রাতে অপূর্ব রূপ-শোভা মোহিত করছে জেগে থাকা মানুষের চোখ। অদূরের চারিধার খানিকটা নীরব-নিশ্চুপ হলেও গ্রামের শেষ প্রান্তে নদীর সংলগ্ন এ বিদ্যালয় প্রাঙ্গন চুপ নেই একটুও। কেননা আজ রাত বনভোজনের রাত। বিদ্যালয়ের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে আমরা বড়রা এ বনভোজনের আয়োজন করি। কেউ রাঁধে, কেউ মাছ মাংস, তরকারি কুটে। কেউ গল্প করে, কেউ ব্যস্ত নির্দেশনায়। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা হাসি হুল্লুরে মাতিয়ে তুলছে স্কুল ঘর। কী মজা তাদের মনের ভিতর! অথচ আমি একাকী বসে আছি মাঠের এক কোণায় ভাঙ্গা বেঞ্চির উপরে। মাথার উপর ছোট্ট দেবদারু বৃক্ষ। ভালো করেই দেখা যাচ্ছে এ রাতের আকাশ। আমি আনমনে প্রকৃতির শোভা দেখছি আর ভাবছি—।
হঠাৎ অরূপ এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘‘কিরে, সারা স্কুল তোরে খুঁজে হয়রান আর তুই কিনা এখানে? মাংস কেমন পিচ্ করলো গোপাল, তুই দেখলি না?”
আমি একটু কেঁপেই উঠেছি বন্ধু অরূপের উচ্চ ডাকে।
অরূপ, ‘‘কিরে, কার কথা ভাবছিস্? কোন রূপসী আবার ভাবনায় এলো?”
আমি কথা বলতে চেষ্টা করলাম কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছি বার বার। অরূপ আমার পাশে বসে পড়ল ধপ করে। (আমার মাথা ঘুরিয়ে তাকাল আমার চোখের দিকে)। ‘‘তোর চোখে জল? কী হয়েছে অসীম।”
আমি কিছু সময় নীরব থেকে বললাম, ‘‘কৈ কিছু না তো?”
– তাহলে?
– হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়ল তাই!
– তুই কি কাকার কথা ভুলতে পারবি না? যিনি চলে গেছেন এই পৃথিবী ছেড়ে তিনি তো আর ফিরে আসবেন না, তাঁর কথা ভেবে এত দুঃখ করে কী লাভ?
– লাভ আছে, লাভ আছে রে বন্ধু। পিতার মৃত্যু কি কোনো সন্তান ভুলতে পারে?
– কাকা স্বর্গে আছেন ভালো আছেন, ঈশ্বর তাঁর মঙ্গল করুক। এবার চল ঐ বারান্দায়।
– নারে আর কিছু সময় থাকি এ জায়গায়। রাতের প্রকৃতি আজ খুবই মনোরম! বাকীরা যা পারে করুক, আমরা না হয় কিছু সময় জীবনের গল্পই করি।
– আচ্ছা ঠিক্ আছে।
– তোর জীবনের গল্প বলনা? শুনি। কতইনা গল্প আছে তোর যা আমাকে শুনাবি বলেছিলি।
– দুই একটা আগে তুই বল? তারপর আমি না হয় —।
জীবনে কত ঘটনা ঘটে থাকে। সব ঘটনা মনে না থাকলেও কিছু কিছু ঘটনা স্মৃতির ডাইরিতে লেখা থাকে স্বর্ণাক্ষরে, যা কোনো দিনই মুছে যায় না। রুপোর ডাইরিতে সোনালী স্মৃতি হয়ে আছে আমার জীবনে কতক ঘটনা। আমি ঐ স্মৃতির কিছু সংখ্যক প্রোজ্জ্বল লাইন পড়ে শোনাতে লাগলাম প্রিয় বন্ধু অরূপকে। কেননা তখন সে শুনতে অনেকখানি আগ্রহী।
১৯৯৯ সাল, ফেব্রুয়ারি মাস। শীতের প্রকোপ কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। অথচ বাবার শারীরিক অসুস্থতা হ্রাস পাচ্ছে না। দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে অসুখ। চিন্তিত মা, দিদি, ভাই এবং আমি। সংসারের খরচ অনেক। বড়দির বিবাহ বেশ কিছুদিন হলেও মেঝদির বিবাহ বেশিদিন হয়নি। সংসারে পাঁচ ভাই বোন একই সাথে লেখাপড়া করছি। ঐ বছর প্রাকৃতিক কারণে জমির ফসল নষ্ট হয় সব। সামনে আমার SSC পরীক্ষা। আছে মাত্র প্রায় এক মাস। ঘরে খাবারও নেই। এদিকে বাবার অসুখ। ঔষধ কেনার টাকা নেই আমাদের। বড় কষ্টে যাচ্ছে আমাদের অভাবের সংসার। সমাজের লোকজন, জ্যাঠামশাই, কাকাবাবুর সাথে যোগ দিয়ে আমাদের ঠকানোর চেষ্টায় মাতোয়ারা। আমরা স্কুলে না যাই সেই চেষ্টাই সর্বদা। মেয়েরা লেখাপড়া করুক বিষয়টা যেন পাপের। সমাজের লোকজন কি নিষ্ঠুর, কত হিংস্র হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ আমাদের উপর প্রয়োগকৃত সে নিষ্ঠুর আচরণই যথেষ্ট। সবকিছু উপেক্ষা করে একমাত্র মায়ের জোর প্রচেষ্টায় আমরা লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিই রাস্তায় কাজ করবো। সে সময় রাস্তা পুনঃনির্মাণের প্রজেক্ট আসল। খাদ্যের বিনিময়ে কাজ। পরদিন মাটি কাটতে লেগে পড়লাম। অবশ্য এ কাজে সহযোগিতা ছিল রাস্তা কাটার সরদার অনুকূল ঘরামীর। কেউ কেউ বলেই ফেলল– ‘‘এতটুকু ছোট ছেলে কী করে করবে এতো কঠিন কাজ? তাছাড়া দুদিন বাদে মেট্রিক পরীক্ষা, মাটি কাটলে তো নির্ঘাত ফেল!” জয়দেব নামের এক দাদা বলেই ফেলল– ‘‘এতে মিলনের কোনো ক্ষতি হবে না, দেখিস এবার ও ফার্স্টডিভিশন পাবেই।”
প্রথম প্রথম আমার কষ্ট হলেও দ্রুত সয়ে নিয়েছিলাম। কারণ কাজ করা আমার অভ্যাস ছিল। যদিও ছোট খাটো ছিলাম আকারে। ছোট বেলা থেকেই আমি পরের জমিতে কিষাণ খেটেছি। যা হোক মাত্র ১২ দিন হাঁড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে ১৮ পইকা (১০ কেজিতে ১ পইকা) গম এনেছিলাম। যার ফলে বাবা সেরে উঠার আগ পর্যন্ত আমরা ভালো ভাবেই চলতে পারলাম।
— বড় কষ্টের গেছে তোদের দিন! তারপর …
ssc পরীক্ষা দিলাম। ভালো নম্বর পেয়ে প্রথম বিভাগে (বিজ্ঞান শাখায়) উত্তীর্ণ হলাম। কলেজেও ভর্তি হলাম। সে সময় আমাদের চিতলমারীতে ‘এইসডাফ’ নামে একটি সংস্থা এলো। যারা সরকারের ‘‘বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম” হাতে নিয়ে সুনামের সাথে চলতে লাগল। আমি চিতলমারী থানার সর্বকনিষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলাম। (সপ্তাহে ৬দিন) রাত ৮টা হতে দশটা পর্যন্ত বয়স্কদের অক্ষর জ্ঞানদান করতাম। সন্ধ্যার পর হ্যারিকেন জ্বালিয়ে পাশের গ্রামে যেতাম। আমার প্রিয় কিছু ছাত্র (সবাই বয়সে কেউ কাকা, কেউ মামা, কেউ জেঠিমা, কেউ কাকী, কেউ জ্যাঠা) প্রায়ই আসত হ্যারিকেন জ্বালিয়ে। কারণ, আমার স্কুল ছিল ঐ গ্রামে। আমি অনেক মজা করতাম। নিজের নাম লেখা থেকে শুরু করে চিঠি লেখা পর্যন্ত অনেক কিছু শিখিয়েছি উনাদের। লেখাপড়ার পাশাপাশি মজার মজার গল্প বলতাম। মজা পেতেন তারা। মাঝে মাঝে ফাঁকাও যেতো স্কুল। এ সমস্যা ও সমস্যা থাকতোই। আমাকে ভালোবাসত কিছু বয়স্ক ছাত্র। আমার গর্ব হতো- বয়স্কদের শিক্ষক হয়ে তাদের শিক্ষিত করতে পেরে। আমার মাইনে ছিল মাসে ৫০০ টাকা। ২০০০ সালে ৫০০ টাকা অনেক। সেই থেকে শিক্ষকতার মানসিকতা আমার রক্ত মাংসে জড়িয়ে গেছে। বয়স্ক শিক্ষার শিক্ষকতা জীবনটুকু আমার সোনালী স্মৃতি।
— একটা মজার স্মৃতি বলি। যা কোনো দিনই আমি ভুলব না।
— কী স্মৃতি! বল না ভাই, তাড়াতাড়ি বল।
পড়ালেখা, কাজ এ সবের পাশাপাশি খেলাধুলা ছিল আমার প্রিয়। ফুটবল, ক্রিকেট, হাডুডু ইত্যাদি আমাকে অনেক আনন্দ দিত। তারমধ্যে ক্রিকেটই বেশি। বিভিন্ন দলের হয়ে কত মাঠে যে ক্রিকেট খেলেছি তার হিসাব নেই। ২০০১ সালের জানুয়ারি, সেদিন আমাদের কলেজ মাঠে একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণির প্রীতি ম্যাচ চলছে। আমি দ্বাদশ শ্রেণির অন্যতম খেলোয়াড়। আমরা প্রথমে ব্যাট করে ১১৭ রান সংগ্রহ করি। একাদশ শ্রেণির ক্রিকেট একাদশের রান করতে হবে ১১৮ জিততে হলে। ১২ ওভার শেষ, স্কোর বোর্ডে তখন ৭৫ রান। বাহাতী এক ওপেনার ব্যক্তিগত ৫২ রান সংগ্রহ করেছে। যদিও উইকেট পড়েছে ৩টি মাত্র। আমাকে বল করতে ডাকা হলো। ক্রিকেট ভাগ্যদেবতার আশীবার্দ নিয়ে হয়তো সেদিন আমি এসেছিলাম। আমার প্রথম ওভারে গালিতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গেল প্যাভিলিয়নে ঐ বাহাতী ব্যাটসম্যান। ঐ ওভারে রান দিলাম মাত্র দুই। পরের ওভারে উইকেট ছাড়া মেডেন। পরবর্তী বোলার কিছু রান দেওয়ায় রান সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৮। আমার ব্যক্তিগত তৃতীয় ওভার এলো। ঐ ওভারটা যে আমার জীবনের অন্যতম সেরা স্মৃতি হবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। প্রথম বলে মিডিল স্ট্যাম্প বোল্ড; দ্বিতীয় বলে মিডিল স্ট্যাম্প বোল্ড। চরম উত্তেজনা সতীর্থ বন্ধু, দর্শকসারি সবখানে। তৃতীয় বলে স্লিপে ক্যাচ। উইকেট হাতে ৩টি। রান সংখ্যা সেই ৮৮। চতুর্থ বলে আবারও মিডিল স্ট্যাম্প বোল্ড। আমাকে নিয়ে অনেক আনন্দ! অন্যদিকে আম্পায়ার বললেন ‘নোবল’। অর্থাৎ নট আউট। পরের বলে মিড উইকেটে ক্যাচ এবং আউট। পঞ্চম বলে (নো বল বাদে) অফ স্ট্যাম্প বোল্ড। কে জানতো ইতিহাস হতে চলেছে। শুধুই জয়ের স্বপ্ন দেখছি। চারিদিকে আনন্দ এবং আনন্দ! শেষ বলের আগের বলে ক্যাচ উঠল অফে এবং আউট দিলেন আম্পায়ার। অবশেষে শেষ বল করলাম এবং এবারও মিডিল স্ট্যাম্প ভেঙ্গে গেল। আমরা জয়লাভ করি। কীভাবে এক ওভারে ৬ উইকেট পেলাম তা আমিও জানি না। আনন্দের বন্যা বয়ে গেল খেলার মাঠে। আমি শূন্যে ভাসছি। বন্ধুরা কোলে করে নাচছে। এটাই ইতিহাস। আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন। মাত্র তিন রান দিয়ে ৭ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হয়েছিলাম সেদিন।
খেলাধুলা যেমন ছিল আমার নেশা তেমন ছিল ভালোলাগার বিষয়। ২০০১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে বাগেরহাট স্টেডিয়ামে উন্মোচন ক্রিকেট টিমের উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হয়ে খেলার সুযোগ পাই। সেও এক ইতিহাস। ক্লাবটি ভালো খেলোয়াড় খুঁজছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে প্লেয়ার বাছাই শুরু করে ক্লাবটি। বন্ধু স্বপনের মাধ্যমে আমি, তরুণ ও স্বপন পরীক্ষা দিই। এমনই ভাগ্য যে আমি এবং তরুণ টিকে গেলেও স্বপন টিকল না। স্বপন অবশ্য বিষয়টিতে ভুল বুঝে আমাদের ওপর মাইন্ড করেছিল। আমি লিগে শেষ পর্যন্ত খেলেছিলাম সুনামের সাথে। মনে পড়ে, ত্রিশটি বল করেছিল আমাকে ঠেকানোর জন্য বাছাই পরীক্ষায়। ব্যাট হাতে ত্রিশটি বলই আমি ডিফেন্স করেছিলাম। বলহাতে উড়িয়ে দিয়েছিলাম স্ট্যাম্প একাধিকবার। ভেঙ্গেও গিয়েছিল শক্ত কাঠের স্ট্যাম্প। যে কারণে এমন সুযোগটা পেয়েছিলাম। অবশ্য শ্রম অনুযায়ী পারিশ্রমিক কম দিয়েছিল ক্লাব কর্তৃপক্ষ। কিছুদিন পর এলো HSC পরীক্ষা। আশানুরূপ পরীক্ষা দিতে না পারলেও উপজেলায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলাম। বাবা রেজাল্ট পেয়ে খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন ‘‘একদিন তুমি বড় কিছু হবে।”
মাঝে মধ্যে বাবার শরীর ভালো মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি অসুখ থেকে মুক্তি পাননি। ভিতরে ভিতরে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। আমি ভালো বুঝতাম না। কিন্তু মাঝে মাঝে মন খারাপ হতো—বাবার যদি কিছু হয়! সংসারে অভাব অনটন লেগেই ছিল আঠার মত। দিদিরা সংসারে কাজ তো করতোই উপরন্তু অল্পবয়সে NGO এর চাকরি করে সংসার চালাত। সরকারি চাকরির আশা করলেও পাওয়ার অপেক্ষা করিনি। মা, দিদি, বাবা, আমি সবাই মিলে সংসারে বেঁচে থাকার জন্য কত যে কষ্ট করেছি তা বলতে গেলে সত্যি চোখে জল আসে। ইতোমধ্যে বাবা শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। বাবার দেখভাল চম্পা দিদি একটু বেশিই করতো। টাকার অভাবে ভালো ডাক্তার হয়তো দেখাতে পারিনি বাবাকে তথাপি চেষ্টার ত্রুটি ছিল না এক বিন্দুও। সংসারে আরও অভাব চেপে বসবে বিধায় বাবা রোগের কথা চাপাই রাখত। নিজে কষ্ট পেত, লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত তবু অসুখের কথা কাউকে বলতো না। এমনকি মাকেও না। চিতলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বাবাকে ভর্তি করি ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ডাক্তার বললেন জন্ডিস ধরা পড়েছে, অর্থাৎ লিভারে সমস্যা। সেবা শুশ্রুষা করার পরও কোনো উন্নতি দেখা গেল না। ডাক্তার বললেন ‘‘বাড়ি নিয়ে যান এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে।” আমরা সেই ভরসায় রইলাম সেদিন।
৮ অক্টোবর বাবার শরীর পুনঃরায় খারাপ হলো। আমরা বরিশালের এক ভালো ডাক্তারের পরামর্শ নিলাম। তাঁর পরামর্শে পরদিন খুলনা নিয়ে যাওয়া হবে। তিনি সঙ্গে থাকবেন। রাতে শরীরটা আরও খারাপ হলো বাবার। দিশা না পেয়ে বিভিন্ন যায়গায় পরামর্শ করতে লাগলাম। আর ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম যেন বাবা এ রোগ থেকে মুক্তি পান। সকাল হতে না হতে আমি বরিশালের ঐ ডাক্তারকে আনতে যাই। পূর্বে এম্বুলেন্স খবর দেওয়া হলো। কারণ, খুলনা নিতে হলে অবশ্যই এম্বুলেন্স দরকার। আমি ডাক্তার বাবুকে নিয়ে আসি। তখন প্রায় ৮টা বাজে ঘড়িতে। কিছুটা দূর থেকে দেখতে পাই আমাদের বাড়ির সামনে অনেক লোকজন ভীড় করে আছে। অথচ নীরব থমথমে পরিবেশ। আমি বুঝে উঠতে পারিনি কী ঘটেছে! হঠাৎ এম্বুলেন্স চলে যেতে লাগল আমার পাশকেটে। আমি অবাক হলাম! বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতে আমাকে দেখে মা ‘‘ও—মিলন” বলে চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করে দিলেন। আমার মাথায় তখন যেন কঠিন বাঁজ পড়ল। মুহূর্তে কান্নার ধ্বনি ছড়িয়ে গেল আমাদের সমস্ত বাড়িতে। করুণ কান্নার রোল মাতিয়ে তুলল সমস্ত বাড়িময়। কাঁদতে কাঁদতে আমি পড়ে গেলাম মাটিতে। তারপর কী হলো জানি না।
চেতনা ফিরে পেলে দেখি অনেক চেনা-অচেনা মুখ। সবাই স্বান্তনা দেওয়ার খুব চেষ্টা করছে। জানতে পারলাম, হাসপাতাল থেকে সেদিন বাবাকে নিয়ে যেতে বলেছিলেন, তার একটাই কারণ, বাবার ‘‘ব্লাড ক্যান্সার” ধরা পড়েছিল, অর্থাৎ মৃত্যুই ছিল অনিবার্য, ঘটলও তাই। ৯ অক্টোবর আমার জীবনে বিভীষিকাময় এক করুণ স্মৃতি। আজও ৯ অক্টোবর এলে আমার সজল চোখে ভেসে ওঠে সেই বেদনা ঘন ছবি। ধরে রাখতে পারি না চোখের জল।
– শোন অসীম, প্রত্যেকের বুকের নিভৃতে কিছু দগ্ধক্ষত থাকে লুকানো, কিছু অসম্পূর্ণ নির্মাণ, ভাঙ্গাচোরা গেরস্থালি ঘরদোর, প্রত্যেকের নিজস্ব কিছু নিদ্রাহীন রাত্রি থাকে, যাকে চিরদিন নষ্ট নখের মতো রেখে দিতে হয় কোমল অনিচ্ছার বাগানে, যাকে শুধু লুকিয়ে রাখতেই সুখ, নিজের নিভৃতে রেখে গোপনে পোড়াতেই একান্ত পাওয়া। অতএব, দুঃখ কীসের? চল্ রান্না মনে হয় শেষ হয়েছে।
– চল
হাঁটতে হাঁটতে বনভোজনের হৈ চৈ এর ভিতর প্রবেশ করলাম দু’জন।