ছোটগল্প: জবানবন্দী

counseling জবানবন্দী

অভাবে সংসারে স্বামী আজকাল আরো বেশি করে অভাব ডেকে আনছে, হতাশার সাথে পাল্লা দিয়ে তার সিগারেটের নেশা বেড়েছে। মাসে যত টাকার চাল-ডাল লাগে তার চেয়ে বেশি লাগে তার সিগারেট। আমিও অবশ্য এদিক থেকে কচি তুলশী পাতা নই, একটুখানি পান পেঁচিয়ে পান খাওয়ার নাম করে তিনবেলা এক মুঠো করে জর্দা না খেলে আমার জীবন বাঁচে না। কী হয় জানি না, তবে খেতে পারলে ভালো থাকি। সুবিধা হয়, জর্দার খরচ সিগারেটের চেয়ে অনেক কম।

বাপের বাড়ি থেকে কিছু আনো আনো বলে স্বামী কোনোদিন জোর করেনি, সে তো জানে বাপের বাড়ির অবস্থা কী, তাই চুপ করেই থাকে। আমার বড় ভাই স্বচ্ছল, ছেলেটাকে মাঝে মাঝে এটাওটা দেয়, তাতে অবশ্য স্বামী খুশিই হয়। সকল মা-বাবাই তার সন্তানের প্রাপ্তিতে খুশী হয়।

ইদানিং তার একেবারেই কোনো কাজ নেই। কাপড়ের ব্যবসা ছিল ইসলামপুর, কার সাথে যেন শেয়ারে কিছু কাপড় আমদানি করতে গিয়ে পনেরো লক্ষ টাকা লস করে এখন দোকান ছেড়ে দিয়েছে।

হঠাৎ সচল ব্যবসা ছেড়ে চাকরি করা যায় না, একটা ট্রমা কাজ করে। ধাতস্থ হতে সময় লাগে। ধারদেনা শোধ করে দোকান বেঁচা কিছু টাকা অবশিষ্ট আছে। তাই ভেঙ্গে ভেঙ্গে সংসার চলছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। টাকাটা নিজের জিম্মায় রেখেছি বলে মেপে মেপে খরচ হচ্ছে, ওর কাছে থাকলে যেত একবারে সব।

অনেকে অবশ্য বলে, শুধু পনেরো লক্ষ টাকা লস করে তার এতবড় ব্যবসায় ধস নামেনি। বেশি ব্যয় করেছে সে ‘সুন্দরীদের’ পিছনে। আমি যে তা জানিনে তা নয়, ও জগতে আগ্রহ থাকলে পুরুষ মানুষের খরচ না করে উপায় নেই। সব নারী টাকা না নিলেও ফাঁকা আওয়াজে বিশ্বাসী নয়, আবার পুরুষ কিছু না দিয়েও পারে না। এটা শুধু তাদের উদারতা নয়, বড় থাকার, শ্রেষ্ঠ থাকার বাসনাও।

আমি এসব জানি, কম পুরুষ তো দেখলাম না জীবনে। তবে কোনোদিন টাকা নিইনি, কিছুই নিইনি, নিতে আমার বেধেছে। শরীরের ক্ষুধা মিটিয়েছি ভালোবেসে, ভালোবাসা পেয়ে, আবার টাকা নেব কেন? টাকা নিলে ওরা অবৈধ পথে উপার্জন করতে গিয়ে কাউকে ঠকাবে নিশ্চয়ই।

তখন আমার বয়স পয়ত্রিশ মনে হয়। বিশ-বাইশ বছর বয়সের একটি ছেলে অনেকদিন ধরে আমাকে ফলো করে। সম্ভবত ও তখন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আমি যে খুব শিক্ষিত নই, এটা ও জানত কিনা জানি না, আবার জানলেই কী, পুরুষ শরীর খোঁজে, ভালোবাসেও, তবে শোয়ার জন্য অন্যকিছু অত দেখে না ওরা।

ওর প্রতি আমারও আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, তবে ভাবতাম, বাচ্চা ছেলে, দরকার নেই। কিন্তু ও এত বেশি পিছে লেগে থাকল, শেষে একদিন কথা হল। এভাবে কয়েকদিন কথা হল। এরপর ও নিয়মিত বাসায় আসত। কতটা যে ভালোবাসত ছেলেটা! তবে যতক্ষণ থাকত ততক্ষণই, পরে আর নাগাল পাওয়া যেত না। সম্ভবত ওর স্বভাবটাই ছিল ওরকম, যাকে পায় ভালোবেসে পেতে চায়।

আমি নিজেকে দেখেই বুঝি, একজনকে ভালোবেসে সবাই সুখী হতে পারে না, পারার কথা না। এটা অনেক নারীর জন্যই সত্য। পুরুষই বা কেন এক নারীতে সুখী হবে, অবশ্য সামার্থ থাকলে পৃথিবীর কোনো পুরুষই তা হয় না। আমার স্বামী যেমন, আমার কাছ থেকে ছাড় পেয়ে পেয়ে কী যে করেছে! তবে ওর একটা গুণ আছে, প্রেম বৈ কিছু করেনি। অপ্রেমে কারো সাথে বিছানায় যায়নি কোনোদিন, এটা আমি বুঝি, এতটুকু চিনি ওকে।

ঐ ছেলেটা আমাকে বুঝিয়েছিল, জীবনে সৎ হলেও সতী হতে নেই। সততা আর সতীত্ব এক নয় কখনো। দুটো একসাথে হতে নেই, তাহলে জীবন বাঁচে না। ধীরে ধীরে ও আমার প্রেমে পড়েছিল বোধহয়, আমি যে ওর সঙ্গ খুব উপভোগ করতাম, এটা হয়ত ও টের পেয়েছিল। এতে পুরুষের গর্ব হয়, নারীকে সুখী করতে পারলে ওরা নিজেদের জয়ী ভাবে। ও একদিন ছোট্ট একজোড়া সোনার কানের দুল নিয়ে এসে হাজির। এসে বললে, টিউসনির বেশ কিছু টাকা পেয়েছি, এটা তোমার জন্য কিনলাম।

কানের দুলটা আমি পরেছিলাম, ওটা পরেই ঐদিন ওর সাথে মিলিত হয়েছিলাম খুব করে। ঐদিন ওকে খুব আদর করেছিলাম মনে পড়ে, ও হয়ত প্রথমে ভেবেছিল উপহার পেয়ে আমি আত্মহারা হয়ে গেছি। ও আসলে প্রতিদিনই কিছু না কিছু খেতে দিতাম। ঐ সময় স্বামী গিয়েছিল ব্যবসার কাজে তিনদিনের জন্য সিলেট। যদিও আমি জানি, এসব ব্যবসার কাজের কথা বলে সে তার কোনো না কোনো প্রেমিকাকে নিয়ে ট্যুরে যায়। যাগগে।

আজকে ওকে বললাম, থাকতে। ও একবাক্যে রাজি হয়ে গেল। বলা যায়, এই প্রথম দীর্ঘক্ষণ একসাথে থাকা। বিভিন্ন গল্পগুজব। ওকে টিভি রুমে রেখে রান্না চাপালাম। বেশি সময় নষ্ট করব না বলে মিক্সড মশলা দিয়ে বিরানী রান্না করলাম। দু’জনে খেলাম, গল্প করলাম। কানের দুলটা পরেই ছিলাম, ও দু’একবার বলেছে, “তোমাকে খুব মানিয়েছে।” রাতটা আমরা একসাথেই কাটালাম।

সকালে ও এ পথেই ভার্সিটিতে যাবে। যাওয়ার সময় আমাকে একটা চুমু খেল, আমি ওর হাতে কানের দুলটা দিতেই চমকে গেল। আমি বললাম, দেনা-পাওনার কথা বললে তোমারই বরং পাওনা হয়েছে। রাখো, তোমার বউকে দিও এটা। আজকেই আমাদের শেষ সাক্ষাৎ, আর দেখা হবে না। একটু আগে চুমু খেলে, এটা যদি ভালোবাসার হয়ে থাকে, তাহলে আমার কথা শোনো, কখনো আর আমার সাথে দেখা করার চেষ্টা কোরো না।

ও কথা রেখেছিল, আর কোনোদিন দেখা হয়নি। আমার খুব ইচ্ছে করে ওর সাথে দেখা করতে। জীবনের একটা অসমাপ্ত অধ্যায় হয়ে রয়েছে ও। বিস্ময়কর হচ্ছে, আমি ওর নাম জানিনে, শোনা হয়নি। ওরও আমার নাম জানার কথা না, বলা হয়নি, আসলে কারো নাম জানাটা প্রয়োজন হয়নি।

ইদানিং আমার ছেলেটা খুব মনমরা হয়ে থাকে। ঢাকা শহরে চারপাশের এত জৈৗলুস দেখে ওর এতটা চেপে চলতে কষ্ট হয়। স্কুলের টিফিনের জন্য দশ টাকা দিই, তাতে কী এমন টিফিন হয়! মাঝে মাঝে নিজে কিছু বানিয়ে দিই, কিন্তু প্রায় সময়ই ঝটপট খাওয়ার মতো বাসায় কিছু থাকে না। টাকার অভাবে ওর রিক্সায় চলা হয় না। ঘামতে ঘামতে স্কুল থেকে এসে একেবারে নেতিয়ে পড়ে।

স্কুল কোচিং মিলিয়ে ছেলেটা প্রায় ছয় ঘণ্টাই বাইরে থাকে। স্বামী একটা চাকরি নিয়েছে। ৯টা থেকে ৯টা পর্যন্ত অফিশ। বেতন যা তাতে বাসা ভাড়াই হয় না।

মাঝে বছর দুই বোধহয় আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। আবার আমার শরীর-মন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। চল্লিশোর্ধ নাতিদীর্ঘ স্বল্প-স্থুল শরীর, এ ধরনের নারীদের প্রতি পুরুষের বোধহয় আলাদা আকর্ষণ থাকে। আবার আমি ওদের পাত্তা দিতে শুরু করেছি। কাউকে চোখ রাঙ্গাই, কারো প্রতি আবার একটু মুচকি হাসি দিই, অথচ দু’জনের চাহিদা একই, চাওয়ার ধরণও একই। শুধু আমার পছন্দই আমার দৃষ্টিভঙ্গী ঠিক করে দেয়। এ যেন একই ডালে একইভাবে বসা কাকটাকে তাড়িয়ে কোকিলটাকে মুগ্ধ হয়ে দেখা!

হঠাৎ মা স্ট্রোক করে একরকম বিছানায় পড়ে আছে। বাবাও খুব একটা সচল নেই। রিটায়ার্ড করার পর যা কিছু টাকা পেয়েছিল তা দিয়েই চলছে। কিন্তু বর্তমানে আর চলছে না। আমি গেলে মা এমনভাবে তাকিয়ে থাকে, মনে হয় এর চেয়ে বরং মরে যাই। মা যে আমার কাছ থেকে ভালোবাসা-সহযোগিতা চায়, তা বুঝতে পারি, কিন্তু একটা নিষ্ঠুরতার মোড়ক নিয়ে আমাকে পিছন ফিরতে হয়, যেন মিছে আশ্বাস না পায়।

সবদিকে হাহাকার, পাল্লা দিয়ে হাহাকার বেড়েছে আমার শরীরেও। ওটা ছাড়া আমি বাঁচি না, চাই, চাই, চাই, বিধি-নিষেদগুলো দুমড়ে মুচড়ে চাই। নারী বলে অসুবিধা যেমন আছে, সুবিধাও কিছু আছে, চাইলেই পাওয়া যায়, শুধু একটু ‘না না’ করতে হয় পুরুষগুলো প্রতারক বলে। যার কাছে ওরা যায় ক্ষুধায়, মোহে বা ভালোবেসে আবার তাকেই বেশ্যা বলে চুনের থেকে পান খসলে।

হটাৎ স্বচ্ছলতা দেখে আমার স্বামী ঠাহর করতে পারছে না কিছু। আজকে জানতে চাইল, বলোতো বিষয়টা কী? আমি যা টাকা দেই তোমাকে তা দিয়ে বাজার এত ভালো হওয়ার কথা তো না। কীভাবে কী করছ? বললাম, বড় ভাই প্রতি মাসে দশ হাজার করে টাকা দিচ্ছে, বলেছে, যদ্দিন আমাদের আয়-উপার্জন না বাড়ছে ততদিন দিবে। তবে তোমাকে বলতে না করেছে।

পুরুষ মানুষ, চুরি করে নিলেও চেয়ে নিতে পারে না, তাই জানি যে সে আর যাচাই করতে যাবে না। বড় ভাই তার বোনকে টাকা দিচ্ছে এটা নিয়ে তার ভাবনারও কিছু নেই।

ওদিকে মা এখন প্রায় শয্যাশায়ী। তার কাজ করার জন্য একটা কাজের মেয়ে রেখে দিলাম। ভালো টাকা পয়শা না দিলে এ ধরনের পরিচর্যার কাজ করতে কেউ রাজি হয় না এখন। খাওয়া থাকা বাদেও ছয় হাজার টাকা দিতে হয় তাকে। এর বাইরে মাকে ফলমূল ওষুধও কিছু কিনে দেয়ার কথা। সব মিলিয়ে বাবার হাতে প্রতি মাসে দশ হাজার টাকা তুলে দিই।

বাবাকে বললাম, তোমার জামাইয়ের উপার্জন বেড়েছে, বলল, তোমাদের প্রতি মাসে দশ হাজার টাকা করে দিতে।  তবে বলেছে, উনি যে টাকা দিচ্ছে এটা তোমার ছেলেকে যেন না জানাই। বাবা খুশি হয়, জামাই টাকা দিচ্ছে এটা কাউকে না জানাতে পারলেই সে খুশি।

সবই ঠিকঠাক চলছে। স্বামী, সন্তান, পিতা-মাতা সবাই ঠিক অছে, ঠিক নেই শুধু আমি। বুঝলাম, উপভোগের জন্য ফুলের বাগান করা, আর বিক্রীর জন্য করা এক কথা নয়। এখন বাগানের পরিচর্যা করতে গেলেই বিরক্ত লাগে, গা গিনগিন করে, যেন সব সুখ পালিয়েছে নিমেষে!


গল্পটি দিব্যেন্দু দ্বীপের গল্পসমগ্র থেকে সংগৃহীত