ঢিল ।। শাহিদা সুলতানা

Guava tree

বেলা উঠেছে অনেক্ষণ। কিন্ত আজ আর কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে করে না পারুলের । কতই বা বয়স হবে ওর। বড়জোর নয় বা দশ। অভাবের সংসারে পুষ্টিহীনতায় শরীরও বাড়েনি একদম। এখনো তাকে নিতান্তই শিশু মনে হয়।

প্রতিদিন সকালে পারুলের কিছু নির্দিষ্ট কাজ থাকে । বিছানা কাঁথা ভাঁজ করে চালের আড়ায় তুলে রাখা, মুরগীর ঘর খুলে দুটি বাচ্চা সমেত মুরগীটাকে কিছু খাবার দেয়া, সবদিন যে খাবার থাকে তা নয়, যেদিন থাকে না সেদিন তাঁর একটি কাজ কমে যায়।

রাতের খাওয়া শেষে যে দু’একটা থালা বাসন থাকে সেগুলো ধুয়ে চুলোয় আগুন দিয়ে ভাত বসিয়ে দিতে হয়। এটুকুই। এই ফাঁকে ওর মা মরিয়ম উঠোন ঝাড় দিয়ে তরকারি কুটে রান্না চড়াতে বসে। সকাল বেলায় মা মেয়ের সমন্বিত কাজের হিসাব এই।

এরপর মরিয়ম চলে যায তাঁর কাজে আর পারুল যায় তাঁর স্কুলে। পারুলের মা মরিয়মের বয়স পচিশ ছাব্বিশের বেশী হবে না। কাজ করে একটা ধানের চাতালে। বেশ ভোরে বেরোতে হয়। পারুলের স্কুলও অনেক সকালে। তাই আলো ফুটতেই শুরু হয়ে যায় তাঁদের প্রাত্যহিক আয়োজন।

মরিয়ম সকালে মেয়েকে দু’তিন বার ডেকে গেছে। পারুল ইচ্ছে করেই চোখ মেলেনি, কোনো সাড়াও দেয়নি। আজ তাঁর মন ভাল নেই। কিন্ত আর শুয়ে থাকা যাবে না। এরপরে স্কুলে দেরী হয়ে যাবে। মা বোধ হয় আজ নিজে নিজে ভাত বসিয়ে দিয়েছে। পারূল বিছানা থেকে উঠে কাঁথা বালিশগুলো গুছিয়ে নেয়। উচু হয়ে আড়ার উপরে তুলতে গিয়ে হাটুতে টান লাগে। গতকাল পুকুরে পড়ে গিয়ে হাটু ছিলে গেছে। রাতে আধশুকনো হয়ে এখন টান ধরেছে। ভেবেছিল সন্ধ্যায় পড়তে বসার সময়ে মাকে দেখাবে। কিন্ত মা কাল এমন একটি বিষয়ে কথা পাড়লো যে, তার হাটু ছিলে যাওয়া, ব্যথা পাওয়া, এগুলো মাকে বলা একেবারে অর্থহীন মনে হলো।

পারুল বাইরে বেরিয়ে দেখে বেশ চড়া রোদ উঠে গেছে। মা আজ নিজেই সব কাজ করেছে। কাজে যাবার আগে রান্না ঘরের শিকেয় থালায় করে ভাত ঢেকে রেখে গেছে। এই এক চিলতে বাড়ি ওদের। আট দশ হাতের একটি খড়ের চাল দেয়া ঘর। তারই বারান্দায় চালা দিয়ে রান্নার ব্যবস্থা। বেড়াবিহীন। বারান্দা থেকে নেমেই তিন চার হাতের একটি উঠোন। তারই একপাশে মাটি দিয়ে তৈরী একটি ছোট্ট মুরগীর ঘর। ওদের মা মেয়ের মতোই ছোট্ট সংসার। এই জমিটাও তাদের নিজের নয়। হোসেন মোড়লের বিশাল কাঁঠাল বাগানের এক কোনায় তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে থাকে। রাত্রি বেলায় এদিকটায় লোক চলাচল থাকে না বললেই চলে। ফলে এক ধরনের ভুতুড়ে নির্জনতা থাকে। দিনের বেলায় অবশ্য একদম ভয় করে না। বরং এক ধরনের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য থাকে।

বাগানের আরেক প্রান্তে একটি পুকুর । শীতের দিনে খুব সামান্যই পানি থাকে। তবে বর্ষায় অথৈ অবস্থা। পারুল প্রতিদিন সকালে গোসল করতে নেমে সাঁতার কাটে অনেকক্ষণ ধরে। কোনো কোনো দিন ওর সাথে থাকে ওপাড়ার দুএকটি ছেলে মেয়ে। আর কোনো কোনো দিন ওর সঙ্গী হয় কেবল কয়েকটি পাতি হাঁস। স্কুলের আগে অনেকক্ষণ সাঁতার কেটে এসে গরম ভাতের থালা নিয়ে খেতে বসলে পারুলের এক বিশেষ ভাল লাগা কাজ করে। কিন্ত আজ ওর সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করে না। কাঠের গুড়ি ফেলা ঘাটে নেমে ঝুপ করে দুটি ডুব দিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। স্কুলের জামাটা পরতে গিয়ে দেখে কলারের জায়গাটা ছিড়ে গেছে। জামার নীল জমিনেও দু একটা ছোট ফুটো চোখে পড়ে। জামাটা বানানো বছর দুয়েক আগে। তৈরীর সময়ে মাপে ঠিক ছিল, এখন একটু খাটো খাটো মনে হয়। মাকে এবার জামার কথা বলতে হবে। মায়ের কথা মনে হতেই আবার অভিমান এসে জমা হয় পারুলের বুকে। না মাকে সে কিছুই বলবে না। হয়তো বলার মতো সুযোগ ও আর পাবে না। কারণ, তাদের মা মেয়ের সুখ দু:খের ভাগাভাগির সংসারের সম্ভবত আজই শেষ দিন।

শিকে থেকে ভাতের থালা নামিয়ে খেতে বসে পারুল। আলু চচ্চড়ি দিয়ে ভাত। অন্যদিন হলে খুব খুশি মনে খেতো। আজ আর কিছুই ভালো লাগছে না। স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছেটা ও আস্তে আস্তে কমে আসছে। মনে হচ্ছে কাঁঠাল বাগানের কোণায় বসে একটু কান্নাকাটি করে। কিন্ত উপায় নেই। স্কুলে না গেলে অনুপস্থিত হয়ে যাবে। পরে উপবৃত্তির টাকাটা আর পাবে না। এবারের টাকা তুলে একটা জামা বানাতে হবে। গতবারের টাকা দিয়ে জামা বানানোর বায়না করলেও মা মানেনি। কিস্তির বকেয়া টাকা শোধ করেছিল তার উপবৃত্তির টাকা দিয়ে। সমিতি থেকে এত টাকা তুলে মা যে কি করে তা কে জানে। স্কুলের কোনো পড়াই আজ পারুলের মাথায ঢোকেনি।

কাঁচা মেঝের উপর বাঁশের খুঁটিতে টালি বসানো ক্লাশরুম। চালে একটা টালি ভাঙা আছে। সেখান থেকে ঠিক তার বেঞ্চের সামনে রোদ এসে পড়ে। আগে কখনো চোখে পড়েনি। কিন্ত আজ সারাদিনই তাঁর চোখ পাহারা দিয়েছে এই একফালি রোদ। অবশ্য মন তাঁর পড়ে রয়েছে অন্যখানে। স্কুলের সময় শেষ হয়ে আসে আর পারুলের বুকের ভিতরে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে। পাশে বসা হালিমার সাথেও আজ তাঁর কোনো কথা হয়নি। হালিমা কয়েকবার উপযাচক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে তাঁর কী হয়েছে। ও কোনো জবাব দেয়নি। এমনটা কখনও হয় না দেখে হালিমাও একটু চুপসে গেছে।

স্কুলের শেষ ঘন্টা বাজে। একসাথে সব ছেলে মেয়েরা হইচই করতে করতে বেরিয়ে যায় একঝাঁক পাখির মতো। বসে থাকে পারুল। তাকে একা ফেলে যেতে পারে না বলে বসে থাকে হালিমাও। অনেক্ষণ বসে থাকার পর জিজ্ঞেস করে, বাড়ি যাবি না?  তুই যা, আমি পরে যাব। তোর কি হয়েছে? কিছু হয়নি, তুই বাড়ি যা। তুই না গেলে যাব না। আজ তুই সারাদিন কারো সাখে কথা বলিসনি, টিফিনে খেলিসনি। আমাকে বল না তোর কি হয়েছে। পারুল একথার কোনো জবাব দেয় না। পলিথিন ব্যাগের ভিতরে নিজের বইগুলো ভরে নেয়। ওকে গোছাতে দেখে হালিমাও নিজের বইগুলো গুছিয়ে পারুলের পিছনে পিছনে স্কুল থেকে বরিয়ে আসে।

পারুল বললি না, তোর কি হয়েছে? এতক্ষণ চুপ করে ছিল পারুল। এবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না। শব্দ করে কেঁদে ফেলে। হঠাৎ এরকম আচরণে ভয় পেয়ে যায় হালিমা। এগিয়ে এসে হাত ধরে বলে, কী হয়েছে বলবি তো। আমার মা আজ বিয়ে করবে। একথা বুঝতে প্রথমে একটু কষ্ট হয় শিশু হালিমার। মানে? তোর বাবা? আমার বাবা তো সেই কবে আমাদের ফেলে রেখে চলে গেছে! তোর মা তাহলে কাকে বিয়ে করবে? চাল কলে কাজ করে জহির চাচা, তারে। কেন? আমাদের বাড়ির চালে প্রত্যেক রাতে অনেক ঢিল পড়ে, মা বলেছে সে বিয়ে করলে ঘরে ঢিল পড়া বন্ধ হবে।

কারা ঢিল মারে?  আমি কীভাবে বলবো। মাঝে মাঝে কারা যেন আমাদের দরজায় ধাক্কাও দেয়। আমি আর মা তখন জেগে বসে থাকি। মার হাতে থাকে একটা লম্বা দা। দরজায় ধাক্কা পড়লেই মা চেচিয়ে বলে ‘ঘরে কইলাম দাও আছে’। হালিমার চোখে তখনও অনেক প্রশ্ন— তোর মা বিয়ে করলে যদি তোদের চালে ঢিল পড়া বন্ধ হয়, তাহলে তুই কাঁদছিস কেন? মা বলেছে আজ থেকে জহির চাচা আমাদের বাড়িতে থাকবে। আমাদের মাত্র একখানা ঘর। জহির চাচা থাকলে আমি কোথায় থাকবো? তোর মা কী বলেছে? জিজ্ঞেস করিসনি? করেছি, বললো, “বারান্দা ঘিরে দেবে। আর না হয় মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবো। ওখান থেকে স্কুল করবি, পারবি না?”

মামার বাড়ি আমার ভালো লাগে না। মামী শুধু দূর ছাই করে। আর মামার বাড়ি এথান থেকে অনেক দূর। আমার আর স্কুলে আসা হবে নারে। তোদের সাথেও আর দেখা হবে না।আমি এখন কী করবো? একটানা অনেকগুলো কথা বলে পারুল কাঁদতে থাকে। হালিমাও কাঁদে। পারুল এখন কী করবে এই প্রশ্নের জবাব তারও জানা নেই। পারুলের সাথে কাঁদা ছাড়া তার আর কিছু করার নেই। জগৎ সংসারে আর কেউ তাদের এই অসহায়ত্ব টের পায় না। একটি নিশ্চিত অনিশ্চয়তার দুশ্চিন্তা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দুটি শিশু তাদের চিরচেনা গ্রামের পথ দিয়ে হাঁটতে থাকে।


শাহিদা সুলতানা    Shahida Sultana