ছোটগল্প: খুন // দিব্যেন্দু দ্বীপ

কালিপূজো

বস্তির ছেলে রবীন, বয়স দশ বছর, কিন্তু আচরণে তা বোঝার উপায় নেই— মনে হয় মাত্র চার পাঁচ বছর বয়স। কথা বলে খুব কম, ‘যাব না’, ‘খাব না’— এ ধরনের সামান্য দুএকটা কথা বলে সে। মা ছাড়া একান্ত আপনজন রবীনের আর কেউ নেই। বস্তির অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে ওর পড়ে না। পড়বে কী করে? অন্যরা যখন ক্রিকেট খেলে, অন্যরা যখন ফুটবল খেলে, অন্যরা যখন দৌঁড়াদৌঁড়ি করে— ও তখন বেশিরভাগ সময় একটি কাজই করে— অদ্ভূত এক শূন্য দৃষ্টিতে সবকিছু দেখতে থাকে। সবাই ওকে ‘পাগল’ বলে এড়িয়ে যায়। ও দু:খ পায় না, অন্যের আচরণকে ও পাত্তা দেয় না, ও নিজের মতো করে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে নেয়। আসলে ওর পৃথিবীর সাথে অন্যদের পৃথিবী কিছুই মেলে না। 

দুই বছর হলো সবাই ওর সাথে এক রকম নিষ্ঠুর আচরণই করছে। রবীনের মা হঠাৎ মারা যাওয়ায় ওকে দেখার মতো তেমন কেউ আর নেই। বাবা আবার বিয়ে করেছে, সৎ মা কোনোমতে দু’টো খেতে দেয়। ফলে রবীনের জগৎটা আরো বেশি বদলে গেছে– চারপাশের সবকিছুকে রবীন এখন মিলিয়ে মিলিয়ে দেখতে শিখেছে। শিক্ষা ওকে কেউ দেয়নি, ও নিতেও পারে না, ওর পৃথিবীর শিক্ষায় ও নিজেই প্রতিদিন একটু একটু করে শিক্ষিত হচ্ছে।

কিছুদিন ধরে প্রতিটি হত্যাকাণ্ড ও ‍খুব নিখুঁতভাবে দেখে। একদিন কয়েকটি ছেলে উল্লাস করে সারিবদ্ধ পিঁপড়ার লাইন পায়ে ডলে দিচ্ছিল— ও ভাবছিলো এটা কি ঠিক? কিছু না বুঝলেও এটা অন্তত ও বুঝেছে যে (বুঝতে বাধ্য হয়েছে), সবকিছু ঠিক আছে, শুধু ও ভুল। নিজের অদ্ভূত জগত, সৎ মায়ের ধমক, রাতে বাপের ধমক, বাইরে সবার অবহেলা এবং অনাদরে থেকে থেকে ওর শুধু মনে হয় যেভাবে হোক সবার মতো হতে হবে। ও চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতেই পেরে ওঠে না, সবার মতো হতে ও পারে না। 

অনেক চেষ্টা করে আজকে খেলার মাঠে নেমে আবার উঠে আসতে বাধ্য হয়— বাইশ জনের মধ্যে ওর জায়গা হয় না। হতাশ হয়ে উঠে এসে মাঠের চারপাশে পায়চারি করতে থাকে, নিজের পৃথিবীতে ডুব দেয়। হঠাৎ বলটা এসে ওর সামনে পড়ে, ও চেষ্টা করে বলটা সবার মতো করে শট দিয়ে মাঠে ফিরিয়ে দিতে। বলটা ফিরে যায়, একইসাথে ও পিছনে চিৎ হয়ে পড়ে যায়। ঘটনাটায় ভীষণ মজা পেয়েছে রবীন আজ।

কিছুতেই ওর অন্যকিছুতে মন বসছে না ইদানিং, ওর ইচ্ছে করে হত্যাকাণ্ড দেখতে। সেদিন বাপে যখন মুরগী কাটছিল ও ডাগর ডাগর চোখে দেখছিল কীভাবে মুরগীটা ছটফট করছিলো, কীভাবে গলার নিচ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিঁটকে বের হচ্ছিলো। ও ভাবে, এটা কি ঠিক? ও মেনে নিয়েছে যে, অন্যরা যা করে সব ঠিক, শুধু ও ভুল। সারিবদ্ধ পিঁপড়া পায়ে দলে মেরা ফেলা ঠিক, মুরগীর গলা কেটে ফেলা ঠিক … ও এরকম আরো হত্যাকাণ্ড দেখতে চায়। 

বস্তির অদূরে হিন্দু পাড়ায় আগামী পরশু কালি পূজো। সকলে বলাবলি করছে— এবারের পূজোয় পাঠাবলি হবে একশো পঁচিশটা। ‘পাঠাবলি’ কী ও বুঝতে পারে না। রাতে একা একা বলতে থাকে— “পাঠাবলি হবে, পাঠাবলি হবে”। বিরক্ত হয়ে বাপে জিজ্ঞেস করে, রবীন কী কইতেছিস এসব তুই? ‘পাঠাবলি’ কী তুই জানিস? রবীন মাথা নাড়ায়। বাপে বলে, ‘পাঠাবলি’ হচ্ছে হিঁদুগো পূজো। ওসব আবার দেখতে যাস না যেন।

রবীন সারারাত ঘুমোতে পারেনি, শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়ায় উঠতে উঠতে দুপুর হয়ে গেছে। তড়বড়িয়ে উঠেই ‘পাঠবলি’ পূজো দেখতে রওনা হয়। গিয়ে দেখে সে এক এলাহীকাণ্ড। সারিবদ্ধভাবে কালো কালো পাঠা বাঁধা। ও ভাবে, ‘পাঠা বলি’, বলি মানে কী? বলি কখন হবে? ও পাঠাগুলোকে একটু ধরে দেখে, একটা পাঠার গায়ে হাত দিতেই মালিক দৌঁড়ে আসে, বলে, “ও খোকা, এগুলো পূজোর পাঠা, তুমি ধইরো না, স্নান না করে ধরা যায় না।” রবীন আবার দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। ‘পূজোর পাঠা’ আবার কী? ওর ইচ্ছে করে সবগুলো পাঠা একবার ধরে দেখে, কিন্তু সাহস পায় না। 

শেষ রাতে পাঠাবলি হবে, বিকাল পর্যন্ত থেকে রবীন বাসায় চলে আসে। ওর ইচ্ছে করে বাবাকে বলবে ‘পাঠাবলি পূজো’ দেখতে যাওয়ার কথা, কিন্তু ও শব্দ দিয়ে সাজাতে পারে না কথাগুলো, বলতে পারে না। বারে বারে শুধু বলছে— ‘পাঠাবলি পূজো’ ‘পাঠাবলি পূজো’। এতবার ‘পূজো’ ‘পূজো’ করায় রবীনের বাপ আতঙ্কিত হয়— এই বুঝি ‘ঈমান-আমল’ সব গেল। রবীনকে ধমক দিয়ে বাপে বলে, রবীন, কাল থেকে নামায পড়বি। রবীন তাকিয়ে থাকে, ‘নামায’ কী ‍ও বুঝতে পারে না। এবার বলতে থাকে— ‘পাঠাবলি’ ‘নামায’ ‘পাঠাবলি’ ‘নামায’। বাপে রেগে গিয়ে কয়, হালার জীবন, “মাগি পাগল একটা প্যাট দিয়ে বাইর করে রাইখা গেছে আমার লাগি!” সৎ মায় ওদিক থেকে চিৎকার করে জবাব দেয়, “অয়! দোষতো সব বেটিগো, পোলাডা বুঝি হাওয়ায় ভাইসা আপার পেডে ঢুকছিলো। ঢ্যামনা ব্যাটা একটা!” বাপে আর কোনো কথা কয় না। এ বউরে সে ডরায়, তার ওপর এমন পোলা থাকাতে কোনো কথা বাড়াতে চায় না। শত হোক নিজের ছেলের জন্য মায়া তো আছে। দুটো খাবারও যদি না দেয় …! 

রবীন আজ রাতে আর ঘুমায় না। ‘পাঠাবলি’ পূজো দেখতে সে যাবেই। ঢাকের বাড়ির শব্দ কানে ভেসে আসছে, কালো কালো পাঠাগুলো ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ঘোরের মধ্যে পাঠাগুলোর গায়ে হাত দিতে গিয়ে বাপের গায়ে হাত পড়ে। সাথে সাথে চমকে উঠে হাত সরিয়ে নেয় ও। বাপে ঘুম থেকে উঠে গেলে ‘পাঠাবলি’ পূজো আর দেখতে যাওয়া হবে না।

হঠাৎ ঢাকের বাড়ি থেমে যায়। “‘পাঠাবলি পূজো’ তাহলে শেষ হয়ে গেল নাকি!” তাড়াতাড়ি উঠে দরজাটা সাবধানে খুলে হিন্দুপাড়ার দিকে রওনা হয় রবীন। মন্দিরের সামনে কেবল প্রস্তুতি চলছে বলি দেওয়ার— পাঠাগুলো একটা একটা করে ধরে আনা হচ্ছে, মন্দিরে ঢুকিয়ে বিশাল কালি মূর্তির সামনে রেখে মাথায় ধারালো রাম-দা ছুঁইয়ে দেওয়া হচ্ছে। পাঠাগুলোর মাথায় ছিঁটিয়ে দেওয়া হচ্ছে তুলসীপাতা, দুর্বা এবং ফুল। এ দৃশ্য দেখে খুবই পুলকিত বোধ করছে রবীন। ভাবছে, তাহলে এখনই পাঠার গলা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হওয়া দেখা যাবে!

প্রথম বলিটা হবে— রবীন একেবারে সামনে চলে এসেছে। সবাই ‘জয় মা কালি’ ধ্বনি দিচ্ছে। ‘উলো ধ্বনি’ দিচ্ছে। হিন্দুপাড়ায় গত বছর একটি বিয়েতে ও এরকম ধ্বনি দিতে শুনেছিলো। খুব আনন্দ হয়েছিলো সেদিন। আজকেও নিশ্চয়েই অনেক আনন্দের দিন। ও আনন্দে হাততালি দিচ্ছে। ভাবছে, এখনই গলা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হওয়া দেখা যাবে। খুব আনন্দ হবে।

ও একে একে সবগুলো পাঠার বলি দেওয়া দেখে। মাঝে মাঝে কোদাল দিয়ে জমাট বাঁধা রক্ত সরিয়ে নেওয়া হয়। প্রত্যেকটি পাঠবলি দেওয়ার সময় ও হাততালি দিয়েছে। হাত ব্যথা হয়ে গেছে। আসার সময় পাঠার একটা মাথা তুলে কাটা অংশ দেখতে চায়। একজন ধমক দিয়ে সরিয়ে দেয়, বলে, তুই কেডারে? মাথা চুরি করবি নাকি?

রবীন ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ী চলে আসে। সকালে বাপে কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে কামে চলে গেছে। কাম না করলে খাবার নেই, পোলা নিয়ে তাই অত ভাবনাও নেই। রবীন বাড়ীতে আসলে কোনো কথা না বলেই ঢুকে যায় বাথরুমে, ঘষে ঘষে দুই পা পরিষ্কার করে। এই একটা কাজ ও ভালোমতো শিখেছে, ওর ধারণা হয়েছে— ঘষে ঘষে পা পরিষ্কার করাটা খুব জরুরী। শরীরের অন্য অংশে ময়লা থাকলে তা নিয়ে ওর তেমন ভাবনা নেই।

সৎ মা খাবার দেয়, ও খায়। কোনো কথা বলে না, যা পায় তাই খায়। ওর এটাও ধারণা হয়েছে যে, যা পাওয়া যায় তাই-ই খেতে হয়। আগে ওর অনেক কিছু খেতে ইচ্ছে করত, এখন করে না, ও সিদ্ধান্ত দাঁড় করিয়েছে— কোনো ইচ্ছে করা যাবে না, অন্য যা বলে তাই ঠিক। পিঁপড়ার সারি পায়ে দলে হত্যা করা ঠিক, মুরগীর গলা পোচ দিয়ে কাটা ঠিক, ‘পাঠাবলি পূজো’ ঠিক। 

গুলতি দিয়ে পাখি মারা দেখতে যাবে আজ দুপুরে। আগে যেত না, ভালো লাগত না। এখন ভালো লাগে, ও দেখতে চায়— কীভাবে কাঁচের বলের আঘাতে একটি পাখি ছটফটিয়ে নিচে পড়ে। এটা ভাবতেও ওর ভালো লাগে যে, কীভাবে একটি পাখি গাছ থেকে ছটফটিয়ে নিচে পড়ছে। পাখি আসলে ছেলে ছোকড়ারা মারতে পারে না। রোজ ঘোরাঘুরিই হয় শুধু। আজকে ঠিকই একটা পাখি মারতে পেরেছে কাউয়া মাণিক। রবীন পাখিটা হস্তগত করে কাউয়া মাণিকের পিছন পিছন হাটে। পাখিটার মাথা ঝুলে আছে, চোখ থেকে দু’এক ফোঁটা রক্ত গলে পড়েছে। রবীনের ভালো লাগে, পাখিটাকে এ অবস্থায় দেখতে ওর খুব ভালো লাগে।  

এর মাঝে রবীন একদিন বাপের সাথে হাটে যায়— ঢাকার শহরতলী হলেও এই হাটেও অনেকে আসে যারা মাছ কেটে নেয়। রবীন কই মাছ কাটা দেখতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও বাপে ওকে সরাতে পারে না। মুগুরের মতো একটা কাঠ দিয়ে কই মাছের মাথা প্রথমে থেঁথলে দিয়ে, এরপর দুইকান বটিতে বাধিঁয়ে খঁচাৎ করে ছিঁড়ে ফেলছে। রবীন মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে। মুগুর দিয়ে মাথায় প্রথম আঘাত করার সাথে সাথে মাছটি কেমন লেজ উপরে তুলে ছটফট করছে— অসাধারণ দৃশ্য, রবীন পাঠাবলি পূজোর কথা মনে করার চেষ্টা করে। রবীনের ভালো লাগে, খারাপ লাগলেই সাথে সাথে ও ভাবে, “মানুষ যা করছে সব ঠিক, আমি শুধু ভুল”।

কিছুদিন ধরেই মাইকিং হচ্ছে— “এক বিরাট গরু ছাগলের হাট।” রবীন গরু বুঝতে পারে, ছাগলও বুঝতে পারে, কিন্তু “এক বিরাট গুরু ছাগলের হাট” বুঝতে পারছে না। রবীন একটু আধটু কথা বলতে পারলেও কোনো প্রশ্ন করতে পারে না। ফলে নিজেই একটা কিছু ভেবে নেয় সে, ঘটনার সাথে ঘটনা মিলিয়ে যুক্তি দাঁড় করিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে। ফলে রবীনের বোঝাটা হয় প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে, কিন্তু সমাজ তো পরিচালিত হয় কিছু কনস্ট্রাকটেড থিওরি এবং রীতিনীতির ওপর ভিত্তি করে। ফলে রবীন নিজেও জানে না যে, সমাজের সাথে প্রবল সাংঘর্ষিক জায়গায় ওর চিন্তা ভাবনা বিকাশ লাভ করছে।

কোরবানি ঈদের আর মাত্র ছয়দিন আছে। বস্তির অদূরেই ধনী লোকের বসবাস। অনেকেই কোরবানির জন্য গরু কিনে বাড়ির সামনে বেঁধে রেখেছে। বাড়ী ঘুরে ঘুরে রবীন গরুগুলো দেখে বেড়াচ্ছে। বড় একটা কালো গরুর পিছনে একটু হাত ছোঁয়াতেই তেড়ে আসতে চায়। রবীন পিছিয়ে আসে। ও প্রত্যেকটি গরুর গলার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। ওর মনে পড়ে কীভাবে মুণ্ডুকাটা পাঠাগুলোর ধড় থেকে রক্ত ছিঁটকে বেরোচ্ছিল! গরুগুলোও কি বলি হবে— মনে মনে ভাবতে থাকে ও।

বাড়ীতে এসে বলতে থাকে— ‘গরু বলি’ ‘গরু বলি’ … বাপে শুধরে দেয়— ‘গরু কোরবানি’। রবীন হা করে বাপের দিকে তাকিয়ে থাকে! পাঠা বলি হলে গরু কেন কোব্বানি হবে? রবীন ভাবে, “আমি ভুল, সবাই ঠিক”। এবং বাপের কথামতো বলার চেষ্টা করে— ‘গরু কোব্বানি’। কিছুতেই বলতে পারে না, ও ভাবছে যে, ও বলছে। আসলে ও শুধু ভাবছে, মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না। 

কাল ঈদুল আজহা, মানুষ কোরবানির প্রস্তুতি নিচ্ছে— হোগলার পাটি, কাঠের টুকরো, কেউ কেউ ধারালো দা কিনে আনছে। রবীন খুবই পুলকিত বোধ করছে। গরুর গলা থেকে রক্ত ফিনকে দিয়ে বের হওয়া দেখার জন্য ও উদগ্রিব হয়ে থাকে। মানুষের কথা শুনে ও বুঝতে পেরেছে যে, আগামীকাল খুব সকাল থেকে ‘কোব্বানি’ শুরু হবে। আজ রাতেও ও ঘুমোতে পারছে না। এপাশ ওপাশ করতে করতে মধ্যরাতে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়ে। রাতে কালি মন্দিরের সামনে ‘গরু বলি’ দেওয়ার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের মধ্যেই ও হাত তালি দিতে শুরু করে। বাপে ঠেলা দিয়ে কয়, “কীরে, পুরাই পাগল হইছস? তয় রাস্তায় যা।” রবীন ভয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে।

সকালে উঠে ও দৌঁড়ে বের হয়ে যায়। বস্তি থেকে মাত্র একশো গজ দূরেই একটি পাঁচতলা বাড়ী। গতকাল বাড়ীর নিচে ও কয়েকটা গরু বাঁধা দেখে এসেছে। প্রথমেই ও বাড়িটির সামনে ছুটে যায়। গিয়ে দেখে একটু গরুর গলা অর্ধেক কাটা, চারপাশ রক্তে ভেসে গিয়েছে, পায়ের বাঁধন খোলা হচ্ছে। দশ হাত দূরে আরেকটি গরুর পা বাঁধা হচ্ছে। ও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আরো অনেক ছেলেমেয়ে ভীড় করে আছে চারপাশে। একজন হুজুর হাতে লম্বা ধারালো দা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

রবীন মেলানোর চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুই মিলছে না যে! পাঠাবলি তো এভাবে দেয়নি, তাহলে গরু …? সাথে সাথে ওর মনে পড়ে— ‘গরু কোব্বানি’, কিন্তু কিছুতেই গলা থেকে স্বর বের হয় না। শুধু শুধু মনে মনে ভাবে। হুজুর লম্বা ছোরা হাতে গরুটির দিকে এগিয়ে যায় … কয়েকজনে গরুটিকে চেপে ধরে আছে। একজনে গরুটির গলায় হাত বুলিয়ে জায়গা বের করে। হুজুর আরো কাছে যায়—  ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ধারালো ছোরাখানি গরুটির নরম গলায় চালিয়ে দেয়। মোটা ধারায় তাজা রক্ত বেরিয়ে আসে গল গল করে। সমবেত নারী পুরুষ শিশু সবাই একসাথে বলে ওঠে “নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার”। রবীন বুঝতে পারছে না, কেন সবাই আজকে ‘জয় মা কালি’ বলছে না। সাথে সাথে ও ভাবে, “আমি ভুল, অন্য সবাই ঠিক।” গরুটি কয়েকবার পা দাপানোর একটুখানি চেষ্টা করে, চেপে ধরায় খুব বেশি পারে না। রবীন খুব পুলকিত বোধ করে, হাত তালি দিতে থাকে।

অনেক দিন হলো রবীন একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে গেছে, যতটুকু যা একটু কথা বলতো তাও আর বলে না। ভালোই অগ্রগতি হচ্ছিল ওর, কিছু কাজ স্বাভাবিকভাবে করতে পারছিলো, হঠাৎ আবার থেমে গেল। ও এখন আর কারো মুখের দিকে তাকায় না, সবার গলার দিকে তাকাতে থাকে। উঠতি বয়সের মেয়ে এবং নারীরা ভাবতে শুরু করে— ছেলেটা আচ্ছা বেয়াদব তো! এই বয়সেই কেমন বুকের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। রবীন আরো কোণঠাসা হতে থাকে। অরো নিরিবিলি, আরো একা হয়ে যায় ও। তবু লুকিয়ে লুকিয়ে সবার গলার দিকে তাকায়। ও ভাবতে থাকে— ধারালো একটা ছুরি চালিয়ে দিলে মানুষের গলা থেকে কেমন ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হবে! “নাহ! কিছুতেই ও এটা ভাবতে চায় না।” “পরক্ষণেই ভাবে, সবাই ঠিক, আমি ভুল।” সারিবদ্ধ পিঁপড়া পায়ে মাড়িয়ে দেওয়া ঠিক, মুরগীর গলা কাটা ঠিক, গুলতি দিয়ে পাখির মাথা থেঁথলে দেওয়া ঠিক, পাঠাবলি ঠিক, গরু কোব্বানি ঠিক, তাহলে মানুষ …?

কিছুদিন হলো ও ভেবে পাচ্ছে না— মানুষের গলা কেটে রক্ত বের করা ঠিক কি ঠিক না। সার্বিক বিচার বিশ্লেষণ করে ও বুঝতে পারে যে, মানুষের গলা কেটে রক্ত বের করা যেতে পারে। ও আরো নিবীড়ভাবে সবার গলার দিকে তাকাতে থাকে। রাতে লাইট নিভাতে চায় না, বাপের গলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। একদিন তো প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিল— রান্নাঘর থেকে বটি এনে বাপের গলায় চালিয়ে দেবে। বাপকে খুব ভয় পায় বলে পারেনি। কিন্তু এই “ঠিক কাজটা” ওকে করতেই হবে। মানুষের গলা থেকে কীভাবে রক্ত বের হয়, মানুষ কীভাবে পা দাপায় ও দেখতে চায়।

রবীনদের পাশের রুমে এক দম্পতি থাকে, তাদের তিন বছর বয়সী একটা মেয়ে আছে। রবীন শিশুটির গলার দিকে রোজ তাকায়। ওর মায়ের গলার দিকেও তাকায়। শেষ পর্যন্ত এই শিশুটির গলা কেটে রক্ত বের করার সিদ্ধান্ত নেয় রবীন। এজন্য ও কিছু ফুল জোগাড় করে, ফুলগুলো কালি মন্দিরের সামনে রেখে আসে। এরপর সন্ধ্যায় শিশুটিকে কোলে করে নিয়ে যায় মন্দিরের সামনে। শিশুটির মাথায় তুলসীপাতা এবং ফুল ছিঁড়ে পাপড়ি ছিটিয়ে দেয়। সেদিন পূজোয় যেমন দেখেছিলো তেমন করে মা কালির দিকে তাকিয়ে ধারালো ছোরা শিশুটির মাথায় ছোঁয়ায়। এরপর ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ছোরা চালিয়ে দেয় শিশুটির গলায়। শিশুটি পড়ে গিয়ে ছটফট করতে থাকে। গলা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে, যেমন সে দেখেছিলো পাঠার এবং গরুর গলা থেকে বের হতে। রবীন হাততালি দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে শিশুটি নিস্তেজ হয়ে যায়। রবীন গলা কাটা অবস্থায় মৃত শিশুটিকে মা কালির পায়ের কাছে রাখে, ছোরাটি রেখে দেয় শিশুটির শরীরের উপরে, এরপর জোরে জোরে হাত তালি দিতে দিতে চলে যায়।

ভাবতে থাকে, “সবাই ঠিক, আমি ভুল, আমি ভুল।” সারিবদ্ধ পিঁপড়া পায়ে মাড়িয়ে দেওয়া ঠিক, মুরগীর গলা কাটা ঠিক, গুলতি দিয়ে পাখির মাথা থেঁথলে দেওয়া ঠিক, পাঠাবলি ঠিক, গরু কোব্বানি ঠিক, মানুষ বলিও ঠিক। “শুধু আমি ভুল, আমি শুধু ভুল, সবাই ঠিক।”


গল্পটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্ব প্রকাশিত হবে শীঘ্রই, চোখ রাখুন। এমনভাবে লেখা হবে যাতে প্রত্যেকটি পর্বকে একটি স্বতন্ত্র গল্প মনে হয়।