যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে মহাত্মা গান্ধী হিটলারকে যে চিঠি লিখেছিলেন

মহাত্মা গান্ধী এবং অ্যাডলফ হিটলার

একজন অহিংস আন্দোলনে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত। তিনি ভারতের জাতির জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। আরেকজন অ্যাডলফ হিটলার— যিনি যুদ্ধবাজ, নাৎসি জাতীয়তাবাদ, ইহুদি বিদ্বেষ ও সমাজতন্ত্র বিরোধিতার জন্য কুখ্যাত হয়ে আছেন। ১৯৩৯ সালের ২৩ জুলাই জার্মান বাহিনী পোল্যান্ড আক্রমণের কিছুদিন আগে হিটলারকে ‘বন্ধু’ সম্মোধন করে (পরের চিঠিতে এ সম্মোধনের ব্যাখ্যা অবশ্য তিনি দিয়েছেন) হিটলারকে চিঠি লেখেন মহাত্মা গান্ধী। দ্বিতীয় চিঠিটি তিনি লেখেন ২৪ ডিসেম্বর ১৯৪০-এ, যেটি অনেক বেশি বিশ্লেষণাত্বক। কিন্তু তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে চিঠি দুটি কখনোই প্রাপকের কাছে পৌছায়নি। উল্লেখ্য, হিটালারের সাথে মহাত্মা গান্ধীর কখনো দেখা হয়নি, যদিও ইতালির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বেনিত্তো মুসোলিনির সাথে তার একবার দেখা হয়েছিল (১১ ডিসেম্বর ১৯৩১) বলে জানা যায়। সে সাক্ষাতে মুসোলিনির প্রতিও তিনি একই আহ্বান জানিয়েছিলেন। 

হিটলারকে লেখা গান্ধীর চিঠি
অ্যাডলফ হিটলারকে লেখা মহাত্মা গান্ধীর প্রথম চিঠি। কার্টেসিঃ দ্যা গার্ডিয়ান।

২৩ জুলাই ১৯৩৯

প্রিয় বন্ধু,

বন্ধুরা আমাকে মানবতার স্বার্থে আপনাকে লিখতে অনুরোধ করছে। তবে আমি তাদের অনুরোধটিকে এই ভেবে প্রতিহত করেছি যে, এটা এই মুহূর্তে বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। কিন্তু আমার মন বলছে, অবশ্যই আমার এতটা হিসেব করা ঠিক হচ্ছে না এবং কোনো কাজ হতেও পারে এই ভেবে আমি লিখছি।

এটি পুরোপুরি স্পষ্ট যে, আপনিই আজ বিশ্বের অদ্বিতীয় সেই ব্যক্তি, যিনি মানবতাকে বিপন্ন করে তোলা এই যুদ্ধটাকে প্রতিরোধ করতে পারেন। আপনার নিজের যা-ই মনে হোক না কেন এরকম কোনো কিছুর জন্য আপনাকেও কি অবশ্যই মূল্য দিতে হবে না? আপনি কি এমন একজনের কথা শুনবেন, যে যুদ্ধের এমনতর নীতি বর্জন করার আন্দোলন করে আসছে কোনো ধরনের দৃশ্যমান সফলতা ছাড়াই। যাইহোক, আপনাকে লিখে যদি কোনো ভুল করে থাকি ক্ষমা করবেন।

আপনার বিশ্বস্ত বন্ধু
এম.কে. গান্ধী

হিটলারকে লেখা গান্ধীর চিঠি
অ্যাডলফ হিটলারকে লেখা মহাত্মা গান্ধীর দ্বিতীয় চিঠি। কার্টেসিঃ বায়োগ্রাফি.কম

 

ডিসেম্বর ২৪, ১৯৪০

প্রিয় বন্ধু,

আমি আপনাকে বন্ধু হিসাবে সম্বোধন করছি এটা কোনো আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে নয়। আমি কারো প্রতি শত্রুতা লালন করি না। আমার প্রধান লক্ষ্য হিসেবে জীবনের ৩৩টি বছর ধরে জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে মানবজাতির সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলে সমগ্র মানবজাতিকে একই বন্ধুত্বের তালিকার মধ্যে সংগঠিত করতে চাইছি।

আমি আশা করি, সার্বজনীন বন্ধুত্বের এই মতবাদের অধীনে থাকা মানব জাতির একটি অংশ আপনার কার্যকলাপকে কীভাবে দেখছে তা জানার এবং বোঝার সময় এবং ইচ্ছা আপনার হবে। পিতৃভূমির জন্য আপনার সাহস এবং ত্যাগের বিষয়টিতে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই, আবার আমরা এও বিশ্বাস করতে চাই না যে, আপনিই সেই দৈত্যটি —যেভাবে আপনার বিরুদ্ধপক্ষ আপনাকে বর্ণনা করছে।

কিন্তু আপনার এবং আপনার অনেক বন্ধু ও গুনগ্রাহীদের লেখা এবং ঘোষণাগুলো সন্দেহ করার সকল সুযোগ তৈরি করছে যে, আপনার অনেক কাজ মানবিক মর্যাদা এবং মানবতার জন্য অশুভ এবং দানবীয়, বিশেষ করে আমার মতো যারা বিশ্ব বন্ধুত্বে বিশ্বাস করে তাদের কাছে। যেমন, চেকোস্লাভিয়াকে ঘায়েল করা, পোল্যান্ডকে ধর্ষণ ও ডেনমার্ককে দখল করে নেওয়া। আমি এটা বুঝতে পেরেছি— আপনার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি এই জাতীয় ধ্বংসাত্মক কাজগুলোকে পুণ্যের কাজ হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু আমরা শিশুকাল থেকে এই শিক্ষাই পেয়েছি যে, এই কাজগুলো মানব জাতির জন্য লজ্জ্বাজনক কাজ। সুতরাং আমরা আপনার জন্য সফলতা কামনা করতে পারি না। তবে আমাদের একটি অনন্য অবস্থান আছে— আমরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকেও প্রতিহত করি, যেমন আমরা নাৎসিবাদকে প্রতিহত করি।

এই দুইয়ের মধ্যে যদি কোনো পার্থক্য থাকে, সেটি শুধু মাত্রাগত পার্থক্য। যথেচ্ছভাবে পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদের অধীনে নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা এর বিরোধিতা করি মানে এই নয় যে, আমরা ব্রিটেনেরে জনগণের কোনো ক্ষতি চাই। আমরা যুদ্ধের ময়দানে তাদের পরাজিত করতে চাই না, আমরা তাদের বদলাতে চাই। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের নিরস্ত্র এই বিদ্রোহ— তবে আমরা তাদের বদলাতে পারি বা না পারি, আমরা অহিংসভাবে এবং অসহযোগিতার মধ্য দিয়ে তাদের শাসনকে অসম্ভব করে তুলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এটি যুদ্ধের অপ্রতিরোধ্য একটি পদ্ধতি।

এটা অনস্বীকার্য যে, শোষকরা তাদের চূড়ান্ত রূপে পৌঁছাতে পারে না যদি না আক্রান্তরা তাদের সহযোগিতা করে এবং তাদের প্রতি বাধ্য থাকে। শাসকরা আমাদের ভূমি এবং জীবিকার অবলম্বন দখল করেছে, তবে আমাদের অন্তর দখল করতে পারেনি। প্রতিটি ভারতীয় পুরুষ, মহিলা এবং শিশুকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করেই তবে তারা চূড়ান্ত বিজয় লাভ করতে পারে।

সকল ভারতীয় হয়ত সে বীরত্ব দেখাতে পারবে না, অনেকে হয়ত ভয়ে পিছু হঠবে, তবে সেটি ভিন্ন আলোচনা। এ লড়াইয়ের জন্য সবাইকে প্রয়োজন নেই, কিছু নারী পুরুষও যদি ভারতবর্ষে থাকে যারা কোনো ধরনের দ্বিধা-ভয় ছাড়া নিপীড়িকদের বিরুদ্ধে মরতে প্রস্তুত থাকবে, তবুও তাদের সামনে হাটু ভেঙ্গে পড়ে যাবে না, তবে তারাই নিষ্ঠুর এ অত্যাচার হতে মুক্তির পথ দেখাবে। আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে বলি যে, ভারতে আপনি অপ্রত্যাশিত সংখ্যক এরকম নারী পুরুষ পাবেন। গত বিশ বছর ধরে তারা এই প্রশিক্ষণটাই নিয়ে আসছে।

গত অর্ধ শতাব্দী ধরে আমরা ব্রিটিশ শাসনকে ছুড়ে ফেলার চেষ্টা করে আসছি। স্বাধীনতার আন্দোলন এখনকার মতো এত শক্তিশালী আর কখনো হয়নি। সর্বাধিক শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন— ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কথা বলছি, তারা চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। আমরা অহিংস প্রচেষ্টার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সফলতা অর্জন করেছি। পৃথিবীর বুকে সর্বাধিক সহিংস এবং সংগঠিত ব্রিটিশ পরাশক্তির বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধের সঠিক উপায়ই অবলম্বন করেছি। আপনিও সে শক্তির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন।

এটা দেখার বিষয়— ব্রিটিশ নাকি জার্মান, কারা বেশি সঙ্ঘবদ্ধ। আমরা জানি যে, ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদ আমাদের জন্য এবং পৃথবীর অন্য অইউরোপীয়দের জন্য কী বরাদ্দ করে। তবে আমরা কখনই জার্মান সহায়তা দ্বারা ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে চাই না। আমরা অহিংসবাদের মধ্যে এমন একটি শক্তি খুঁজে পেয়েছি, সংগঠিত হতে পারলে নিঃসন্দেহে তা বিশ্বের সবচেয়ে  হিংস্র শক্তির সংমিশ্রনের বিরুদ্ধে নিজেকে তুলে ধরতে পারবে। যেমনটি আমি বলেছি, অহিংসবাদে পরাজয়ের মতো কোনো বিষয় নেই। কাউকে আঘাত বা হত্যা না করেও এটা মরাবাঁচার লড়াই। অর্থকড়ি এবং ধ্বংসাত্মক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করেও, যেটি বিজয়ের জন্য আপনি করছেন, পরিপূর্ণভাবে এ উপায়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। বিষয়টি আমাকে বিস্মিত করছে— আপনি বুঝতে পারছেন না যে, পৃথিবীটা কারো একার নয়।

ব্রিটিশরা যদি নাও পারে, তাহলে অন্য কেউ আপনার চেয়ে আরো ধ্বংসাত্মক অস্ত্র দিয়ে আপনার দেখানো পথে আপনাকে ঘায়েল করবে। আপনি আপনার জনগণের কাছে এমন কোনো উত্তরাধিকার রেখে যাচ্ছেন না, যা নিয়ে তারা গর্ববোধ করবে। যতই সূক্ষ্ম এবং সুপরিকল্পিত হোক না কেন একটি নিষ্ঠুর ধ্বংসযজ্ঞের কাহিনী বর্ণনা করে তারা গর্ববোধ করতে পারবে না। এ কারণেই আমি আহ্বান করছি এ যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য। আপনি কিছুই হারাবেন না, যদি আপনাদের এবং গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যে বিবাদ সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়কে আপনারা যৌথ নির্বাচনের একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে মীমাংসা করার চেষ্টা করেন। যুদ্ধে জয়ী হলেও এটা প্রমাণিত হবে না যে, আপনি সঠিক ছিলেন। তা শুধু আপনার ধ্বংসযজ্ঞের শক্তিই তুলে ধরবে।

নিরপেক্ষ একটি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এটা বিচার করা সম্ভব যে, আসলে কোন পক্ষ সঠিক। আপনি হয়ত জানেন, আমি ব্রিটিশদের আহ্বান করেছিলাম অহিংস প্রতিরোধ পদ্ধতি গ্রহণ করার জন্য। আমি এটা করেছিলাম, কারণ ব্রিটিশরা আমাকে বন্ধু জানে, যদিও আমি একজন বিপ্লবী। কিন্তু আপনার এবং আপনার দেশের জনগণের কাছে আমি একজন অপরিচিত ব্যক্তি।

ব্রিটেনবাসীর প্রতি যে আহ্বান আমি করেছিলাম সেটি আপনার কাছে করার মতো সাহস আমার নেই। একইভাবে এটি কার্যকরি হবে না। তবে এই মুহূর্তে আমার প্রস্তাবনাটি খুবই সরল, কারণ তা অনেক বেশি পরিচিত এবং প্রয়োগযোগ্য। এমনকি আমরাও আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন স্থগিত করেছি, যখন ইউরোপের মানুষের অন্তর শান্তির জন্য উদগ্রিব হয়ে আছে। এটা আপনাকে বলা খুব কি অতিরঞ্জিত হবে— যদি আপনাকে শান্তির জন্য উদ্যোগ নিতে বলি, যদিও ব্যক্তিগতভাবে হয়ত আপনার এতে কিছু যায় আসে না, কিন্তু লক্ষ লক্ষ ইউরোপীয় নাগরিকের কাছে এ দাবীর যথার্থতা রয়েছে— শান্তির জন্য যাদের অন্তরের বোবা কান্না আমি শুনতে পাচ্ছি, আমার কান দুটি লক্ষ লক্ষ নির্বাক মানুষকে শুনতে পাচ্ছে।

যৌথভাবে মুসোলিনি এবং আপনার কাছে আমি এই আবেদন করতে চেয়েছি, ইংল্যান্ডে একটি গোল টেবিল সম্মেলনে যোগ দিয়ে রোম হয়ে ফেরার পথে তার সাথে আমার দেখা করার সুযোগ হয়েছিল। আমি আশা করি তিনি এই আহ্বানের মর্মাথ অনুধাবন করতে পারবেন।

আপনার বিশ্বস্ত বন্ধু
এম.কে. গান্ধী


ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন দিব্যেন্দু দ্বীপ