নারায়ণগঞ্জের মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী গত ৬ মার্চ, ২০১৩ বিকেলে নিখোঁজ হন। ৮ মার্চ সকালে শীতলক্ষ্যা নদীর কাদাবালি থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। দুর্বৃত্তরা নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করে।
বুকে পাথর চেপে এখনো ছেলে হত্যার বিচার চাইতে হচ্ছে ত্বকীর পিতা রফিউর রাব্বিকে। মাঝে মাঝেই তিনি ফেসবুকে ত্বকীর ছবি দিয়ে থাকেন।
আমি ত্বকীর কেউ না, তবু কেন জানি ছবি দেখে বুকের মধ্যে চিনচিন করে ব্যথা করে, মেরে ফেলল ছেলেটাকে ওরা! কেন মেরে ফেলল? কেন জানা যাবে না তা? কেন বিচার হবে না? দেশের ষোলো কোটি মানুষ কেন এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার বাইবে না? অনেক প্রশ্ন…
ত্বকীর লেখা একটি কবিতা
মানুষ চাই সমানে সমান / তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী
সমগ্র মানবজাতি আজ এক কাতারে দাঁড়াবে-
হিংসা বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে,
জলাঞ্জলি দিয়ে হিসেব কষা,
ছড়িয়ে দেবে ভালোবাসার গান-
বলবে মানুষ চাই সমানে সমান।
ত্বকীকে নিয়ে টোকট ঠাকুরের লেখা কবিতা
টোকন ঠাকুরএকদিন জানা হবে নদীদের ভাষা
শীতলক্ষ্যাও কথা বলবে অমাদের সঙ্গে
অমরা বলব, ‘নদী তুমি স্বাধীন, বলো বলো
নদী তোমার জলপ্রবাহিত দৃশ্যের বাইরের কথা বলো বলো,
কে তোমাকে কি দিয়েছে, বলো?
কে তোমার কি নিয়েছে বলো?
কে তোমাকে দখল করেছে, বলো?
অার শীতলক্ষ্যা,
ত্বকীকে তোমার মনে অাছে কীনা, বলো?
ত্বকীকে কারা হত্যা করেছে, বলো?
ত্বকীকে কেন হত্যা করেছে, বলো?
সেদিন একটি দিনকে কেন গুম করা হলো, বলো?
নদী, তোমার ইতিহাস তুমি বলো
‘স্বাধীনতা শব্দটি কী করে অামাদের হলো’,
তা অামরা জানি
‘স্বাধীনতা’ যদি শব্দের বাইরে অাসে কোনোদিন
অপেক্ষায় থাকলাম,
শীতলক্ষ্যা, তুমি ভাষা পাবে, জানব–
এতদিন তোমার বুকে কারা কী ডুবিয়ে দিয়েছিল
কারা কী লুকোতে চেয়েছিল,
বোলো ত্বকীর কথাটি বোলো…
ত্বকীকে নিয়ে লিখেছেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জয়া ফারহানা
জয়া ফারহানা
…………..
না, এটা শরৎ বাবুর কাছে লেখা কোনো খোলা চিঠি নয়। যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গরিবের জন্য নয়, সেখানে শরৎ বাবুর গফুর আর আমিনারা ভালো থাকবে না, সেটাই স্বাভাবিক। গফুর আর আমিনারা যে তিমিরে ছিল, সেখানেই রয়ে গেছে। তাদের ভাগ্যের বদল হয়নি। এক মুঠো ভাতের জন্য এখনো তাদের সেই মানবেতর সংগ্রাম। বরং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো নতুন নতুন সংগ্রাম। প্রতিদিন বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াই। লড়াই অন্যায়-অশুভর বিরুদ্ধে। যে লড়াই চালাতে গেলে বাবাকে হারাতে হয় সন্তান। ত্বকীর মতো সন্তান। আজ লিখছি ত্বকীকে। কারণ ক্ষমা। ত্বকী, আমরা সম্মিলিতভাবে যে সমাজব্যবস্থা তৈরি করেছি, সেখানে তোমার মতো নিষ্কলুষ নবীন কিশোরও নিরাপদ নয়। যে বয়সে তোমাকে আমাদের দেওয়ার কথা ছিল ভুবনডাঙার মেঘ কিংবা ফুসফুস ভরা হাসি অথবা তোমার বয়সী একজন কিশোরের যা যা প্রাপ্য ছিল সবÑ এর কিছুই তোমাকে আমরা দিতে পারিনি। উপরন্তু ফুসফুসে সামান্য বাতাস ভরে যখন তুমি প্রাণপণ বাঁচার চেষ্টা করছ, আমরা তখন তোমাকে শ্বাসরুদ্ধ করে, তোমার প্রাণটুকু কেড়ে নিয়েছি। এ এক নির্মম পাশা খেলা! তোমার অবুঝ, সবুজ, শুদ্ধ চিন্তা যা বুঝতে অক্ষম! কিন্তু আমরা তো অবুঝ, সবুজ নই। আমরা ভয়ংকর। যতটা ভয়ংকর হলে কোনো নিষ্পাপ কিশোরকে করুণ এক অবেলায় চলে যেতে হয়। যে ভয়ংকর স্বার্থের শর্তযুক্ত রাজনীতি তোমাকে ছুড়ে ফেলেছে শীতলক্ষ্যার জলে, সেই রাজনীতিকে এই পঙ্কিলতার মধ্যে নিয়ে এসেছি আমরা সবাই মিলে। তাই তোমার কাছে করজোড়ে ক্ষমা। জানি, আমরা সমবেত সকলে, তোমার কাছে যে অপরাধ করেছি, তার কোনো ক্ষমা নেই। তবু চাইছি ক্ষমা। কারণ না চাওয়াটা আরো বড় অপরাধ।ত্বকী, আমার কোনো ভাই নেই। সংবাদপত্রের পাতায় তোমার নিষ্কলুষ মুখের ছবি দেখে, আমি ভাই হারানোর সমান যন্ত্রণা পেয়েছি। তোমার মায়ের চোখে আমি পৃথিবীর তিন ভাগ জলের সমান কান্না দেখেছি। সেই অসহায় মুখ অবিরত আমার হৃদপিন্ডে কাঁটা ফোটাচ্ছে। হয়তো আমরা সাধারণ বলেই মানুষের দুঃখ, যন্ত্রণা, কান্না আমাদের স্পর্শ করে। কিন্তু যারা নানা কৌশল, কূটনীতি আর ছলনার স্তর পেরিয়ে রাজনৈতিক জীবনের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছেছেন, তোমার এমন করুণ মৃত্যুতেও তাঁদের কিছু যায়-আসে না। মানুষের মৃত্যু তখনই তাঁদের কাছে আবেদন সৃষ্টি করতে পারে যখন সে মৃত্যুটি দেয় একটি লাশ এবং যে লাশটিকে তাঁরা রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। তাই তোমার পরিবারের এমন দুঃসময়েও একজন শীর্ষ নেতাও গেলেন না তোমার বাবাকে সামান্যতম সান্ত¡না দিতে। কবি আবুল হাসান লিখেছেন-
‘দালান উঠছে তাও রাজনীতি, দালান ভাঙছে
তাও রাজনীতি, গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি,
গোলাপ ঝরছে তাও রাজনীতি।’
সন্দেহ নেই, তোমার মৃত্যুও রাজনীতি। কিন্তু এত বীভৎস তার রূপ! এতই বিকট তার হিংস্রতা! এমনই বিবর, এমনই অন্তঃসারশূন্য এই রাজনীতি! রাজনীতিবিদদের বিবেকবোধের সিংহভাগই লুট হয়ে গেছে। তাঁরা আমাদের নিয়ে গেছেন দুঃস্বপ্নের ঘেরাটোপে। রাজনীতি পরিণত হয়েছে এক অনতিক্রম্য অসভ্য দর্শনে।তুমি অনেক বড় কিছু করতে চেয়েছিলে না ত্বকী? অনেক বড় কিছু! তুমি অ…নে…ক বড় কিছুই করেছ। তোমার মৃত্যু দিয়ে তুমি দেখিয়ে গেছ কী উদ্ভট উটের পিঠে চলছে আমাদের দেশটা!নৃশংসতা, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির অনিবার্য অনুষঙ্গ বলেই হয়তো বারবার এই শিল্প শহরটি সংবাদ শিরোনাম হয়ে ওঠে। সন্দেহ নেই, ‘সন্ত্রাস’ অন্তত এখানে শিল্পের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়ে শিল্পনগরীর সম্মান বহাল রেখেছে! যে রাজনীতি আমাদের আগুন থেকে খোলায় আবার খোলা থেকে আগুনে নিক্ষেপ করে, যে রাজনীতির সাংস্কৃতিক চরিত্র কিছুমাত্র বদলায় না, সেই রাজনীতির কথা থাক। আজ বরং তোমাকে নিয়ে আমার কিছু ভাবনার কথা বলিÑ ত্বকী, তোমাকে আমি চিনি না, কখনো দেখিনি। আমাদের মুখোশধারী রাজনীতিবিদরা যেদিন তাদের প্রকৃত রূপ দেখাল, তাদের দ্বিধাহীন অবয়ের দাঁত-নখ যেদিন তোমাকে বিদ্ধ করল, পরদিন সারা দেশের সংবাদপত্রে ছাপা হলো তোমার নিষ্পাপ মুখের ছবি। সেদিনই তোমার সঙ্গে আমার পরিচয়। পরীক্ষায় প্রাপ্ত সাফল্যের জন্য যখন তোমার প্রাপ্য ছিল প্রশংসার হীরকচুম্বন, তখন তুমি পেয়েছ মৃত্যুহীরক বিষ! ত্বকী, তুমি এখন বাংলাদেশের সব বোনের ভাই। তোমার মা এখন সব ত্বকীর মা। তোমাকে অপু আর নিজেকে দুর্গা ভেবে তারপর কতবার আমি চলে গেছি সন্ধ্যার ত্রয়োদশী অন্ধকারে পুকুর ধারের নির্জন বাঁশবনে। কিংবা বনকলমির ফুলে ছাওয়া নদীর নির্জনতায়, ছাতিম গাছের ছায়ায় বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরেছি। আমি জানি না দুঃখের কী মাতৃভাষা, জানি না বেদনার কী মাতৃভাষা। কিন্তু এটুকু জানি, তোমার ব্যবহৃত ওই চিহ্নগুলো তোমার পরিবারের কাছে জানিয়ে দিচ্ছে, যন্ত্রণা আর রক্তের মাতৃভাষার নাম ‘ত্বকী’। তোমার বাবার কান্নায় আমি দেখেছি কষ্টের চেয়ে বেশি কিছু। তিনি তাঁর দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখবেন না। তিনি বলেছেন, ‘ত্বকীর বয়সের যারা নারায়ণগঞ্জে আছে, সবাই আমার সন্তান। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব, তাদের খুনি, জল্লাদের হাত থেকে রক্ষার দায়িত্ব ত্বকী আমার কাঁধে তুলে দিয়ে গেছে। আমি সে দায়িত্ব অবশ্যই পালন করব।’ নির্মলেন্দু গুণের মতো জানতে ইচ্ছা করে-
‘কবরে কী করে পড়ো? মাটি কি কাগজ, খাতা?
তোমাকে মৃতের পাশে রেখে, ফিরে আসে তোমার কবর।
আমাদের প্রত্যহের প্রবাহিত পাপে
স্মৃতি তাপে জ্বলছিল প্রাণ
এই চোখ মৃত্যু দেখে কোনদিন কাঁদেনি
শুধু প্রাণ কেঁদেছিল একবার
সন্তানহারা জননীর ম্লান মুখ দেখে
শুধু অন্তর্যামী হয়ে একবার ঝিঁঝির কল্লোলে মিশে
বলেছিলে ‘মা’
সেই থেকে মার উপমা তুমি’
(আবুল হাসানের কবর থেকে ফিরে : নির্মলেন্দু গুণ)
ত্বকী, তুমি শান্তিতে ঘুমাও। আমরা জেগে আছি।
লেখক :পরিচালক, কিংবদন্তী মিডিয়া
ত্বকীর জন্য আন্দোলন করে চলেছে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, তার কিছু নমুনা দেওয়া হল।
আন্দোলন প্রয়োজন হওয়ার কথা না, তবু বিবেকবান মানুষ আন্দেোলন করেছে বিচার না হওয়ায়, এখনো বিচার সম্পন্ন হয়নি। ত্বকীকে নিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়-
কৈফিয়ত নিতে উঠে আয়
সত্যিকারের ঈশ্বর হয়ে,
আমরা বিশ্বাসী হব।
বিদ্রঃ ছবিগুলো ত্বকীর পিতা রফিউর রাব্বীর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।