একে অন্যের ঘাঁটি ব্যবহারে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি

একে অন্যের স্থল, আকাশ ও নৌঘাঁটি ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত গত সোমবার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সামরিক সরঞ্জাম মেরামত ও নতুন রসদ জোগানের জন্য এসব ঘাঁটি ব্যবহারের সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞ মহল চুক্তিটিকে দুই দেশের সম্পর্কের জন্য একটি মাইলফলক হিসেবে দেখছে। তারা বলছে, সম্ভাবত চীনকে সামনে রেখেই এ চুক্তি করল নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটন। তবে বেইজিং এ চুক্তি নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া না জানালেও আশা প্রকাশ করেছে, চুক্তিটি ‘গঠনমূলক ও ইতিবাচক’ হবে।
চুক্তি স্বাক্ষরের পর ওয়াশিংটনে গতকাল ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকরকে নিয়ে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশ কার্টার। এ সময় তিনি বলেন, এ চুক্তির ফলে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর যৌথ অভিযানে উপকরণগত সহযোগিতা আরও কার্যকর ও সহজ হবে। আর মনোহর পারিকর বলেন, সামরিক এ চুক্তির ফলে ভারত ও মার্কিন নৌসেনারা পরস্পরকে আরও সহজতর উপায়ে সহযোগিতা করতে পারবে। সেই সঙ্গে মহড়ায় অংশ নেওয়া ও মানবিক সহায়তা দেওয়ার সময়ও তারা খুব সহজেই একত্রে কাজ করতে পারবে।
পারস্পরিক নিরাপত্তা সহযোগিতায় নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে ওয়াশিংটন বরাবর আগ্রহী হলেও এ ধরনের একটি চুক্তি ছাড়া তা সম্ভব হচ্ছিল না। তবে চুক্তিটি নিয়ে ভারতে একটা অস্বস্তি রয়েছে। অনেকেরই ধারণা, এ চুক্তির ফলে মার্কিন সেনারা ভারতের ঘাঁটিতে অবস্থান করতে পারবে। কেউ কেউ মনে করছেন, এ চুক্তি আসলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক জোট গড়ার চুক্তি, যার কারণে ভারতের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়েও কথা বলেন কার্টার ও পারিকর। তাঁরা দুজনই বলেছেন, এ চুক্তির মানে এই নয় যে ভারতে মার্কিন সেনারা ঘাঁটি গাড়বে। কার্টার বলেন, এটা কোনো রকমের ঘাঁটি গাড়াসংক্রান্ত চুক্তি নয়।
আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা ওয়াশিংটনভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান স্টিমসন সেন্টারের গবেষণা-সহযোগী শেন মেসনের মতে, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত এ চুক্তি নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনের কিছু ব্যক্তির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালানোয় এই যুক্তরাষ্ট্রই ভারতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, যদিও পরে তার শর্তগুলো শিথিল করা হয়।
মেসন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে চিন্তা করলে, বিষয়টি খুব সাধারণ একটা ব্যাপার। বহু দেশের সঙ্গেই এমন সামরিক চুক্তি রয়েছে ওয়াশিংটনের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা নিয়ে তেমন কোনো বিতর্ক নেই।
তবে মার্কিন সেনাবাহিনী পরিষ্কার করে দিয়েছে, চীন যে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যার সৃষ্টি করছে, তা মোকাবিলা করতেই ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতায় তারা কাজ করতে চায়। বিশেষ করে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক জলপথ দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের দাবি এবং কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ এসব সমস্যা আরও জটিল করে তুলছে।
সংবাদ ব্রিফিংয়ে সরাসরি চীনের নাম উচ্চারণ না করলেও কার্টার ও পারিকরের কথায় দুই দেশের মধ্যে সহজতর পণ্য পরিবহন এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারের বিষয়গুলো উঠে আসে। পারিকর বলেন, নিয়মনীতি মেনে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অবাধ নৌ ও বিমান পরিবহন এবং নির্বিঘ্ন বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র সমান আগ্রহী।
এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে চীন আশা প্রকাশ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার এ চুক্তি আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের ‘গঠনমূলক ও ইতিবাচক’ হবে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনাইং গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের এই স্বাভাবিক সম্পর্ককে আমরা স্বাগত জানাই।’
এদিকে, গতকাল বিবিসি বাংলা জানায় যে ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল শংকর রায় চৌধুরী বলেছেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, এককালে নন-অ্যালাইন (পক্ষপাতহীন) ছিলাম। নিরপেক্ষ ছিলাম। এখন আমরা রাষ্ট্রীয় স্বার্থের খাতিরে একটা দিক ধরেছি। এখন আমরা নন-অ্যালাইন নেই। আমরা এখন অ্যালাইন হয়েছি আমেরিকার সঙ্গে। সেই সঙ্গে এখন আমাদের দেখতে হবে, আমাদের অন্য পুরোনো বন্ধু আছে, যেমন রাশিয়া ইত্যাদি, তাদের ওপর কী এফেক্ট (প্রভাব) হবে, পুরোনো বন্ধুদের রিঅ্যাকশন (প্রতিক্রিয়া) হবে এবং সেটা আমরা দেখব।’
টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক খবরে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের চুক্তিতে চীন, পাকিস্তান এমনকি রাশিয়াও ক্ষুব্ধ হতে পারে বলে জানিয়েছে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম। তারা বলেছে, নয়াদিল্লির জন্য এটি ‘কৌশলগত সমস্যা’ হয়ে দেখা দিতে পারে।
চুক্তিতে দুই প্রতিরক্ষামন্ত্রীর স্বাক্ষরের আগে চীনের রাষ্ট্রপরিচালিত গ্লোবাল টাইমস পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়লে ভারত তাদের কৌশলগত নিরপেক্ষতা হারাতে পারে।

সূত্র: প্রথম আলো