টাকা থাকা আর না থাকা, এবং পারিবারিক ঝামেলা, বংশগত একটি জটিল রোগ, এটাই আমার জীবনে পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। পরিকল্পনায় ভুল ছিল খুবই কম। আপনি সবই ঠিক করলেন, কিন্তু আচমকা আগুন লেগে সব পুড়ে গেল, সমুদ্রে ঝড় উঠে জাহাজ ডুবে গেলো। কী করবেন? কিছুই করার নাই। পরিবারে বড় ধরনের বিপদ চলে আসাটাও অনেকটা এরকম। উন্নয়ন খাতের ব্যয় যদি সমস্যা সমাধানে করতে হয়, এবং সেটি যদি একটির পর একটি হতেই থাকে, তাহলে আয় করে লাভ হবে না। লেখালেখি করে অঢেল টাকা তো আয় হবে না। তবে আমি আয় করেছি, কিন্তু ব্যয় করতে হয়েছে সমস্যা সমাধানে, উন্নয়নে নয়। এটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি টেনে ধরেছে। নিজের প্রতি একটু ভালোবাসা নিয়ে বিশ্লেষণ করলে ভুল খুব বেশি দেখি না। যেমন, ২০২১-এ প্রকাশনী যদি পাঁচটা বই করে আমি নিজের টাকায়ও পাঁচটি বই বের করতে চেয়েছিলাম। দশটি বই একবারে বের হলে মার্কেটিং-এ অনেক সুবিধা হত। কিন্তু আচমকা করোনা এসে সব পরিকল্পনা নষ্ট করে দিয়েছে। করোনা এসে মানে, করোনা হয়ে … যে টাকা দিয়ে বই বের করব সেটি চলে গেল চিকিৎসায়। কী করার আছে? সাধারণ রোগশোক পরিবারে হবেই, এটার জন্য প্রস্তুতি রাখা যায়, কিন্তু ঈশপ অটিস্টিক হবে, মানে তিন বছর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার পর অস্বাভাবিক হয়ে যাবে! এ পরিকল্পনা আপনি কীভাবে করবেন? এ জন্যই আমি কর্মের পাশাপাশি সৌভাগ্যে বিশ্বাসী, দুর্ভাগ্যে বিশ্বাসী না। বিপদ আসাটা দুর্ভাগ্য না, ঘটনা। কিন্তু আচমক এরকম বিপদ না আসাটা অবশ্যই সৌভাগ্য। অনেকে সৌভাগ্য মানে লটারি জেতা বা আচমকা কোনো সুযোগ পাওয়াকে মনে করতে পারেন, কিন্তু আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি সৌভাগ্য মানে বুঝি আচমকা সব তছনছ হয়ে না যাওয়া, হঠাৎ কোনো বিপদ এসে হাজির না হওয়া। এতটুকু হলেই আমি খুশি।
আমার অনেকবার মনে হয়েছে যে, সব ছেড়েছুড়ে সন্ন্যাসী হয়ে যাব কিনা। কিন্তু হিসেব করে দেখলাম, সন্ন্যাসী হওয়া বলে তো কিছু নেই। বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়া, এর মাঝখানে থাকে শুধু জীবন সংগ্রাম। বেঁচে থাকতে চাইলে পালাতে চাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, মোকাবেলা করতে হবে। জীবনটা অনেকটা টেস্ট ক্রিকেটের মতো, অনেক সময় জয়লাভের চেয়ে ম্যাচ বাঁচানোটাই বড় লক্ষ্য হয়ে দেখা দিতে পারে। তখন ডিফেন্স করে যেতে হয়। চারপাশে ফিল্ডারা ঘিরে ধরে, প্রচণ্ড গতিতে বল আসতে থাকে… ঠেকিয়ে যেতে হয়। সংকটের সময়টা পার হয়ে যাবে, কারণ টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচের যেমন একটা সময়সীমা আছে, জীবনের সংকটকালীন সময়েরও একটা সময়সীমা আছে বলে বিশ্বাস করি। তবে জীবনের ক্ষেত্রে এটা অজানা, সেই অজানা সময় পর্যন্ত টিকে থাকা এবং টুকটুক করে নিজের কাজটা করে যাওয়াটাই জীবন। কোনো একটা সময় হয়ত মোমেন্টাম আসবে তখন ঝড়ো গতিতে এগিয়ে যেতে হবে। কিছু না কিছু কাজ প্রতিদিনই করতে হবে। লক্ষ্যের পথে প্রতিদিন একটা ইট হলেও গাঁথতে হবে। তাহলে ভবনটা একদিন দাঁড়াবেই, হয়ত দেরি হবে, দিগুণ সময় লাগবে। লাগুক, দেরি কোনো সমস্যা নয়, বরং শেষ হাসি হাসতে পারাটাই আসল কথা।