গোটা পৃথিবী জুড়ে সর্বমোট জনসংখ্যা ৭.২৮ (7.28 billion people as of January 2015) বিলিয়ন। এই ৭.২৮ বিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ২.২ বিলিয়ন (2.2 billion), ইসলাম ধর্মাবলম্বী ১.৮ বিলিয়ন (1.8 billion), ধর্মহীন মানুষ ১.১ বিলিয়ন (1.1 billion), হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী ১ বিলিয়ন (1 billion), বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ৩৭৬ মিলিয়ন ইত্যাদি। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে বিশ্বের সমগ্র জনসংখ্যার বিচারে খ্রিস্টান ৩১.৫ %, ইসলাম ২৩.২ %, হিন্দু ১৫ %, বৌদ্ধ ৭.১ %।
বিশ্বের ২১০ কোটি লোক বলছে “খ্রিস্টান ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম”। বিশ্বের ১৪০ কোটি লোক বলছে “ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম”। বিশ্বের ৯০ কোটি লোক বলছে “হিন্দু বা সনাতন ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম”। বিশ্বের ১১০ কোটি লোক বলছে “কোনো ধর্ম সত্য নয় (নাস্তিক)”।
ভাববার বিষয় এই যে, খ্রিস্টানদের ঈশ্বর মোট জনসংখ্যার বাকি ৬৪.৫ % মানুষকে খ্রিস্টানে পরিণত করতে পারেনি, মুসলিমদের আল্লাহ মোট জনসংখ্যার বাকি ৭৬.৮ % মানুষকে মুসলিমে পরিণত করতে পারেনি, হিন্দুদের ভগবান মোট জনসংখ্যার বাকি ৮৫ % মানুষকে হিন্দুতে পরিণত করতে পারেনি, বৌদ্ধদের ভগবান বুদ্ধ মোট জনসংখ্যার বাকি ৯৩% মানুষকে বৌদ্ধ করতে পারেনি।
এছাড়া অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যেসব ধর্মগুলি আছে তাদের কথা তো ধরলামই না। আহা, ভগবানের ক্ষমতা নিয়ে তো প্রশ্ন উঠবেই। না ক্ষমতা আছে আল্লাহর, না ক্ষমতা আছে ভগবানের, না ক্ষমতা আছে ঈশ্বর বা গডের, না ক্ষমতা আছে অন্য কোনো দেবতার। সেই ভগবানই সর্বশক্তিমান এবং পরম করুণাময় হবে যে ভগবান পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে এক ঈশ্বরে আস্থা এবং বিশ্বাস আনাতে পারবে। সত্যিই যদি ঈশ্বর বলে কিছু থাকত তাহলে পৃথিবী এত ধর্মভাগে বিভাজিত হয়ে থাকত না। “তুই বড়ো, না মুই বড়ো” ধর্মকে কেন্দ্র করে এত রক্তপাত আর হানাহানি থাকত না।
সম্প্রতি এক সমীক্ষায় জানা গেছে— ২০৫০ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডে মোট জনসংখ্যার ৪০ ভাগই হবে নাস্তিক, ইউরোপের ২৩ ভাগরই ধর্ম নিয়ে কোনোপ্রকার মাথাব্যথা থাকবে না। সমগ্র পৃথিবীতেই নাকি ৩ ভাগ নাস্তিক্য বেড়ে গিয়েছে, ধার্মিকতা ৯ ভাগ কমেছে। ২০১০ সালে বিশ্বে ১.১ বিলিয়ন নাস্তিক ছিলেন, ২০৫০ সালে এই সংখ্যা ১.২ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। মনু-মুনি থেকে মোহাম্মদ, মোহাম্মদ থেকে যিশুখ্রিস্ট সকলেই যে দেবতা-ভগবান-আল্লাহ-গড নিয়ে যে ঢপ দিয়েছেন এবং সেইসব ধম্ম-গপ্পো আস্তে আস্তে হাস্যকর হয়ে পড়ছে। ঝাঁপি থেকে ক্রমশ বিড়াল বেড়িয়ে পড়ছে। মানুষকে অনন্তকাল ধরে অন্ধ রাখা যায় না, দাসানুদাস বানিয়ে রাখা যায় না। ঈশ্বর নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছে যুক্তিবাদীদের। হিন্দুধর্মের ঋগবেদে কোথাও ঈশ্বরের ভেলকি স্বীকার করা হয়নি। যা উল্লেখ আছে তা প্রাকৃতিক এবং কাল্পনিক, বাস্তবিক নয়। ইসলামের মোহম্মদ কোন পরিপ্রেক্ষিতে বা পটভূমিতে আরব দুনিয়ায় ‘আল্লাহ’ বা ‘কোরান’ অবতীর্ণ করেছিলেন সে কথা সকলের কাছে এখন পরিষ্কার। আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে, সে দিন বহুদূর নয়। ইসলামের ইতিহাসে সবই স্পষ্ট উল্লেখ আছে। ইতিহাস সবসময় সত্য কথা বলে না ঠিকই, রসিক ও জ্ঞানী মানুষ রাজহাঁসের মতো জলটুকু সরিয়ে দিয়ে দুধটুকু পান করে নেবে। ইতিহাস বিশ্বাস করার জিনিস নয়। নিজের লব্ধ জ্ঞানকে চার্জ করে ইতিহাসের সত্য খুঁজতে হয়। যেটাকে সত্য ভাবছেন সেটা সত্য কি না, সেটা নিয়েও বিতর্ক চলতে পারে। বস্তুত ইতিহাস সাধারণত বিজয়ীর ইতিহাস। তাই ইংল্যান্ডের প্রবল প্রভাবশালী খ্রিস্টান ধর্মনেতা, ক্যান্টারবারির আর্চবিশপ, সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে তার প্রায়ই সংশয় উপস্থিত হয়”।
এ পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই বলেছিলেন— এত বড়ো ধর্মচর্চাকারীরই যদি সন্দেহ ঘটে, সাধারণ মানুষ বিশ্বাস ধরে রাখবে কী করে! ধর্মের সবগুলি দিক নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। পুরাণের গপ্পো, রামায়ণ, মহাভারত কতটা ইতিহাস কতটা রূপকথা– তা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। আনুগত্যতা কাটিয়ে উঠে ইসলামিকদের মধ্য থেকেই এখন অনেকেই বলছে– “কোরআন শরীফ আল্লাহ নিজে পাথরে বা কাগজে লিখে মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাহিস সালামের কাছে পাঠান নাই। এমনকি মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাহিস সালামের মুখ থেকে শুনে যে কপিগুলো করা হয়েছিল সেই গুলোর একটি কপিও আজ পৃথিবীতে বহাল নেই” (shodalap.org/munim)। এমনকি প্রশ্ন উঠছে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরের প্রথম ১০দিন ব্যাপী কারবালায় যে মর্মান্তিক ভ্রাতৃঘাতি ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল তা কি সত্যিই হয়েছিল? নাকি গালগপ্পো? ( Karbala—Fact or Fiction? by Shabbir Ahmed, M.D.)। প্রশ্ন উঠছে যিশুর ক্রুশবিদ্ধ ঘটনা নিয়েও। “Was Christ Really Crucified?” এখন এই ইংরেজি শব্দ Crucify এর অর্থ কী? Oxford Dictionary অনুযায়ী “Crucify” কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া একটা ক্রসের সঙ্গে তাকে বেঁধে রেখে। আর Webster Dictionary অনুযায়ী “Crucify” অর্থ কাউকে ক্রসের সঙ্গে পেরেক ঠুকে অথবা বেঁধে মৃত্যদণ্ড দেওয়া। এককথায়, কাউকে যদি ক্রুসিফাই করা হয় তাহলে সে ক্রসেই মারা যাবে। যদি সে ক্রুশে মারা না যায় তাহলে সে ক্রুসিফাইও হয়নি বলে ধরে নিতে হবে। সেই কারণে এর পিছন পিছন আর একটি প্রশ্ন চলে আসে— যিশুর কি সত্যিই পুনরুত্থান হয়েছিল? পুনরুত্থান (Resurrection) শব্দটার অর্থ কী? Oxford Dictionary অনুযায়ী এর অর্থ কোনো কাজ বা ঘটনা যেখানে মৃত লোক জীবিত হয়। বড়ো হাতের R দিয়ে লেখা Resurrection শব্দের অর্থ খ্রিস্ট মৃত থেকে জীবিত হয়েছেন। আর Webster Dictionary অনুযায়ী Resurrection অর্থ যে ঘটনায় মৃত মানুষ জীবিত হয়। কিন্তু বড়ো হাতের R দিয়ে লেখা Resurrection শব্দের অর্থ যিশুখ্রিস্টের মৃত্যু আর সমাধির পরে তার পুনরায় জীবিত হওয়ার ঘটনা। এককথায়, যিশুর পুনরুত্থান হয়ে গেলে তাকে মারা যেতে হবে। যদি মারা না যান তিনি পুনরুত্থিত হবেন না। (sorolpath.wordpress.com)। হায় ঈশ্বর, তেরা জাদু চল গয়া!
নাস্তিকরা ক্রমবর্ধমান হলে সবার আগে মাথায় হাত পড়ে যাবে ধর্ম-ব্যবসায়ীদের। ধর্মকে সামনে রেখে ভণ্ডামির ব্যবসাও জারি আছে বিশ্বজুড়ে। এর বাইরে যে ভণ্ডরা মহাগুরু সেজে বসে আছে, তাদের সম্পত্তির পরিমাণ দেখলে মাথা খারাপের জোগাড় হবে। বালক ব্রহ্মচারী জীবিত থাকাকালীন প্রতিদিন তার শিষ্যদের কাছ থেকে শুধু প্রণামী পেতেন এক কোটি রুপি! ভারতের কথিত ‘গডম্যান’ আশারাম বাপু। উত্তর ভারতের নানা রাজ্যে তিনি তৈরি করেছেন বিশাল সব আশ্রম ও বহু কোটি টাকার সম্পত্তি। ‘সারগুরু রামপাল জি মহারাজা’ নামে তার যে ডেরা বা আশ্রম আছে তার মূল্য ১০০ কোটি রুপির কাছাকাছি। সত্য সাঁই বাবার আশ্রম থেকে পাওয়া গিয়েছে কোটি কোটি টাকার ধন-সম্পত্তি. সত্য সাঁই বাবার ঘর থেকে মিলেছে ৯৮ কিলোগ্রাম সোনা, ৩০৭ কিলোগ্রাম রূপো এবং ১১ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা। আর বাকি যে গয়না পাওয়া গিয়েছে তার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা। এছাড়াও পাওয়া গিয়েছে হিরে সহ আরও অনেক জিনিস। সাঁইবাবা মন্দিরের মোট সম্পত্তি ২০০০ কোটি টাকা, এছাড়া ৩০০ কেজি সোনা ও ৩০,০০০ কেজিরও বেশি রূপা আছে।
ভারতের সবচেয়ে সম্পদশালী মন্দিরটি হল কেরালায়। মন্দিরটির নাম পদ্মনাভস্বামী। এদের বার্ষিক আয় কত জানা যায় না। তবে এখানের সম্পদের মূল্য প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা। তিরুপতি বালাজি মন্দির বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেবতা। মন্দির চত্বরের মূল মন্দিরটি সোনা দিয়ে মোড়া। এই মন্দিরের বার্ষিক আয় প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা আয় হয় দান থেকে। দর্শনার্থীদের কাছে টিকিট বিক্রি করে আয় হয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। বাকিটা আসে বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ থেকে। আছে ডোনেশন। এই মন্দিরে ২০ টন সোনা ও হিরার গহনা আছে। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুমালা তিরুপতি ভেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে শুধু সোনা রয়েছে ৩০০০ কেজি, আর তাদের ঘোষিত সম্পত্তি রয়েছে ৫০,০০০ কোটি টাকা। জম্মু ও কাশ্মীরের বিষ্ণুদেবী মন্দির সবচেয়ে পুরাতন মন্দির। এই মন্দিরের আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। কে বলে ভারত গরিবের দেশ? হাজার হাজার কোটি টাকা আর ক্যুইন্টাল ক্যুইন্টাল সোনা যদি এইসব অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকে, ভারত গরিব হবে না তো আমেরিকা গরিব হবে? আমরা ভক্তিভরে ভিখারি বাচ্চা হয়ে থাকব, আর আমেরিকার কাছে হাত পেতে থাকব। অতএব, যত দ্রুত সম্ভব হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ মন্দির থেকে বাজেয়াপ্ত করুক। বলুক এত সম্পদ বাক্সবন্দি করে রাখা যাবে না। যে দেশের মানুষের মাথা ঢাকার ন্যূনতম ছাউনি নেই, সেই দেশের বালাজির সোনার ঘরে থাকার সাহস হয় কোথা থেকে! শুধুমাত্র মন্দিরগুলিতে যে পরিমাণ সম্পদ আবদ্ধ হয়ে আছে, তা দেশের উন্নয়নের কাজে উৎসর্গ করা হোক। এই অর্থ দিয়ে আমি একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে চাই, যা হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। সবচেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে বসে পড়াশোনা করতে পারবে নামমাত্র খরচে। আছে নাকি এমন কোনো মন্দির-কর্তৃপক্ষ, ধর্ম-ব্যবসায়ী, ঈশ্বরের দালাল?
ধর্ম, ঈশ্বর না-মানাটা নাস্তিকদের কত বড়ো অপরাধের কাজ যে, তার নিজের মতো বাঁচার অধিকার কেড়ে নিতে হবে চাপাতির আঘাতে? শতছিন্ন করতে হবে নিরপরাধ শরীর? রক্তের বন্যা বইয়ে দিতে হবে, কারণ সেটাই নাকি কত্তার নির্দেশ? আর নাস্তিক বা মুক্তমনারা যাদের বিরুদ্ধে লেখেন বা বলেন সেইসব ভণ্ডরা দিব্যি বহাল তবিয়তে জীবন কাটাবেন? সাঁই বাবা, চন্দ্রস্বামী, রজনীশ, আশারামরা ধর্মের নামে বেওসা করে যাবে, তাদের কিছু হবে না? আর যারা নিরীহ নিরস্ত্র লেখকমাত্র, তাদের কল্যা কেটে নেওয়া হবে দিনেদুপুরে? কেন? সেটা কি ধর্মানুভূতি, নাকি বেওসানুভূতি? মুক্তমনা যুক্তিবাদীরা ধর্মের বিরুদ্ধে লিখলে ক্ষতিটা কোথায় হবে ধর্মে, না বেওসায়? ধর্ম ভ্যানিস হয়ে গেলে ধর্মের নামে বেওসাও ভ্যানিস হয়ে যাবে, সেই ভয়ে! নাস্তিকদের উত্থান মানে ধর্মের নামে ভণ্ডামিও শেষ। মরণোত্তর দেহদানের কাজ তরান্বিত হবে, চিকিৎসা ব্যবস্থা আরও উত্তম হবে।
পৃথিবী যে প্রবল গতিতে ধর্মীয় নৈরাজ্য ও ক্রূরতার দিকে ধাবিত হচ্ছে, সেই তর্কে নাস্তিকদের জয় লাভ করার সম্ভাবনা প্রবল। সেইদিন বেশি দূর নয়, যেদিন রাষ্ট্রও নাস্তিকদের মতবাদকে গ্রহণ করবে। নাস্তিকদের সুরক্ষা দেবে। নাস্তিকদের চিন্তাভাবনা প্রকাশের অধিকার দেবে। ধর্মবাদীরা আর কোনোদিন হুমায়ুন আজাদ, রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবুদের কল্যা কাটতে পারবে না। তসলিমা নাসরিনরা ফিরবেন নিজের দেশে।