অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি এবং এসএসসিতে জিপিএ ৫ (গোল্ডেন এ প্লাস) পেয়ে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন অমৃত লাল দে কলেজে। সেখান থেকে উচ্চমাধ্যমিকে এ প্লাস পেয়ে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। মেডিকেলের পড়াশুনা শেষ করে ৩৪ তম বিসিএস এর স্বাস্থ্য ক্যাডারে সহকারি সার্জন পদে নিয়োগ পান।
প্রগতিশীল পরিবারে জন্ম নেয়া মনীষা চক্রবর্ত্তীর পিতামহ বিশিষ্ট আইনজীবী সুধীর কুমার চক্রবর্ত্তীকে মুক্তযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় রাজাকার বাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাঁর বাবা বিশিষ্ট আইনজীবী সর্বজন পরিচিত অ্যাড. তপন কুমার চক্রবর্ত্তী মুক্তিযুদ্ধে ৯ নং সেক্টরে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। অসংখ্য প্রগতিশীল মানুষদের সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা ডাঃ মনীষার ছোটবেলা অতিবাহিত হয় ফুপা বিশিষ্ট প্রকৃতি বিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মার সংস্পর্শে।
সবকিছু ছাপিয়ে যে পরিচয় ডা. মনীষাকে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে দিয়েছে তা হলো সামাজিক দায়বদ্ধতা, মানবিকতা, দেশপ্রেম। একজন মানুষের সামাজিক দায়বদ্ধতা কতো বড় হলে মেডিকেল থেকে পাশ করার পর সরকারি সবচেয়ে বড় চাকুরি বিসিএস এ উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগ পাওয়ার পরও সেটা ত্যাগ করে, নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিরাপত্তা তুচ্ছজ্ঞান করে, শ্রমজীবী-সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে, মুক্তির লক্ষ্যে নিজেকে সপে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের কাতারে।
মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়ই শিক্ষা-স্বাস্থ্যের অধিকার রক্ষা, শোষণ-লুটপাট থেকে দেশ এবং মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে যুক্ত হন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের রাজনীতির সাথে। এরপর মেডিকেল ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী নিপীড়নের ঘটনা, গভীর রাতে ছাত্রী হলে সন্ত্রাসীদের প্রতিবাদে দূর্বার আন্দোলন, মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে আন্দোলন, জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে অনিয়ম বন্ধ করে মেডিকেলে সর্বসাধারণের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ তেল-গ্যাস বিদেশীদের হাতে তুলে না দিয়ে দেশের প্রয়োজনে উত্তোলন ও ব্যবহারের জাতীয় কমিটির আন্দোলন, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচি, সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন, তনু হত্যার প্রতিবাদে বরিশালে ছাত্র ধর্মঘটসহ ধারাবাহিক আন্দোলন, সারাদেশে সন্ত্রাস-দফলদারিত্বনারী নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন, পুকুর-খাল-নদী রক্ষার আন্দোলন, মাদক-জুয়া-অশ্লিলতা-অপসংস্কৃতি বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বকারী ভ’মিকা পালন করেন তিনি। বরিশালে হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলন, ভোলার গ্যাস বরিশালে এনে গ্যাসভিত্তিক শিল্প কারখানা নির্মাণ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির আন্দোলন, দোকান কর্মচারী-হোটেল শ্রমিক-নির্মাণ শ্রমিক-নৌযান শ্রমিক-রিক্সা শ্রমিকদের ধারাবাহিক আন্দোলন, খাসজমি ভ’মিহীনদের মধ্যে বিতরনের আন্দোলন, রসুলপর চরে বস্তিু উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সফল আন্দোলন, রসুলপুরে সুলভে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানের আন্দোলন, পলাশপুর-স্টেডিয়াম-রসুলপুর বস্তিতে নাগরিক সুবিধার আন্দোলন, বস্তিবাসী সন্তানদের বিনা বেতনে পড়াশুনার সুযোগ প্রদানের দাবিতে আন্দোলন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমি জোরপূর্বক দখলের বিরুদ্ধে আন্দোলন ইত্যাদি।
এছাড়াও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিজ্ঞানমনষ্কতা, দেশপ্রেম, সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরির লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবে বিজ্ঞান কর্মশালা, টেলিস্কোপে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ, শহীদ মিনার নির্মাণ প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞানী-সাহিত্যিকসহ বড় মানুষদের বিভিন্ন দিবসে কুইজ-রচনা প্রতিযোগিতা-আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। রসুলপুর ও স্টেডিয়াম কলোনীতে বিনা বেতনে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানো হয়। রসুলপুর চরে শহীদ আলতাফ মাহমুদ স্মৃতি পাঠাগার পরিচালনা করা হয়। স্থানীয় আন্দোলনের পাশাপাশি মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে ঢাকায় কেন্দ্রীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি। এছাড়াও ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক সম্পাদক হিসেবে রাশিয়ার সোচিতে ১৫৪টি দেশের ছাত্র-যুবকদের অংশগ্রহণে আন্তর্জাতিক ছাত্র-যুব সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের শিক্ষাস্বাস্থ্যে ব্যবস্থার চিত্র এবং করণীয় তুলে ধরেন। মেডিকেল থেকে পাশ করে ৩৪তম বিসিএসের সরকারি চাকুরী ছাড়লেও ডা. মনীষা ছাড়েননি চিকিৎসা পেশা। তাই প্রখর রোদে শ্রমজীবী বা নগরবাসীর অধিকার আদায়ের মিছিলের পর বিশ্রামের পরিবর্তে তাকে দেয়া যায় হাসিমুখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিনামূল্যে মানুষের চিকিৎসা করতে। কখনও রসুলপুর বস্তিতে, কখনও পলাশপুরে, কখনও স্টেডিয়াম কলোনী বস্তিতে, কখনওবা বিসিক বা কাশীপুরে শ্রমিক এলাকায়। পার্টি অফিসে গুরুত্বপূর্ণ কোন মিটিং শেষেও কিছু রোগী দেখার পরই উঠতে হয় তাকে। কখনও কাজের ফাকে কোন অসহায় মানুষের চিকিৎসার খোজ নিতে রাত-বিরাতে ছুটে যেতে হয় শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে। এভাবে গণমানুষের অধিকার আদায়ে এবং অসহায় মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন ডা. মনীষা চক্রবর্ত্তী।