড়া আমাদের ভয় করছে যে, তুমি করোনা বাধিয়ে নিয়ে আসতে পারো। ওরা খুব রাগারাগি করছে। জনাব শহীদুল ইসলাম ছেলেমেয়েদের ‘বাস্টার্ড’ বলে গালি দিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বোঝে।
শেকস্ রাসেল
লন্ডন, যুক্তরাজ্য