অদম্য ধাবমান!

1

আজ থেকে এগারো বছর আগে। বাংলাদেশ থিয়েটার টরন্টো জাতিকে একটি নবজাত শিশু উপহার দিল। সেই শিশু মানবাধিকারের পতাকা হাতে প্রচণ্ড তারুণ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আজও অদম্য ধাবমান।

জুলাই ২০০৫। টরন্টোতে ‘শৃঙ্গার’ আয়োজিত তিন দিনের নাট্য প্রতিযোগিতায় প্রায় ২২টি নাটক প্রতিযোগিতা করছে, বিচারক হিসেবে আনা হয়েছে ঢাকা থেকে বিখ্যাত অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী, কোলকাতা থেকে বর্ষীয়ান নাট্য ব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত ও ড: দেবজিৎ ব্যানার্জীকে। তিন বিচারক সর্বসম্মতিক্রমে, যা প্রায়ই হয়না, বাংলাদেশ থিয়েটার টরন্টো’র হিল্লা বিয়ের ওপরে “নি:শব্দ গণহত্যা” নাটককে দিলেন প্রথম পুরস্কার, এ নাটকে ইসলামী সুত্রসহ দেখানো হয়েছে কেন তাৎক্ষণিক তিন-তালাক ইসলাম-বিরোধী। সাথে আমাদের আকতার হোসেনের অসাধারণ নাটক “আলতাবানু” পেল “শ্রেষ্ট পাণ্ডুলিপি” পুরস্কার। পরের কিছু ঘটনা:-

১. এ পুরস্কারের খবর দেশে ছাপা হলে পরিচালক রাকিবুল হাসান এটাকে ইংরেজী সাবটাইটেল সহ সিনেমায় রূপ দেন “হিল্লা” নামে, অভিনয়ে রাইসুল ইসলাম আসাদ ও ইলোরা গহর।
২. অনেক চেষ্টাতেও দেশের কোনো টিভি চ্যানেল এটা দেখাতে রাজী হয়নি।
৩. সুশান্ত দাসগুপ্তের আর্থিক সহায়তায় ইউটিউবে দেয়া হলে “হিল্লা” অজস্র মাধ্যমে দুনিয়াময় ছড়িয়ে পড়ে।
৪. তুর্কীস্থানের ও মালয়েশিয়ার দুই মুসলিম একে তাঁদের ভাষায় সাব টাইটেল করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন যাতে তাঁদের জাতিও দলিলগুলো জানতে পারে।
৫. ইউরোপ-আমেরিকা-ভারতে বিভিন্ন ইসলামী কনফারেন্সে এটা দেখানো হয়, বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন সমর্থন পাঠান।
৬. ভারতে ইসলামিক রিসার্চ ইন্সটিটিউট মুভি’র ৩০০ ডিভিডি কপি করে প্রত্যন্ত মুসলিম নারী-সংগঠনের কাছে পৌঁছে দেন।
৭. আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এটা দেখানো হয় আমেরিকার লস অ্যানজেলেস শহরে ।
৮. ইংল্যান্ড ও ক্যানাডায় দুজন শিক্ষক তাঁদের ক্লাসে এটা শিক্ষা-বিষয় হিসেবে ক্রমাগত প্রদর্শন করেন। ইত্যাদি ইত্যাদি।

“হিল্লা”র সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ইসলামী দলিলবদ্ধ আরো তিনটি রোম্যান্টিক মুভি বানিয়ে দেখানো হয়েছে কিভাবে কোরান-রসুল দিয়েই সমাজকে জঙ্গীবাদ-মুক্ত করা সম্ভব। ঢাকার মিডিয়া, রাজনীতি ও সুশীল সমাজের ঢক্কানিনাদ থেকে বহুদূরে নেতা-কর্মীরা গত চার বছর ধরে ৩টি অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে মুভিগুলো দেখাচ্ছেন। জনগনের ওপরে এর প্রভাব সুগভীর, ওইসব গ্রামে আর কোনদিন ইসলামের নামে জঙ্গীবাদ ঢুকতে পারবে না। ঢাকা-কেন্দ্র থেকে মুভিগুলোর তিন হাজার ডিভিডি বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে ও হচ্ছে দেশের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার নেতা-কর্মী, সাংবাদিক-শিক্ষক, নারী-সংগঠন ও আলেমদের মধ্যে। ক্যানাডা’র “মুসলিমস ফেসিং টুমরো” সংগঠনের এই “জঙ্গীমুক্ত বাংলাদেশ” আন্দোলন ছবিসহ রিপোর্ট করেছে ৭১-টিভি ও ইংল্যান্ড-এর ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস, ইউ. কে। পদ্ধতিটা শান্তিপূর্ণ, এতে নেই টাকা বা নেতৃত্বের কোন্দল। দেশে গণহারে গ্রেপ্তার করে জঙ্গীবাদ উচ্ছেদ হবে? হবেনা, কোনকালেও হয়নি।

জাতি আজ ইসলামের নামে জঙ্গীবাদের দুর্যোগে পড়তনা যদি এ আন্দোলন পঞ্চাশ বছর আগে শুরু হত। ছোট ছোট অজস্র ঘটনায় নীরব বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ৭৩টি গ্রামে দেখানোর প্ল্যান করেছেন, অন্য জায়গায় স্থানীয় বিএনপি নেতা জনগণের মধ্যে ছড়াচ্ছেন মুভিগুলো। ইমাম মুসল্লীদেরকে দেখিয়েছেন তারাবী নামাজের পর। খতিব বইটা মসজিদে রেখেছেন, সবাইকে পড়তে বলছেন। দুটি গ্রামে হিল্লা বিয়ে প্রায় হতে যাচ্ছিল, কর্মীরা মুভিটি ইমামদের দেখালে তাঁরা ফতোয়া ফিরিয়ে নেন। আরেক গ্রামে এক নারী কেঁদে বলেছিল এ মুভি আগে দেখলে তাকে হিল্লা’র অপমান ও জিল্লতি ভুগতে হত না, ইসলামের নামে ধর্ষিতা হতে হত না। কিছু ইমাম তাঁদের খোতবায় দলিল দিয়ে দেখাচ্ছেন কিভাবে ইসলামের নারী-বান্ধব ব্যাখ্যা দিয়ে নারী-বিরোধী ব্যাখ্যাকে পরাস্ত করা যায়। মাদ্রাসার বর্ষীয়ান অধ্যক্ষ মুভিগুলো নিয়ে চট্টগ্রামের শফি হুজুরের কাছে রওনা দিচ্ছিলেন, তাঁকে থামানো হয়েছে। বিয়েতে পাত্রীপক্ষ জনতাকে দেখিয়েছে, পাত্রপক্ষ ডিভিডি নিয়ে গেছে তাদের গ্রামে দেখাবে বলে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে জনগন কোরান-রসুলের দলিল নিয়ে সোচ্চার হচ্ছে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে।

এ শুধু শুরু। বিলাসিতা নয় বরং জাতির এই প্রয়োজনের, অস্তিত্বের আন্দোলন আরো অনেকদুর যাবে। বাংলাদেশ থিয়েটার টরন্টো’র সেই ছোট্ট শিশু আজ দুর্দান্ত তারুণ্যে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে অদম্য ধাবমান !!