কাব্যগ্রন্থঃ যাব কি যাব না ভেবে ভেবে আমি দাঁড়িয়েই থাকি
প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ২০২২
প্রকাশকঃ পৃথ্বিশ প্রত্যয়
প্রকাশনীঃ পাঠক সমাবেশ
উৎসর্গঃ
হিম হিম ভোরে, উঠোন জুড়ে
করতল পেতে রাখি
এক চিলতে রোদের আশায়—
১
কোনোদিনও বলনি ভালোবাসো,
তোমাদের সত্য কথনে তাই বড় স্বস্তিতে থাকি
ভারহীন হয়ে—
ভালোবাসা পিছুটান আনে—
যে-কোনো নক্ষত্রের রাতেই
তাই চলে যেতে পারি
অন্ধকারের ওপারে
একলা পারানি বেয়ে
পিছুটানহীন—
২
দেখা হলে তুমি বিদায়ের কথা বল খুব বেশি,
অনেকটাই শীতের ঋতু জুড়ে সারাদিন টুপটাপ
ত্রস্তে খসে পড়া পাতার মতোই যেন স্বাভাবিক গল্প।
অস্ট্রেলিয়ার পি আর, আমেরিকার স্কলারশিপ,
আরিজোনায় আলাপ হওয়া রঙিন প্রজাপতি—
আসন্ন নিবিড় বসন্তের স্বপ্নে
বিভোর থাকে তোমার দুচোখের পাতা—
দেখা হলেই তুমি উঠবার তাগিদ দিতে থাকো,
বিবর্ণ পাতাহীন বৃক্ষের বাকলে বাকলে
কামারের হাতুড় নাচে রাশান ব্যালের ভঙ্গিতে—
গাড়ির জ্বালানি, কোনো বন্ধুর আসবার কথা
ডাক্তারের অ্যাপয়ন্টমেন্ট, অসংখ্য অজুহাতে
চায়ের কাপে শেষ চুমুকের আগেই
তুমি দেখ ঘড়ির কাঁটার চলা।
আমার তাড়াহীন সময় কেবলই ছুঁয়ে যায়
দেয়ালের ওয়েল পেইন্টিং
শেষ বিকেলের সোনালি ধানের ক্ষেত,
আলের শুকনো ডালে
ডানায় ভর দিয়ে এখনো বসে আছে এক একলা শালিক।
৩
৪
৫
৬
৭
অন্ধকারে পুড়েছে ঘুমের রাত
সপ্তর্ষির আলো নিভে গেছে সেই কবে
নীল ক্যানভাসে তারাদের ছবি এঁকে
ঘরে ফিরে গেছে ভ্যানগগ।
আমি এক প্রতারিত নগরীকে চিনি
যার প্রতিটা প্রহর কাটে গ্লানির অন্ধকারে
এক প্রতারিত সমুদ্রকে চিনি
প্রতিটা ভাটির টানে যে
মুখ লুকিয়ে পালিয়ে যায়
মানুষেরা বুক ভরা প্রেম
জমা রাখে দেবতা পূজায়
ভাঙ্গা কুলো ছুড়ে ফেলে
আঙিনার ছাই— এর গাদায়।
প্রেমহীন ছায়াদের শরীরের ঘ্রাণ
কোনোদিন মিলেছে কি বেলীর সুবাসে?
আমি একজন ব্যর্থ মানুষকে চিনি
ক্রমাগত হেরে যেতে যেতে
যে একদিন মিশে যেতে চেয়েছে
রেললাইনের পাশে নরম ঘাসের বিছানায়।।
৮
আমার কাঁচের জানালায়
প্রতিদিন ছায়া ফেলে এক বিষন্ন বকুল
আমি মাঝে মাঝে তার
চিবুকে আঙুল রাখি—
ক্ষয়ে যাওয়া রোদের কিনারে দাঁড়িয়ে
কোমল মায়ায়
সে আমাকে শোনায় প্রতিদিন
‘তুমি নুয়ে গেলে আমি নুয়ে যাই—
তুমি আলো নিভিয়ে দিলে
আমিও মিশে যাই ঘন অন্ধকারে।’
আমি প্রাণপনে আলো জ্বেলে রাখি
পিলসুজে তেল, মোমের সলতে ফুরিয়ে গেলে
আমি মেলে দিই করতল
নিজেই জ্বলবে বলে।
৯
বুক ভরে হাওয়া নেব বলে এসেছি
পাহাড়ের ঢালে
কোথাও সমুদ্র নেই কাছাকাছি,
অথচ কাল আমায়
সারারাত কাঁদিয়েছে ভূমধ্যসাগর
গভীর অন্ধকারের বুক চেরা
ভেজা ঠাণ্ডা বাতাসের রিনরিনে কান্না
টিমটিমে রঙিন আলোয় সি-ফুডের দোকান থেকে
ভেসে আসা মৃদু ম্যানহাটান।
স্ট্রিট শপে কয়লার আঁচে পোড়ানো ভুট্টার ঘ্রাণ,
জোয়ারের চাপা গর্জন,
রাস্তায় আয়েশি জনতার
মিঠে কোলাহল।
কতটা পথ একসাথে হেঁটে এলে
দুজনার রাস্তা আলাদা হয়ে যায়?
ঠিক কতটা সময় পেরোলে আবার
মৃত্যু উপত্যকার দুধারে
গড়ে ওঠে প্রাণের আভাস?
অরেঞ্জ রিভার থেকে মইনি নদী,
আমাদেরই মতো
অঢেল দূরত্ব নিয়ে বয়ে যায় একা।
কিনারে দাঁড়িয়ে
সময়ের ঢেউ গুনে গুনে
ক্লান্ত সন্ধ্যায় ফিরে যাই হোটেলের নির্জন ঘরে।
কোথাও সমুদ্র নেই,
ভারী পর্দা ফেলা রুমে পুরু কম্বলের ওম,
তবু সমুদ্রের ঠাণ্ডা হাওয়া
সারারাত ভেজায় কেবল
নস্টালজিয়া সময়ের মতো।
১০
একা একা পালিয়েছি বহুবার
ঘর থেকে, বাড়ি থেকে,
মন থেকে, প্রাসাদের কোণ থেকে
কত কতবার!
এইবার চলো একসাথে পালাই দুজনে
পরিত্যক্ত ট্রেঞ্চে বাসা বেঁধে
সারারাত আকাশের তারাদের গল্প শুনে শুনে
পৃথিবীর কোলাহল থেকে দূরে সরে
চলো বিলীন হই কোনো এক ঘন নক্ষত্রের রাতে।
হেঁটে হেঁটে পৃথিবীর প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াই দুজনে
নেমে গেছে নিচে অনন্ত শৈলধারা
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে স্নান করে রূপসী নদীরা
গা এলায় রুপার চৌকিতে
চল সমুদ্রে ভেসে যাই গাংচিলের
ডানার ছায়া ধরে
ঢেউ-এর ফনায় দাঁড়িয়ে দুজন
জোনাকির মতো জ্বালি আঁধারে দেউল
তারপর লুকিয়ে যাই পাতাল প্রাসাদে।
১১
সে ছিল, এখন নেই—
রেস্তোরাঁর কাচঘেরা ঘরে কাঁচ পাত্রে
ফালুদার বর্ণিল কারুকাজের মতো
সেও মিলিয়ে গেছে সময়ের আবর্তে,
তাকে আর যায়নি পাওয়া কোনোদিন,
সমুদ্রের নোনা হাওয়ার অন্ধকারে
অথবা কোনো চাঁদের রাতে,
মোহনীয় টিউলিপ বনে।
এখনো এখানে বসে থাকি
কখনো একা,
কখনো একসাথে!
রূপসার তীর ঘেঁষে
ভেজা বাতাসের গায়ে ভাসে
এলোমেলো গাংচিল—
এলোমেলো স্বপ্নের মতো, গন্তব্যহীন,
শুষ্ক সময়ের হিসাব রাখে না
কোনো যাযাবর বেদুঈন।
ভালোবাসা আর কিছু নয়
কল্পনার ক্যানভাসে নিজেরই আঁকা
এক নীল প্রজাপতি—
উড়ে বেড়ায় দিগন্ত রেখা ধরে,
ছুতে গেলে প্রান্তরেখা
কেবলই সরে যায় দূরে,
তারই স্মৃতির মত!
১২
এভাবেই থাকবো দাঁড়িয়ে
আরো কিছুকাল
তারপর নিশ্চিত একদিন
ডাক দেবে কেউ
নিয়ে যাবে সাথে করে
অচেনা সাগর কিনার ধরে
বড় মাছুয়ার নীল নদী আর সবুজ ডাঙ্গার দোলাচল ভুলে
সেই দিন ঠিক চলে যাব
তার হাত ধরে
চুরি করে দুপুরের ডাহুকের গান
শোনার আশায়
মিশে যাব ঘাসের শিকড়ে।
১৩
যখনই চেয়েছ যেতে গিয়েছ চলে
হৃদয়ের সবটুকু নিয়ে
স্মৃতির মোহরগুলো কোনোদিন
ওড়ে কি কাগজের ঘুড়ি হয়ে
বেদনার আকাশে?
১৪
কোথাও কেউ নেই—
সমুদ্র পার হয়ে এলে
অবেলার মাঠে কারো
থাকবারও কথা থাকে না—
মায়াবতী ইচ্ছেরা
নীলের ক্যানভাসে লেখে
আজগুবি কল্পনার গল্প—
বিমর্ষ বিকেল
অবিরাম কড়া নাড়ে
প্রাসাদের ভুল দরজায়
১৫
প্রেম আর বিরহ নিয়েই জীবন।
আমাদের কবিতায়
হারানো প্রেমের কথা আসে,
বহু আয়োজন শেষে কাঙ্ক্ষিত মিলনের গল্প আসে,
আসে অভিমান, অভিমান শেষে প্রগাড় আদরে
ভেঙে যাওয়া সাজানো বাধার অর্গল
কবিতার নস্টালজিক বাতাসে দোলে
প্রেমিকার সোনাঝুরি শাড়ির আঁচল
ঠোঁটের নিচের তিল,
হাসির মূর্ছনা, বেলী শুভ্র শঙ্খের নাচ।
অথবা হঠাৎ চোখ আটকানো প্রজাপতি,
কাঁটাতারের ওইপারে দূরের কাঁঠালীচাপাও
সাজাতে পারে কাব্যের ছন্দ।
মাছারাঙা ঠোঁটে করে তুলে নেয় ক্ষুদ্র মাছের প্রাণ
তার জীবনের প্রয়োজনে
অন্ধকারের অস্ফুট গোংগানী মিলিয়ে
যায় গুমোট বাতাসে
প্রেমিকের আলোর কবিতায় কোনোদিন আনে কি তা ছন্দ অনুরণন।
১৬
নিজ ঘরে পরবাসী হয়ে দেখি
নানা রঙা পরিযায়ী পাখি
এসে বসে খোলা জানালায়—
উঠোনের গোলার ধান খুঁটে খুঁটে খায়,
শুষ্কচঞ্চু ছোঁয়ায় আমারই স্ফটিক পেয়ালায়,
আমি শুধু দেখি—
দূরের ভদ্রা নদী
চুরি করে পালিয়ে গেল
আমার পারানি নৌকাখানি।
১৭
এখন তুমি ভালোই আছ—
চলে যেতে পারি তাই অনায়েসে,
দ্বিধাহীনভাবে।
বাগানে অনেক পাখি
ডাকতে শিখে গেছে নতুন ছানাগুলো
ঘাটলার শ্যাওলা সরালে
ছবি ভাসে নতুন আয়নায়।
আমাদের যেই দিন ছিল,
সেই সব ক্ষণ মিশে গেছে
বিমূঢ় নিবিড় নক্ষত্রের রাতে।
কোনো বিশেষ চাঁদের রাতে কামিনীর ঝাড়
দেয় কি আলাদা কোনো ঘ্রাণ?
১৮
প্রেম এক মাছরাঙা পাখি
আমারই আকাশে আঁকা
কল্পনার জলরঙে—
অমরাবতী পথ থেকে তুলে আনা
সোনালি পাথরে সাজানো রেখা ধরেে
উড়ে যায় কোনো কোনো একলা বিকেলে
নস্টালজিক সময়ের সাথে
অধরা স্বপ্নের গল্প মিলে
যেন এক মাতাল মদিরা পাত্র।
১৯
বহুদূর থেকে ভেসে আসে
শ্রাবণের বিষন্ন অন্ধকারের সুর
আমি ভিজতে থাকি,
আমি ভিজে যাই, একা একা
ছাদের বৃষ্টিতে,
চিল ঝড়ে উড়ে গেছে
কার্নিশের ঝুল।
মেঘ থেকে জল পড়ে
জল পড়ে ছাদ ফুঁড়ে
জানালার গ্রিল বেয়ে
কাঁচের ওপাশে জমা হয়
ছোট ছোট জলের গল্পরা—
ছোট থেকে ছোট হয়ে আসে
ঘর দেয়ালের ঘের—
ঘর ভাসে, মেঝে ভাসে
ভেসে যায় সিন্দুকে তুলে রাখা
স্বপ্নের সঞ্চয়—
ক্বচিত আলো রেখা আসে
আবার নিমেষে মিলায় গোলক ধাঁধার ফাঁদে—
আমি কেবলই ভিজি, কেবলই ভিজতে থাকি
একলা দাঁড়িয়ে, ছেঁড়া পথের রেখায়।
২০
একবার বেরিয়ে এলে
কেউ আর ফেরে না কোনোদিন
আসলে পারে না,
পেছনের পথে মুহূর্তে উঠে যায় কাঁচের দেয়াল
ঘুণপোকাগুলো পথের দুধারে
সার বেঁধে হেঁটে যায়
ঘরে ফেরা শ্রমিকের মতো।
কবিতার আনাচেকানাচে
শব্দ খুঁজে খুঁজে
ক্লান্ত হয়ে গেলে বসে থাকি
মঞ্চের সামনের শূন্য চেয়ারে—
দেখি আমজনতার মোড়ক উন্মোচন।
উপন্যাসের অলিগলি ঘুরে
হাজার বছর পর আচমকা এসে
সামনে দাঁড়ায়
এলোমেলো প্রেমিকের মতো
বিস্মৃত অশ্বথ ঝোঁপ—
মানতের রঙিন সুতোরা
বাহারি বটের মতো ঝুলে আছে
তার হাতে, পায়ে,
চুলের ডগায় রঙিন ঘুড়ির মতো।
লাটাই-এর সুতো মিনতি করে,
অবেলার মেঘলা আকাশ থেকে
টেনে নিতে হাতের মুঠোয়
পুরান প্রেমের অধিকার।
জীর্ণ ডালপালা, পুরানো পাতার রং
ঝেড়ে ফেলে ফিরে আসি—
ঘরের ভেতরে ঘর, তারও ভেতরে ঘর
তার জানালায় দাঁড়িয়ে বলেছি—
বনের অন্ধকার
আমরা তো তোমার জন্যই
অপেক্ষা করেছি এতকাল।
২১
মাত্র কয়েক মুহূর্তেই
তোমাকে পেরিয়ে এলাম—
ট্রেনের না থামা জংশন পেরোনোর মতন!
অথচ এরই জন্য কত না দীর্ঘ আয়োজন—
কত অসংখ্য বিনিদ্র রাতের প্রস্তুতি।
রাজেন্দ্রানী, যদিও তোমার চোখে
পলক পড়েনি
তবু আমি জানি
এই তুচ্ছ পেরিয়ে যাওয়ার বেদনা
তোমাকে ছোঁবে না কোনোদিন।
২২
শেষ কাপ চা
বরাবরই অনিন্দ্য সুন্দর!
টেবিলের পরে চায়ের পেয়ালা রেখে
চলে গেছে ভয়ার্ত দোকানি
বিরাট তটের শেষ খদ্দের ফেলে—
সমুদ্রের বাড়ন্ত সংকেত
জমে গেছে জল আর বাতাসের খেলা
জলাভূমি ছেড়ে আসা
ঢেউ— এর ছোবল বিপন্ন, ছেঁড়া বালুর চড়ায়!
এক হাতে ঠেলেছি মাতাল মৃত্যু
অন্য হাতে শেষ কাপ চা—
আকাঙ্ক্ষিত তৃপ্তির সেই
শেষের চুমুক!
২৩
তোমাকে ভালোবাসিনি কোনোদিন,
বস্তুত কাউকেই বাসিনি কখনো।
গভীর শূন্যতা নিয়ে সমুদ্রের বুক চিরে চিরে
আমার একলা জাহাজ যখন ভেতে যেত
ডলফিনের মতো,
তিমির গান আর
রাতের নক্ষত্রের প্রেম দেখে দেখে
মাস্তুলে ঝুলে থাকা বাতি
নিয়ে যেত এক স্মৃতিময় প্রসন্ন মন্দিরে—
তাই অচেনা বন্দরে ভিড়লেই
কোনো ডাক বাক্সে
ছেড়ে দিতাম একটা চিঠি তোমার নামে—
লিখবার জন্যও কোনো একটা ঠিকানাতো চাই,
হোক না অচেনা কারো!
২৪
‘কতবার তোর কাঁচা আলোয় ভিজে
গান শোনাই—
আমার মতে তোর মতন কেউ নেই’
অথবা ছিল না কোনোদিন—
আলো পড়ে আসা বিকেলে
দিগন্ত অনুভবের দিনে—
ট্রেন থেকে নামবার পর,
‘ঘুম’ নামের স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল কি কেউ,
উলবোনা দিনে,
সাদা অরকানন্দা নিয়ে?
বালিহাঁস ওড়া গানে,
ব্যাকইয়ার্ড-এর পেঁচানো রাস্তায়,
চেরী তোলা ঝুড়ি ফেলে,
ঘন মেঘের আড়ালে মিশে,
অথবা কাঞ্চনজঙ্ঘার কারুকাজে
হারিয়ে যেতে যেতে পিছলে যাওয়া হাত—
ফিরিয়ে দেব কি,
শেষ অবধি কেউ তো এলোই না কোনোদিন!
২৫
খেয়ালী কবির সময়ের তাড়া নেই জানি
বালির বিছানায় বসে ঢেউ-এর জলসা
পূর্ণিমা রাতে
বেশি তাড়াহুড়া হলে শব্দেরা ফিরে যায়
বেশি তড়িঘড়ি হলে সুরগুলো ছোঁয় না
ঠিকানা প্রখর মমতায়—
আমি ঘোর সংসারী
হিসেবের খাতা থেকে প্রতিদিন ফুরোয় সময়,
তাই তাড়াহুড়ো করি—
অত তাড়াহুড়ো হলে ভালোবাসা হয়?
২৬
এ-শহরটা এখন খাঁ খাঁ করে
যেন বহুদিন এখানে বৃষ্টি হয়নি,
গাছের হলদে পাতায় ধুলোর কারুকাজে
পাল্টিয়েছে হরপ্পা দিনের স্মৃতি।
এ শহরের আনাচেকানাচে
খটখটে রোদ জমে জমে
বাড়িয়েছে বয়সের বলিরেখা—
অথচ মাত্র কদিন!
এ শহরের চেনা এভিনিউ ধরে হেঁটে গেলে
একদিন মিলতো সুগন্ধি আতরের হাট
বসরায়ী গোলাপের বাহারি বাজার—
পার হয়ে গেছে কি বহুকাল?
এ শহরে আজ যদি আমি বিলোই সারাদিন
এলোমেলো ভালোবাসা
যা কেবল চেয়েছিলো কেউ?
দোর খোলো, দোর খোলো বলে
যদি হানা দিই দরজায় দরজায়?
দোলের বাহারী রং ছুড়ে ছুড়ে
আজ যদি ভর দিই
সমস্ত শহরের বিমর্শ আকাশ?
২৭
মৃত্যুর আগের কয়েকটা দিন
আমি একা থাকতে চাই
একদম একা
কেবিনের জানালা খুলে
পাখিদের গুনগুন
ঝরাপাতার শব্দ,
ভেজা কাচে বর্ষার নাচ,
ভেজা করবী
পেয়ারা পাতায় হঠাৎ
হলদে রোদের হাসি
এই সব থেমে যাবে জানি
ঘাসের নিচের ঘরে
জমে গেছে কুয়াশা অনেক
আধেক বিষন্ন ব্যথা ছোটাছুটি করে
একা কোনো কাঠবেড়ালির মতো
ছেড়ে যাবার আগে কিছুটা সময়
একলা কাটাতে চাই
কোলাহলহীন গভীর রাতে
বিরান বিলের ধারে একলা গাছের মতো
এই জনপদে রয়েছি দাঁড়িয়ে বহুকাল
তবু তার কতটুকু চিনি
মুছে গেছে ডাঙ্গার সবুজ আর
কচুরিপানার বিভাজন
বোঝা দায় সবুজের নিচে
জল নাকি মাটি।
ঘোলা স্রোতে চোখ রেখে রেখে
ক্লান্ত হয়েছি
এখনো বুঝিনি কতটা গভীর
ঘাঘর নদীর তল।
এ আকাশ শরতেও নীল
আষাঢ়েও নীল
মেঘ বালিকার আঁচলের নিচে
এ আকাশে খেলে চোরাবালি মন
শতাব্দীর মৃত্যুর পর আসে নতুন শতক
কত শত ঢেউ এসে ভেঙে যায়
সময়ের পায়ে
মাথা তোলে নতুন আবর্তনে—
আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি
আনমনে, পাল্টানো দিনে।
২৮
টানেলটা বড় দীর্ঘ—
আলোরা মাঝেমধ্যে ভুল করে
ঢুকে পড়ে ঠিকই,
কিন্তু পেরোতে পেরোতে ক্লান্ত হয়ে যায়
অতঃপর ক্ষীণ ক্ষীণ হতে হতে
কালো রঙে মিশে যায় মাঝপথে এসে।
বরাবরই একলা চেয়ারে বসি—
কফিশপ, সিনেমা, কবিতার আড্ডা—
মুখোমুখি অথবা পাশের চেয়ারে
মহাজাগতিক স্বপ্নেরা বসে থাকে।
লোকে বলে পালটে ফেলাই বেঁচে থাকা
আজকাল তাই জোছনারা
বিদায় নিলেও রাতগুলো আলো করে রাখি।
২৯
কী পেয়েছো, কী দিয়েছো,
এই হিসেবে নাই আর গেলে—
এক ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে
আমাদের নিত্য বসবাস—
সঞ্চয় থেকে বিলোতে বিলোতে তাই
পার হয়ে আসি বিরান সমুদ্দুর।
মাঝে মাঝে মনে হয়, যে জীবন মানুষের নয়
তার কিসে এত ব্যথা, কিসে এত অভিমান?
কেন তার মন কষাকষি প্রাণহীন বাতিদের সাথে—
দীর্ঘ আঁধারে মানুষইতো খুঁজে পায়
আঁধারের আলো—
নিঃশব্দ বৃষ্টিতে ভিজে যায়
রেলের পাটিতে পড়ে থাকা নুড়ি,
জানি আমি আমাকে দেবার মতো
আসলে তোমাদের কারো কিছু নেই।
৩০
কতবার ইচ্ছে করেছে
ভালোবেসে নিঃস্ব হয়ে যাই—
তোমাদের ভালোবেসে বানজারান-এর বেশে
ঘুরে আসি পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ জুড়ে।
এক মেঘলা মন্দিরে আমার বসবাস
সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে সমতল থেকে
উঠে আসে ভক্তের ভিড়
ধূপের গন্ধে ফুলের পাপড়িতে
ঢেকে যায় আমার পদ্ম আসন।
কতবার ইচ্ছে করেছে আমার পায়ে ছুঁয়ে থাকা
তোমাদের রেশম আঙুলে জ্বেলে দিই
তরল স্পর্শের মোম
আশীর্বাদের মিথ্যে খোলস ছুড়ে ফেলে
কপালে রাখি উষ্ণ করতল।
স্বর্গচ্যুতের অভিশাপ নিয়ে
না মানুষ, না স্বর্গবাসী—
মাটির আসনে মাটির দেবতা হয়ে
পৃথিবীতে রয়ে যাব আরো কতকাল!
৩১
দূরের দ্বীপে দাঁড়িয়ে থাকা একলা মানুষ আমি—
আমাকে কেউ খোঁজেনি কোনোদিন,
চলতি পথে কারো সাথে ক্বচিতে দেখা হলেও
ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করেনি কেউ কোনোদিন!
মাটিতে পায়ের চিহ্ন দেখে দেখে
বরং আমিই গিয়েছি ছুটে, চিত্রল হরিণের খোঁজে,
যতক্ষণ নামেনি আধার।
আমাদের দূরত্ব বিস্তর—
সে দূরত্ব বেড়ে যায় প্রতি জোয়ারের বেলায়,
ভাটির সমুদ্রে, অমাবস্যার রাত্রিতে,
ঘন চাঁদের আলোয়, আনন্দের স্বপ্নে,
বিষন্নতার বেড়াজালে।
দিগন্তের নীল রেখায় স্পর্শসীমার বাইরে
দাঁড়িয়ে থাকি দুইজন
নস্টালজিক কবিতাকে ভালোবেসে!
৩২
নস্টালজিক সময়ের ছবি
ছায়া হয়ে সাথে সাথে ঘোরে
বাসে, ট্রামে, মেট্টোর পেটে
খোলা মাঠে, স্টেডিয়ামে,
যেখানে আলো পায় সেখানেই
দীর্ঘ কালো রেখা এঁকে
হয় পথ আগলায়,
নয় পিছু পিছু হাটে।
আমি বসি, সেও জিরিয়ে নেয়,
আমি উঠি, সেও আড়মোড় ভাঙে,
আমি হাঁটি, সেও শুরু করে পথচলা
অবিরাম, অবিশ্রান্ত, নিরলস,
নিন্দুক প্রতিবেশীর মতো
সাথে লেগে থাকে জিয়লের আঠা।
সময়ের অতল থেকে
গভীর ঢেউয়ের মতো
উঠে আসে অন্য সময়
অগ্নুৎপাতের মতো—
দূরে সরে যাওয়া নক্ষত্রেরা
কড়া নেড়ে নেড়ে যায়
বহুদিনের বন্ধ দরজায়।
যতবার আলো আসে,
ততবার ফিরে আসে সেই দীর্ঘ ছায়া—
আজকাল তাই নিঃশব্দ সতর্কে
মিশে থাকি ঘন অন্ধকারে,
দেয়ালের বিষন্ন গহ্বরে।
৩৩
ফেরা মানে ফেরাই—
মেঠো ইঁদুরের ভালোবাসা ছেড়ে
শিশিরের নেশা রেখে,
দূরের বাদ্যের হাতছানি ভুলে,
অঘ্রানের এক আলোময় বিকেলে,
আমন ধানের মতো—
নবান্নের উৎসবের দিনে
আনন্দের হাত ধরে
কৃষাণীর সলাজ অভিলাষ হয়ে
সত্যিকারের ফিরে আসা।
অথবা চলে যাওয়া মানে চলে যাওয়াই
দ্ব্যর্থক জল ছবি, টুকরো সংশয়ের পদাবলী,
বিষাদের গান,
সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে
পাল তোলা নৌকারা যেমন
দিগন্তে পালিয়ে যায়
দিনান্তে বেঁচাকেনা শেষে।
হয় আনন্দময় ফিরে আসা
নয়তো বিষাদময় মৃত্যুঘণ্টা!
যদিও নিস্যন্দী অন্ধকারে
একলা দাঁড়িয়ে থেকে থেকে
জেনে গেছি, ভাটির টানে টানে
দূরের গানের সুরে
সরে যাওয়া হালভাংগা নৌকার
ফিরে আসা কতটা কঠিন!
৩৪
কোনো চাঁদের রাতেই আর
তোমার কাছে ফেরা হবে না—
সাদা বালিযাড়ির বুকে সাদা জোছনার ঢল নামে
আমি দাঁড়িয়েই থাকি, প্রোথিত বৃক্ষের মতো!
সমুদ্র ডুবে যায় শুকনো জোছনার জলে
ডুবে যায় অলকানন্দার ঝাড়
ডুবে যায় রাত্রির সুর দূরত্বের বালিয়াড়ি
পরীর ডানা পেয়ে দোলে উর্বশী ঝাউপাতা!
কত পথ আসে কত কত দিক থেকে
মিশে যায় আনন্দ সৈকতে
মিলনন্মুখ নদীর মতো মোহনার প্রেমে
কোনো কোনো চাঁদের রাত এমনি তুখোড়
কোনো কোনো চাঁদের রাত এমনই মোহময়!
একা একা ভালোবেসে ক্লান্ত হয়ে গেলে
অবসন্ন পায়ে আমিও দাঁড়িয়ে থাকি এইখানে
জলের কোমল ছোঁয়া
বালি কাঁকড়ার খুনসুঁটি মেখে মেখে
মিশে যাই শান্ত মৃত প্রবালের ভিড়ে
এমন মাতাল চাঁদের রাতে কোনো দিনই
ফেরা আর হয় না আমার তোমার দরজায়
ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়!
৩৫
যে কোনো বিদায়ে
আমি মৃত্যুর স্বাদ পাই
ছোট, বড় যে কোনো বিদায়—
স্টপেজে দাঁড়িয়ে, বাসের জানালায়,
ট্রেন স্টেশনে অথবা জাহাজের জেটিতে।
প্রতিটি বিদায়ে আমি
জীবনের বহুতল ভবন থেকে
নেমে আসি নিচে,
সারারাত হেঁটে ফিরি
গোরস্তানের অলিগলি ধরে,
সারি সারি শবের বাড়িতে,
অন্ধকারে পৃথিবীর মুখ ভেসে আসে
কেবলই তোমার মুখের মতো—
পাতালের প্রতিটি দরজায় রেখে আসি
শিশিরের পাত্র আমার আকণ্ঠ তৃষ্ণার কথা ভেবে।
তারপর ঘরে ফিরে দখিনের জানালা খুলে দিই
আরেকটা নতুন মৃত্যুর অপেক্ষায়!
সারি সারি নতুন মৃত্যুর গল্পে
আমার নিয়ত বসবাস!
৩৬
একদিন বিকেলের আলো নিভে এলে
আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়াবো তখন
যে আমাকে দিয়ে গেছে ব্যথা, পৃথিবীতে
সবচেয়ে বেশি—
তার কাঁধে মাথা রেখে
জানতে চাইব মৃদুস্বরে
আর কতটুকু ব্যথা এখনো রেখেছে পুষে
বুকের গভীরে
ছায়া ছায়া অন্ধকারে আর কতটুকু
আলো ঢাকা হলে
সে ঘুমাবে অঘোরে, দিনের ক্লান্তি ভুলে।
ভালোবাসা এক নীল প্রজাপতি
একা একা ফুলে ফুলে ঘোরে
গান গেয়ে গেয়ে—
ছুঁয়ে দিলে, মৃত পরাগের রং লেগে থাকে
আঙুলের ডগায় ডগায়।
পৃথিবীতে এলোমেলো পড়ে আছে
এত ভালোবাসা—
তবুও দিতে দিতে ফুরিয়ে গেলে পরে
শূন্য চন্দন পাত্র নিয়ে সে
হারিয়ে যায় সন্ধ্যার জলের অতলে।
৩৭
আমরা আনন্দ চাই—
তবু এক পাশুটে অন্ধকার এলে
ডেকে নিই তারে একান্ত আবাসে,
ছায়া ছায়া মুখে তুলে দিই তার হাতে
জীবনের সকল গভীর আলোময় সঞ্চয়।
এইসব অন্ধকার মিশে থাকে
আমাদের জানালার ছাদে,
ঘুলঘুলি, পোর্টিকো জুড়ে
আমরা তা দেখি,
অথবা দেখি না—
অক্ষম হৃদয় প্রতিবার
তারেই খুঁজে খুঁজে আনে
প্রতিটি আনন্দ ক্ষণে।
বরং হেঁটে যাও সমুদ্র রেখা ধরে
বাতিঘরে এখনো জ্বলছে
টিমটিমে সোনালি আগুন।
৩৮
দিগন্ত রেখায় আনমনে হেঁটে যেতে যেতে
যদি কোনোদিন মিলিয়ে যাই সেই দুর্লভ অন্ধকারে,
আমাকে ডেকো না যেন আর এই পেছনের পথে—
অলিন্দে যেওনা রেখে কোনো প্রজ্জ্বলিত মোমবাতি
ফুলের তোড়ায় বাধা কোনো অবসন্ন চিরকুট।
এক বিলীন সমুদ্রের কাছে,
এক আদিগন্ত মাঠের কাছে
এক মায়াময় আকাশলীনার কাছে
কতটা মূল্য এই তুচ্ছ স্মরণীকার—
পৃথিবীতে একদিন সবকিছু
ঢেকে যায় ধুলোর চাদরে,
বিষন্ন দূরত্বে একদিন চাপা পড়ে
সব গ্লানি, অভিমান, ক্ষোভ,
হৃদয়ের ছোট ছোট ক্ষত।
ঝড়ের প্রকোপ শেষ হয়ে এলে
ভেবে নিও আমিও তলিয়ে গেছি,
পাড় ভাঙা মেঘনায়
পিতৃ পুরুষের প্রিয় ভিটে বাড়ির মতো।
৩৯
যতটুকু দেবে বলে ভেবেছিল
সেই প্রসন্ন প্রহর,
ততটুকু পেয়ে গেছি।
তাই আজ আবার এসেছি ফিরে
আমার পুরনো বিষন্ন শহরে
পুরনো বিষন্ন বাড়ি
এখনো তেমনি রয়েছে দাঁড়িয়ে, একলা
হয়তো আমারই অপেক্ষায়।
জানালার কার্নিশে এখন রয়েছে বসে
সেই বোবা কবুতর,
ছাদের দড়িতে এখনো ঝুলে আছে
ফেলে যাওয়া শীতের মাফলার।
সোম থেকে শনির কক্ষপথ ঘুরে
বারবার ফিরে আসে সেই বিষন্ন রোববার!
৪০
তোমরা অবসরে হাত ধরে হাঁটো
সমুদ্রের ঝাউবন রেখা ধরে,
পৃথিবী তোমাদের অভ্যাস—
ধার করা আলো,
মুফতে লুটিয়ে নেওয়া
বাতাসে তোমরা বাঁচো,
আর ভালোবাসো বিলাসী চাঁদকে।
আমি পৃথিবীতে বাঁচি,
পৃথিবী আমার অভ্যাস—
আমার অবসরে আমি
পৃথিবীর আল ধরে হাঁটি,
আলো আর বাতাসে ভর করে
একসাথে পৃথিবীর গান গাই—
প্রবঞ্চনার ইতিহাস আমি পড়িনি কোনোদিন—
তাই পৃথিবীকে ভালোবেসে
অকপটে তাকেই ভালোবাসা জানাই।
৪১
এই সব সস্তা প্রণয়
সস্তা গল্প
সস্তা দুচার লাইনে তোষামোদি গান
এগুলো নেবার মতো
সস্তা সময় আমার
নেই একতিল।
হতে পারে,
আঙুরের টক নিয়ে
বাজারের প্রচলিত কাহিনী অনেক!
৪২
ভালো থেকো
সারাদিন
ভালোবাসা নিয়ে
ভালোবাসা দিয়ে
পাখির কূজনে
অমৃতের গানে
নীল সরোবরে পদ্মের আসনে
সারা দিন ভালো থেকো।
এই সব নষ্ট সময়
এই সব বেসুরো বসতি
বেহাল নগরী
ছিঁড়ে যাওয়া কক্ষপথ
ধুলো পড়া সুর
কিছুই রেখো না মনে।
মনে রেখো সেইটুকু দিন
সেই সব কাঁচা আলো
বসন্তের চিলতে সময়
ভালোবাসাময়
আনন্দ উত্তাপ
যেটুকু দিয়েছ অথবা পেয়েছ কোনো দিন।
ভালো থেকো সেই সব নিয়ে
সারাদিন সারাবেলা
সেইসব ভিজে ভিজে কথা
আধ চেনা সুর
সেইসব ভালোবাসা আলো নিয়ে
পার হয়ে যেও
অন্ধকার বিরান সময়!
৪৩
আমি আর বেদনা নেব না কোনো
আমাদের এই পথ ছেড়ে
তাই চলে যাব বহুদূরে।
জানি আমি,
আমাদের অমিল অনেক
যারা এইপথে একসাথে হাঁটি,
পথের প্রান্তে হেঁটে এলে
তারা কেউ দেখি নিবিড় শূন্যতা
কেউ দেখি অলক চূর্ণলতা।
আমাদেরও দিগন্ত পৃথিবীর দূরের দু’প্রান্তে
তোমাদের অভিমানী নদী তাই
একা একা বয়ে যায় বহু দূরে
তারপর মিলিয়ে যায় অসীম শূন্যতায়—
আমার আনন্দ ঝর্ণা নিমেষে পাহাড়ের থেকে ভেজায় আমাকে
তার গানে মিলিয়ে নিই আমার নুপুরের সুর
আমাদের দূরত্ব অনেক
বহুদূর থেকে হেঁটে এসে
আমি দেখি মাধবীলতার ঝাড়ে
ঢেকে গেছে আমার জীর্ণকুটির
তুমি দেখ সময়ের অভিশাপে
সেখানে রয়েছে এক
বিরহবিষন্ন মাথিনের কূপ।
৪৪
এখনো পুরানো প্রেমিকের
জন্মদিনে শুভেচ্ছা পাঠাই—
ইচ্ছে করে বকুল ফুলের মালা,
হঠাৎ নীরার জন্য,
হামিংবার্ডের কেক,
কেলভিন ক্লেইনের শিশি
আরো কতকিছু
বিলাসী জানালার কাচের দেয়াল ঠেলে ওগুলো কিছুই পৌঁছায় না
শেষ অবধি পৌঁছায় কিছু শিশিরে ভেজা
এসএমএস।
ছোট ছোট শব্দগুলো চড়ুই-এর মতো
উড়ে উড়ে হাওয়ায় ডানা মেলে—
প্রেম বড় বোকা এক পাখি
কিছু মিষ্টি কথা, কফিশপে দু-একটা আচমকা বৃষ্টির ফোটা,
ইশারায় ডাক দিয়ে, এক ফুয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া,
তারপরে ঘরে ফিরে ফের বিরহের অথবা প্রেমের কবিতা আপলোড
জানালাটা খোলা থাক
মাঝে মাঝে গভীর রাতে
হাস্নাহেনার ঘ্রাণ ভেসে এলে মন্দটা কি?
৪৫
যেখানে থাকি সেখানেই বিলিয়ে আসি সব—
সারারাত জেগে জেগে, কবিতার খাতা,
পাণ্ডুলিপির খসড়া
রোজনামচার মেঘগুলো
টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিয়ে আসি
বন্দরে বন্দরে, অন্ধকারে
অথৈ নদীর জলে, আকাশের নীলে—
ভ্রমণের শেষে এই অবেলায় এসে
তাই মলিন সঞ্চয়ে কিছু নেই
না স্মৃতি! না স্বপ্ন!
৪৬
বোকার স্বর্গ থেকে
এসেছি নেমে এই পৃথিবীতে—
তাই ভিখিরির কাছে চেয়েছি ভালোবাসা
চাঁদের থালা পেতে।
অনন্তের পথে যেতে যেতে
সময় কখনো বা থমকে দাঁড়ায়—
পৃথিবীতে উঁকিঝুঁকি দিয়ে খুঁজেছি অনেক
ফেলে যাওয়া সময়ের ধ্বংসাবশেষ—
নীল মুক্তোর মালা চাপা পড়ে আছে
ঘন জঙ্গলে কোনো এক ভাঙা রকেটের নিচে।
পৃথিবীতে কত কিছু ঘটে
স্বচ্ছ জলের তলায় তলিয়ে যায়
ভাদ্রের মেঘ,
সাদা জোছনায় মিশে থাকে
অসংখ্য পারস্য রমণীর কথা।
নক্ষত্রের ধুলোপথ ধরে
আধ চেনা আমি হেঁটে যাই রাজারই মতো
দূরে কাছে চারিদিকে
এলোমেলো মিটমিট করে জ্বলে
কালের নীলচে তারাগুলো!
৪৭
আমি আর বেদনা নেব না কোনো
সাদা দুধের দিঘিতে নীল রং
ঢেলে দিয়ে কুড়াবো না তোমাদের
বিমর্ষ অভিশাপ।
তোমাদের যতদূরে খুশি যেতে পারো—
চন্দন বন পেরিয়ে
শীতল ভূমধ্যসাগর, রবারের নৌকা বেয়ে
নেমে যেতে পারো
কোনো নির্জন বালির কিনারায়—
তোমাদের কথা ভেবে ভেবে
আমি আর গুণবো না
প্রিজমের বিচ্ছুরিত আলোর কণিকা।
৪৮
আমাদের আরো কিছু ছিলো
যেটুকু বলোনি সেদিন সেই অবেলায়
চায়ের টেবিলে স্মৃতিচারণের দিনে।
ভেজা পন্টুনে জলের মাতলামি
রিনিক ঝিনিক বেসামাল সারারাত—
কবেকার মায়াবী সন্ধ্যা নদীর গল্প
রয়ে গেল গাংচিলের
ব্যথাতুর ডানার আড়ালে।
৪৯
বেদনাকে ভালোবেসে বলেছিলাম একদিন
আরো কিছুক্ষণ না হয় রইতে কাছে
সেই থেকে রয়ে গেছে
আমার উঠোন জুড়ে
ডালিম গাছের পাতায় কথা বলা কাকাতুয়া হয়ে
ছাদের কার্নিশ
জানালার ঘুলঘুলি বেদনার নীলে
নীল হয়ে থাকে
আমার আকাশ ভালোবেসে যেতে যেতে
রয়ে গেছে আকাশের ছায়া হয়ে।
৫০
সে চলে যাবে বলে একা একা সব
গুছিয়ে নিয়েছে গোপনে গোপনে
পুরানো ডাইরি. কবিতার খাতা,
চিঠির দেরাজ খালি হয়ে আছে
পুরানো বাঁশি, মাটির ঘণ্টা
রিভলবারের কাগজপত্র,
ছবির বাক্স
সরিয়ে ফেলেছে—
পার্বণে পাওয়া উপহারগুলো
কবে কবে সব বিলিয়ে দিয়েছে—
পাওনাদারের পাওনা মিটিয়ে
উপরি কিছু টিপস দিয়ে গেছে।
দেয়ালের ছবি সরিয়ে সেখানে
রঙ টেনে গেছে
জানালার শিক, দরজার সব
জং ধরে যাওয়া তালার পাল্টিয়েছে।
এত আয়োজন আমিই কেবল
একটুও জানতে পারিনি
বুঝতে পারিনি ঘুণাক্ষরেও—
অথচ আমরা কতকাল ধরে
একসাথে থাকি, এক কেটলির
কফি পান করি
প্রতিটা বেলায়!
৫১
কেবল তোমার কাছে এলেই
আমি ভিখারি হয়ে যাই
নিজের অজান্তেই রুপার রেকাবী
খুলে তুলে আনি শীর্ণ ভিক্ষাপাত্র
আতরদানীর তরল ফেলে দিয়ে
বাড়িয়ে দিই শূন্য বোতল
অসীম তৃষ্ণায়।
কেবল তোমার কাছে এলেই
মুছে ফেলি কপালের হীরক চন্দন
বর্ষার অচ্ছ্বুত মাঠে হেঁটে হেঁটে
মেখে নিই গায়ে ছাইয়ের স্তর—
কেবল তোমার কাছে এলেই
দুইয়ে দুইয়ে চার না বলে
সম্মোহনীর ঘোরে পাঁচ বলে ফেলি!
৫২
ভালোবাসা না পেলে বাড়ির বেড়ালও
চলে যায় অন্য দিনের সন্ধানে
নক্ষত্রের ময়দানে, বিপন্ন অভিমানে—
মানুষ তো বহুদূর!
আমাকে বেসেছে ভালো
শুধু রাতের আকাশ,
ভোরের দোয়েল পাখি
কাঁদামাখা মাঠ, ভাটফুলে বসা ভোর,
তোমরা বাসোনি কোনোদিন!
তাই এইসব বিরস দিনের গান শেষ হলে
ঘুমাবো আবার, নির্ভার নিশ্চিন্তে
কোনো এক পূর্ণিমা রাতে কপোতাক্ষের তীর ঘেষা
ঘন আকন্দ ফুলের বনে।
৫৩
নেমে এসো,
বহুতল ভবনের বারোয়ারি জীবনের
নকল নকশা ফেলে—
আলোহীন, স্বপ্নহীন ফ্লাটের দরজা গলে
সরু বারান্দা পেরিয়ে, লিফটের তলা গুণে গুণে
কফিশপের পোশাকি কফির সুগন্ধ ছেড়ে
পাড় বাঁধা লেকের কৃত্রিমতা ঝেড়ে
চলে এসো এইখানে—
আকাশের সাদা মেঘ সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে
পাইনের বন ঘুরে, সোনালু ফুলের দিনে
নীল সরোবর ঘেঁষা গেরুয়া মাটির পথ ধরে
ডাহুক ডাকার ক্ষণে, একদিন নিয়ে যাবো
সেই গভীর নীল পদ্মের দেশে।
৫৪
প্রবারণার আলো মিশে যায়
ঘাঘরের জলে
আমি আলোকে আলাদা করতে পারি না
আলো খ৭ুজতে এসে বিহ্বল দাঁড়িয়ে থাকি
নক্ষত্রের বারান্দার নিচে।
সেখানেও আলো মিশে
গেছে ঘাসের চাতালে
বুনো ভাটফুলে
আলোরা জড়িয়ে থাক
গন্ধ হয়ে
আমি তাকে জোনাক পোকার মতো
পারি না তুলে নিতে হাতের তালুতে।
আরো দূরে যাই
দুয়োরাণীর দেউলিয়া কুড়ে
চাঁদের আলোরা মিশে আছে
খয়েরি বনবাসে
চূর্ণ আবীরের মতো লেগে থাকে
চুলের ডগায়
আমি আলো খুঁজি
প্রবারণা পূর্ণিমার প্রতিটি প্রহরে
আর আলো খেলে লুকোচুরি—
আলো খোঁজে কারে?
৫৫
যে আকাশ ভরে থাকে সাদা জোছনায়
তার ব্যথা একেবারে অন্যরকম
অন্ধকারের খুদে খুদে জোনাকী পোকারা
বিস্ময়ে সাররাত জাগে
ভিজে ঘাস ঢেকে যায়
আলোয় আলোয় ভোর হয়
শিউলি কুড়াতে কুড়াতে এসে থমকে দাঁড়ায়
ভুলে যাওয়া স্পর্শ সীমানায়
সামনের লাল পথ এঁকেবেঁকে মিশে গেছে চিত্রার বাঁধানো ঘাটের মোহনায়
আরো দূরে নিশিনাথ তলা
সোনালি আলো ছড়িয়েছে চারধারে
চেনা ভজনের সুরে
কেউ যারে চেনেনি এই শিশিরের ভিড়ে
আমি তারে দেখেছি একদিন
বেদনার বিষন্ন কিনারে।
৫৬
তবুও তো পৃথিবীতে
কিছু কিছু রাঙা দিন আসে
অজুত আনন্দ নিয়ে,
অনাবিল হাসি নিয়ে
অঝোরে বৃষ্টি ধারার মতো
ঝরে যায়
বসন্তের আলোমাখা
প্রাঞ্জল সংগীত হয়ে।
আমাদের আনন্দহীন
এইসব দিন,
এইসব রাত
নিরাশার কুয়াশায় ঢেকে যেতে যেতে
চাদর সরিয়ে উঁকি দেয়,
দোলের ঝুড়ি থেকে
অলক্ষ্যে তুলে রাখে কিছু রং,
কোনো একদিন দোলের আয়োজন হবে
তার নিজেরই শহরে।