মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাবে ১৯১৩ সালে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের প্রতিষ্ঠার পর থেকে ডলার প্রাথমিকভাবে ফেডারেল রিজার্ভ নোট আকারে জারি করা হয়। অর্থাৎ ১৯১৪ সাল থেকে ব্যাংক নোট হিসেবে ডলার বাজারে আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডলার এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্যবহারের জন্য বিশ্বব্যাপী সরকার কর্তৃক ধারণ করা বিশ্বের প্রাথমিক রিজার্ভ মুদ্রা। পৃথীবিতে যত লেনদেন হয় তার ৮০%-এরও বেশি হয় মার্কিন ডলারের মাধ্যমে। প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে মুদ্রা হিসেবে ডলার এতটা শক্তিশালী হয়ে উঠলো? কেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেন ডলারেই করতে হয়? কেন ক্রুড ওয়েল এবং স্বর্ণ ডলারে কেনাবেঁচা হয়? আইএমএফ-এর তথ্য অনুসারে, বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভের প্রায় ৬২ শতাংশই মজুত আছে ডলারে। বাকি অংশের মধ্যে ২০ শতাংশ আছে ইউরোতে। জাপানের ইয়েন ও ব্রিটিশ পাউন্ডে সংরক্ষিত আছে প্রায় ৫ শতাংশ করে রিজার্ভ। দেশগুলো তাদের আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রয়োজন মেটাতেই ডলার মজুদ করে থাকে। ডলারের আগে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য ছিলো ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ডের, কারণ, তখন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বৃটিশ কলোনি ছিলো। ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ডের বিশ্বব্যাপী আধিপত্য ছিলো ১৯২০ সাল পর্যন্ত। এর আগে ফ্রান্স, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ড ও স্পেনের মুদ্রা ছিলো মান নির্ণায়ক মুদ্রা। অর্থাৎ মুদ্রার আধিপত্যের সাথে কলোনি বিস্তার এবং যুদ্ধের বা সেনাশক্তির একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
ডলার যেভাবে মুদ্রা ব্যবস্থার মানদণ্ড হলো
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ী মিত্রশক্তির ৪৪টি দেশের প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের শহর ব্রেটনউডসে একটি সার্বজনীন মুদ্রাব্যবস্থার জন্য একটি বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হয়ে বৈঠকটি চলে ২২ জুলাই পর্যন্ত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বিশ্ব অর্থনীতি খুবই নড়বড়ে ছিল, বিশেষ করে ইউরোপ খুবই ক্ষতিগ্রন্থ হয়েছিলো। এবং মিত্রদেশগুলো মুদ্রা বিনিময়ে সমস্যা জর্জরিত ছিলো, বিরাজমান সমস্যাগুলোর জন্য আলোচনা ও সমাধানের জন্য মিলিত হতে চেয়েছিলো দেশগুলো। আর তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নতুন করে আর্থিক ব্যবস্থার রূপরেখা কেমন হবে, মূলত এ নিয়েই বসেছিল বৈঠকটি। একটি টেকসই বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থা তৈরি করা, মুদ্রার প্রতিযোগিতামূলক অবমূল্যায়ন রোধ করা এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রচারের প্রধান লক্ষ্য নিয়ে ছিলো এই বৈঠক। এই বৈঠকে যে রূপরেখাটি চূড়ান্ত হয়, তার নাম ছিল ব্রেটনউডস্ ফাইনাল অ্যাক্ট।
ওই সময় বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে ‘পার ভ্যালু’ নিয়ে তিনটি সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমত, প্রতিটি দেশ মার্কিন ডলারের সঙ্গে তাদের পার ভ্যালু বা বিনিময় হার ঘোষণা করবে। দ্বিতীয়ত, ঘোষিত পার ভ্যালুর উভয় পাশে দেশীয় মুদ্রার বিনিময় হারের হেরফের ১ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অনুমোদন ছাড়া পার ভ্যালু পরিবর্তন করা যাবে না। মূলত ১৯৪৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মার্কিন ডলারের বিনিময় হারকেই সব সদস্যদেশ তাদের প্রাথমিক পার ভ্যালু হিসেবে বেছে নেয়। আর ডলারের ভ্যালু নির্ধারিত হয়েছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণের মজুদের ওপর ভিত্তি করে।
ডলার খরচের খাত বা ডলার যে কারণে রিজার্ভ রাখতে হয়
পৃথিবীতে যত আন্তর্জাতিক লেনদেন হয় তার বেশিরভাগই হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা ডলারের মাধ্যমে। মুদ্রা বাজারগুলোতে যত শতাংশ কেনাবেঁচা করা হয় তার ৯০%-ই ডলারে হয়। আন্তর্জাতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে ডলারের আধিপত্যই এর কারণ। একটা দেশের জন্য ডলার ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয় আমদানি এবং রপ্তানিতে। বাংলাদেশে যেহেতু আমদানি এবং রপ্তানির মধ্যে বিশাল একটি ঘাটতি রয়েছে, তাই রপ্তানি করে যে পরিমাণ ডলার আয় হয় আমদানি করতে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ডলার ফুরিয়ে যায়। এদিক থেকে রিজার্ভে ডলার ঘাটতি তৈরি হয়। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ডলারের রিজার্ভ রয়েছে ৩৫.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২১ সালে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ৮৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। অপরদিকে রপ্তানি করেছে ৫২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। বিশাল এ বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে বাংলাদেশ নির্ভর করে রেমিট্যান্স এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর। ২০২১ সালে ২২ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স আসে, অর্থাৎ রপ্তানি আয়ের সাথে রেমিট্যান্স যোগ করলেও আমদানি ব্যয়ের সমান হয় না। এরকম বাস্তবতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে রিজার্ভ ধরে রাখা বিশাল এক চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের মতো উন্নয়শীল দেশের ক্ষেত্রে ডলার আয়ের আরেকটি ক্ষেত্র হচ্ছে বৈদেশিক সাহায্য।
ডলার ব্যয়ের আরো কয়েকটি ক্ষেত্র রয়েছে— যেমন, চিকিৎসা ব্যয়, ভ্রমণ ব্যয়, আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ ইত্যাদি। বিদেশ ভ্রমণে যেতে একজন ব্যক্তি একবারে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার ডলার খরচ করতে পারে, তবে বছরে খরচ করতে পারবেন বারো হাজার ডলার। ব্যাপক বৈষম্যের এ দেশে একটি শ্রেণি রয়েছে, যারা এ ধরনের ভ্রমণ করতে সামর্থ রাখে এবং তারা তা করে থাকে, এদিক থেকেও দেশে এখন ব্যাপক ডলারের চাহিদা রয়েছে। প্রচুর মানুষ এখন চিকিৎসা করতে দেশ থেকে বিদেশে যায়। চিকিৎসার ক্ষেত্রে বারো হাজার ডলারের বাইরে আরো দশ হাজার ডলার সঙ্গে নেওয়া যায়। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে অনলাইনে কেনাকাটা বা ফেসবুক বা গুগলের মতো মিডিয়াগুলোতে বিজ্ঞাপন দেওয়া ডলার খরচের আরেকটি খাত। শিক্ষা খাতেও বাংলাদেশের প্রচুর ডলার ব্যয় হয়। বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে পড়াশুনা করে, যারা তাদের শিক্ষা ব্যয় মিটিয়ে থাকে বাংলাদেশ থেকে ডলার পরিশোধ করে।
রিজার্ভ কেন গুরুত্বপূর্ণ
আয় থেকে ব্যয় মেটানোর পর যে অর্থ অবশিষ্ট থাকে সেটিই মূলত রিজার্ভ কারেন্সি। যেহেতু এ রিজার্ভটি রাখা হয় বৈদেশিক মুদ্রায়, তাই এ রিজার্ভকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বলে। সাধারণত একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ রিজার্ভ মেইনটেইন করে থাকে। নির্দিষ্ট সময় পর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের অবস্থা ঘোষণা করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মুদ্রা থাকায় একটা সময় পর্যন্ত স্বর্ণই ছিলো লেনদেনের প্রধান মাধ্যম। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ঋণী হয়ে প্রচুর স্বর্ণ হারিয়ে ফেলে, ফলে তাদের পক্ষে নিজস্ব মুদ্রার বিপরীতে স্বর্ণের মজুদ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। এ কারণে ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস্ চুক্তির মাধ্যমে নতুন নিয়ম চালু হয়— একমাত্র মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্বর্ণ মজুদ থাকবে। ৩৫ ডলারে ১ আউন্স, এভাবে তখন ধরা হয়েছিলো, বাদবাকী সকল মুদ্রা ডলারের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখবে। এভাবে মার্কিন ডলার হয়ে উঠলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাধারণ মুদ্রা। এরপর থেকে বিভিন্ন দেশ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ডলারে রাখা শুরু করে। যে দেশের রিজার্ভ যত বেশি সে দেশের অর্থনীতি তত শক্তিশালী, যদিও শক্তিশালী অর্থনীতির আরো অনেক মানদণ্ড রয়েছে। একটি পরিবার যেমন সঞ্চয় থাকলে স্বস্তিতে থাকে, একটি দেশও তেমন রিজার্ভ ভালো থাকলে স্বস্তিতে থাকে, কারণ, তখন আমদানী ব্যয় মেটানো সহ নতুন নতুন উদ্যোগ নেওয়া দেশটির জন্য সহজ হয়। কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ থাকলে কোনোমতে দেশটি চলছে বলে ধরে নেওয়া হয়, এর নিচে নেমে গেলে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিতে রয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।
দ্রব্যমূল্য কেন বাড়ে
দেশে ডলার সংকট তৈরি হলে ডলারের দাম বেড়ে যায়। ফলে আমদানি ব্যয় মেটাতে বেশি খরচ করতে হয়, যার প্রভাব পড়ে দ্রব্যমূল্যের ওপর। করোনা সংকট কাটিয়ে উঠতে প্রায় সব দেশের অর্থনীতিই টালমাটাল। উন্নত দেশগুলোতেও মূল্যস্ফিতি বেড়েছে। জাপান, যেখানে ১৯৮০ দশকের মন্দার পর ধারাবাহিকভাবে জিনিসপত্রের দাম কমে আসছিলো বলে মূল্যস্ফীতি ছিল ঋণাত্মক, সেই দেশটিতেও গত ডিসেম্বরে প্রায় ১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। সহজ কথায় একটি দেশে মূল্যস্ফিতি তখনই হয় যখন মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায়, কিন্তু পণ্য বা সেবার মান একই থাকে। অর্থাৎ বেশি টাকা দিয়ে কম পণ্য বা সেবা কিনতে হয়।
করোনা অতিমারির কারণে ২০২০ এবং ২০২১ জুড়ে মানুষের জীবন যখন স্থবির ছিল, তখন মানুষ খরচ করেছে স্বাস্থ্য সুরক্ষার পিছনে। কিন্তু হঠাৎ করে বৈশ্বিক অবস্থা আবার স্বাভাবিক হওয়ায় মানুষের অন্যান্য সকল চাহিদা একসাথে হঠাৎ করে বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে বিদেশ ভ্রমণ, কেনাকাটা এবং পরিবহনের চাহিদাও বেড়েছে। এ চাহিদার সাথে যোগানের ভারসাম্য না থাকায় ডলারের চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু পণ্যের যোগান বাড়েনি, এ কারণে হঠাৎ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত যে সকল পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কথা নয়, সেগুলোর দামও বেড়েছে, কারণ, মুদ্রাস্ফিতির কারণে ঝুঁকি মোকাবেলা করতে সকলেই মনস্তাত্ত্বিকভাবে অতিরিক্ত আবদার করছে ভোক্তার কাছে। বৈশ্বিক মূল্যস্ফিতি বাড়ায় এবং তেলের দাম সহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় মূলত আমদানী নির্ভর দেশগুলো বিপদে পড়েছে, কারণ, তাদের আগের তুলনায় অনেক বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে, কিন্তু উৎপাদন বা সেবার মান বাড়েনি।
ডলারের বিকল্প কী হতে পারে
শক্তিশালী মুদ্রা হওয়ায় বিশ্বের অনেক দেশই এটিকে (ডলার) ‘রিজার্ভ মুদ্রা’ হিসেবে বেছে নিয়েছে। তবে এখন পরিস্থিতির বদলাতে শুরু করেছে। বিশ্বের অনেক দেশ— বিশেষ করে চীন এবং রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের এ একক আধিপত্য আর মানতে চাচ্ছে না। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ক্ষুন্ন করতে বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টা দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে চীন ও রাশিয়া কয়েক বছর ধরেই কাজ করে যাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ডলারের আধিপত্য রুখতে এটি একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রূপ নিতে পারে। এরই মধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে ডলারের বিকল্প হিসেবে রুবল দিয়ে লেনদেন করছে রাশিয়া। একইসঙ্গে চীনের ইউয়ান দিয়েও সংঘটিত হচ্ছে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক লেনদেন। এমনকি আমাদের পাশের দেশ ভারতও আমিরাতের দিরহাম, চীনের ইউয়ান, হকংয়ের ডলার দিয়ে রাশিয়া থেকে জ্বালানী কিনছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র যতোটা ভেবেছিল ততোটা প্রভাব পড়েনি রাশিয়ার ওপর। বরং নিষেধাজ্ঞায় উল্টো কিছুটা ফুলে ফেঁপে উঠেছে রুশ মুদ্রার মান। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কমে যাওয়া ঠেকানোর পাশাপাশি ডলারের সংকট সামাল দিতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ডলারের বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনের কথা ভাবছে বাংলাদেশ সরকারও। বাংলাদেশ আমাদানির ৪০% করে থাকে চীন এবং ভারতের সাথে, সেক্ষেত্রে চীনের মুদ্রা ইউয়ান এবং ভারতের মুদ্রা রুপিতে আমদানি রপ্তানি করা যায় কিনা সে বিষয়ে ভাবতে শুরু করেছে বাংলাদেশ।
এদিকে রাশিয়া ও চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্রিকস দেশগুলো গত ২৩ জুন (২০২২) চীনের বেইজিংয়ে তাদের ১৪তম শীর্ষ সম্মেলনে নতুন একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা প্রচলনের পরিকল্পনার কথা জানায়। তাতে বলা হয়, পাঁচটি প্রধান উদীয়মান অর্থনীতির নেতারা আন্তর্জাতিক রিজার্ভ মুদ্রা তৈরির জন্য একমত হয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্রিকস মুদ্রা মার্কিন ডলার এবং আইএমএফের স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস (এসডিআর) মুদ্রার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য শক্তিশালী হবে। ব্রিকস সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেন, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা একটি ‘নতুন বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা’ চালু করার পরিকল্পনা করেছে। এ ছাড়া তুরস্ক, মিসর ও সৌদি আরব ব্রিকসে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছে।
প্রশ্ন হচ্ছে মার্কিন ডলারের বিকল্প হিসেবে চীনের মুদ্রা ইউয়ান বা রাশিয়ার মুদ্র রুবল বিকল্প হতে পারবে কিনা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে এ প্রশ্ন আরো জোরালো হয়েছে। বহুবছর ধরে পৃথীবিতে স্বর্ণের মজুদের ওপর ভিত্তি করে অর্থনৈতিক লেনদেন এবং শক্তি বিবেচিত হতো। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র দেশগুলোর কাছে যেসব সামরিক সরঞ্জাম এবং অন্যান্য পণ্য বিক্রি করেছে তার মূল্য পরিশোধ করা হয় স্বর্ণের মাধ্যমে। এর ফলে বিশ্বের মোট রিজার্ভ স্বর্ণের ৭০% চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। এ কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তির ৪৪টি দেশ ব্রেটন উডসে মিলিত হয়ে মার্কিন ডলারকে মানমুদ্রা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়। যেহেতু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তেমন কোনো আঁচড় যুক্তরাষ্ট্রের গায়ে লেগেছিলো না, তাই আমেরিকার পক্ষে সহজ হয়েছিলো মিত্র দেশগুলোকে রাজি করাতে। ফলে তাদের স্বর্ণের রিজার্ভের ওপর ভিত্তি করে মুদ্রার মান ঠিক করা হয়েছিলো, যে স্বর্ণের বেশিরভাগ তারা পেয়েছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে পারস্পারিকভাবে ঘায়েল হওয়া দেশগুলোর কাছ থেকে।
১৯৭১ সালের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ঘোষণা করলেন— স্বর্ণের মজুদের ওপর ভিত্তি করে ডলারের মূল্য আর নির্ধারিত হবে না। বিশ্বজুড়ে মার্কিন ডলারের আধিপত্য ধরে রাখতে এবং বাজার বাড়াতে ১৯৭৩ সালে সৌদি আরবের সাথে একটি চুক্তি করে আমেরিকা। চুক্তিতে বলা হয় যে, সৌদি আরব যে দেশের কাছেই তেল বিক্রি করুক না কেন তা করতে হবে ডলারে, বিনিময়ে সৌদি আরবকে বহি:শত্রুর হাত থেকে সুরক্ষা দেবে আমেরিকা। ১৯৭৫ সালে তেল উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশগুলোকেও একই সিদ্ধান্ত নেওয়াতে সক্ষম হয় আমেরিকা। ফলে প্রত্যেক দেশেরই রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলার প্রয়োজন হয়।
এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক— সৌদি আরব তার ২৫% তেল রপ্তানি করে চীনে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই চীন সৌদি আরবের সাথে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা করছে যাতে তেলের মূল্য ডলারে পরিশোধ না করে চীনের মুদ্রা ইউয়ানে পরিশোধ করা যায়। কিন্তু এ বিষয়ে সৌদি আরব ও চীন এখনো একমত হতে পারেনি। বিষয়টি আরেকটু সহজ করে বলা যেতে পারে— ইংরেজি ভাষাটা জানা থাকলে যেকোনো দেশেই তা যেমন চালিয়ে দেওয়া যায়, তেমনি হাতে ডলার থাকলে যেকোনো দেশেই তা খরচ করা যায়, অন্য কোনো মুদ্রায় এখনো যেহেতু বিশ্বব্যাপী এই সুবিধা নেই, ফলে এখনই কোনো দেশ এই ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। ধরা যাক— বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে সব উপার্জন রুপিতে নিলো, তাহলে তাকে এই রুপি ভারতেই খরচ করতে হবে, স্বাধীনভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশে খরচ করার সুযোগ নেই যদি না রুপি সর্বসম্মতভাবে বিশ্বব্যাপী একটি সাধারণ মুদ্র না হয়ে ওঠে। প্রশ্ন হচ্ছে— যুক্তরাষ্ট্রই কি পৃথিবীর প্রয়োজনীয় সব পণ্যের বেশিরভাগ রপ্তানি করে? সহজ উত্তর হচ্ছে— ‘না’। সেটি না করেও তাহলে ডলার কেন একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা এবং তা এত শক্তিশালি? এ প্রশ্নের উত্তর মূলত লুকিয়ে আছে বৈশ্বিক রাজনীতি এবং যুদ্ধের প্রয়োজনিয়তা এবং বাস্তবতার মধ্যে।
বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যত রিজার্ভ কারেন্সি আছে আইএমএফ-এর হিসেবে অনুযায়ী তার মাত্র ২.৭৯% আছে চীনের মুদ্রায়, অন্যদিকে আমেরিকান ডলারে বৈদিশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে ৫৮.৮১ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ইউরো— ২০.৬৪ শতাংশ। ফলে এখনই বিশ্ববাজারে ডলার তার আধিপত্য হারাবে এমন কোনো ইঙ্গিত নেই। তবে ডলারের পাশাপাশি অন্য অনেক দেশের মুদ্রা শক্তিশালী হতে পারে এবং সেসব মুদ্রায় লেনদেন বাড়তে পারে। ফলস্বরূপ বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো রিজার্ভ রাখার ক্ষেত্রে ডলারের পাশাপাশি অন্য অনেক মুদ্রার দিকেও হয়ত নজর রাখবে।