Headlines

উন্নয়নের জোয়ারে সব আজ উধাও -জিদিত চাকমা

1

শুধু বান্দরবান কেন, পাহাড়ের সব দুর্গম জায়গায় এ মূহুর্তে খাদ্য এবং পানির সংকট। শহর এবং বাজার থেকে দূরে, যাতায়াত ব্যাবস্থা যেখানে দুর্গম, সেই পাহাড়ের গ্রামগুলোতে শিক্ষা-চিকিৎসার মত মৌলিক অধিকারের কথা নাহয় বাদই দিলাম, নূন্যতম খাদ্য আর পানিয় জলের অভাবটা কেমন তা ভুক্তোভোগী ছাড়া আর কারো বুঝাটা কঠিন।

পাহাড় আর আগের মত নেই তা সবাই জানেন। কিন্তু সেই জানার গভীরতাটা কে কতটুকু তলিয়ে দেখেছেন? পাহাড়ের জনসংখ্যা সরকারী ব্যাবস্থাপনায় বাড়ানো হয়েছে, যাদেরকে দিয়ে বাড়ানো হচ্ছে তারা কেউ পাহাড়কে ভালোবেসে সেখানে যায়নি, একটি বিশেষ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষে তাদের পাহাড়ে আগমন (উদ্দেশ্যের কথা পরে বলি)। পাহাড়ের অরন্য আর প্রাণীবৈচিত্র্য অনেক আগেই উধাও। গাছ কেটে কেটে উজাড় করা হয়েছে বনভূমি, যা আছে তাও প্রতিদিন-রাতে ট্রাকের পিছে করে নেওয়া হচ্ছে। পাহাড়ি গ্রাম উজাড় করে উন্নয়নের জোয়ারে হয়ে যাচ্ছে পর্যটন মোটেল, সেনা ক্যাম্প আর সেটেলার পাড়া। কাটা হচ্ছে পাহাড়, দখল হচ্ছে জুমভূমি-লেক-বসতভিটা। পাহাড় ছাড়া জুম অসম্ভব, সেই পাহাড়ই যখন বেদখল তখন জুমচাষী হয়ে পড়ছে প্রান্তিক এবং সীমান্তবর্তী। বহুব্যবহারে সেই জুমের উর্বরতা জুমচাষীদের কাছে এখন মিথ। তাই জুমে আর এখন আগের মতন ফসল ফলে না, এর মধ্যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলোর( খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ইঁদুরবন্যা প্রভৃতি) প্রভাবের কথা না হয় বাদই দিলাম। আর যা উৎপাদন হবে তাতে গোটা পরিবারের ভরনপোষণ করার প্রচেষ্টা কাটা মুন্ডুর দিবাস্বপ্নের মতন।

পাহাড়িদের কথা বাদ দিলাম, যারা অনেক বছর আগে পাহাড়ে এসেছেন সেই পুরান বাঙালিরা দেখেছেন এবং জানেন সব পাহাড়ি নদীগুলোতে একসময় ছোটবড় অনেক পাথর বিছানো ছিল। নদীর প্রাণই ছিল এই পাথরগুলো। কারন শুকনো মৌসুমে সেই পাথরের নিচে জমে থাকা জল আর জলের মধ্যে জলের প্রাণীদের বসবাস নদীর জীবনকে বাঁচিয়ে রাখত। একসময় ছড়ায়-নদীতে মাছের প্রাচুর্যতা জমির উর্বরতার মতনই মিথ হয়ে গেছে। কোথায় সেই নদীর পাথর আর মাছের প্রাচুর্যতা? উন্নয়নের জোয়ারে সব আজ উধাও!!!

পার্বত্য চট্টগ্রামের অরন্য একসময় ছিল বিখ্যাত। নাম জানা-অজানা হাজারো প্রজাতির উদ্ভিদ সমৃদ্ধ সেই অরন্য আজ শুধু গল্প আর উপকথায় বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। অথচ টিকে থাকলে তা এই দেশের সম্পদ বিবেচিত হত। সেই উপকথার অরন্যের প্রাণীবৈচিত্র্যও আজ গল্পকথা। একবিংশ শতাব্দীতে জন্মানো কেউ আজ কি বিশ্বাস করবে এই অরন্যে একসময় বিচরণ করতো গন্ডার, বাঘ; নদীতে কুমীর, দেড়-দু মন ওজনের বাঘেই মাছ? অথচ সে সব বেশিদিন আগের কথাতো নয়, কিন্তু এখন সেসব শুধুই গল্প। সেই অরন্য আর অরন্যের জীবরা আজ উধাও, অরন্যের মানুষরাও আজ সীমাহীন প্রান্তিকতায় অবস্থান করছে; যে কোন মূহুর্তে সীমানা আর জীবনের ওপারে চলে যাবে( কথাটি নাটকীয় মনে হলেও খাদ্যের অভাবে জীবনসংহার কোন নাটক নয়, সংস্কৃতির অভাবের কথা বাদ)। এবং দেশের বৃহত্তর গোষ্ঠী এবং তাদের সরকারও তা চায়।

ছোট্ট একটা অঞ্চল এই পার্বত্যভূমিটা, অথচ সাংস্কৃতিক বৈচিত্রে কত সমৃদ্ধময় ছিল। কিন্তু নগ্ন এক জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার আর মূল্যবোধের অবক্ষয় এই জায়গার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতাকে ক্রমাগত বিলীন করে দিচ্ছে। যে লুসাইরা ছিল এই পাহাড়-অরন্যের সমার্থক তারা আজ আর এই পাহাড়ে কেউ নেই। প্রান্তিক হতে হতে জুমকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকা মানুষেরা আজ শুধু দুর্গম সীমান্তে চলে গেছে; যেখানে নেই কোন বাজার, স্কুল, হসপিটাল এবং যানবাহন। আছে শুধু ন্যাড়া পাহাড়, শুকনো নদী আর জলপাইরঙা। জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে হারিয়ে যাচ্ছে এবং অধিকাংশই গেছে পাহাড়ের সাংস্কৃতিক এবং জীববৈচিত্র্যতা। খাদ্যের অভাবে এই পাহাড়ে কেউ কষ্ট পাচ্ছে তা একসময় ছিল অসম্ভব ব্যাপার। কারণ জুমের ফসল নষ্ট হলেও একসময় ছিল অরন্য, অরনের সম্পদ উদ্ভিদ আর প্রাণীকূল, ছিল নদী আর নদীজীবী প্রাণীরা; যা অরন্যপাহাড়ের মানুষদের খাদ্যের যোগান দিত।

না! এসবেও কোন কষ্ট হতো না, যদি তারা কষ্টের ন্যায্যমূল্য তারা পেত। নিজের বাগানে কষ্টে ফলানো আম একমন পরিমান নিজের কাঁধে নিয়ে এক ঘন্টার হাঁটাপথ(পাহাড়ি পিছিল পথ) পেরিয়ে যখন কেজি বিক্রি করতে হয় সাত টাকা দরে, যে আম রাজধানীতে আপনি ক্রয় করেন কেজি ১২০ টাকা দরে; অথচ সেই টাকাগুলো দিয়ে কিনতে হয় তিরিশ টাকা দামের চাউল, যে চাউল আপনি রাজধানীতে একই দামে কিনছেন। মাঝখানের ফাঁকিটুকু ধরতে পারছেন কেউ? না! তারপরও কিছু খাদ্যের যোগান থাকে প্রতিটি পাহাড়ি ঘরে; প্রায় প্রত্যেক জুমিয়া পরিবারে কিছু মুরগী কিনবা আমিষ থাকে। কিন্তু দূর পাহাড়ের দুর্গম সেই অঞ্চলে জুমের পাশেই বিজিবি কিনবা আর্মি ক্যাম্প। এবং তাদের মুরগী-মোরগ খেতে ইচ্ছে করলেই পাশের জুমিয়া গ্রামে যা ইচ্ছা দামে কেনা যায়। অথচ তাদের রেশনের জন্য প্রতি মাসে এক কিনবা একাধিকবার হেলিকপ্টার যাওয়া আসা করে।

সংবাদমাধ্যমের কল্যানে আপনারা জেনেছেন বান্দরবানের থানচি উপজেলার রেমাক্রি এবং তিন্দু ইউনিয়নের দুর্গম এলাকায় খাদ্য সংকটে পড়েছে কয়েক হাজার মানুষ। কারনটা বলা হচ্ছে প্রাকৃতিক, কিন্তু আপনারাই তলিয়ে দেখুন এই সংকট কতটুকু আরোপিত। ত্রান দেওয়ার জন্য অনেকেই উদ্যোগ নিয়েছেন, অনেকেই এগিয়ে আসছেন; সবাইকে সাধুুবাদ জানাই। সেই সাথে আহবান জানাবো যদি সম্ভব হয় এমন কোন উদ্যোগ নেওয়া যার মাধ্যমে জুমের ফসলের ন্যায্য মূল্য যেন জুমের চাষীদের হাতে যায়। আর বাকি কথাগুলো………….. সেগুলো না হয় নিজ বোধশক্তি দিয়ে বুঝে নিন।