Headlines

বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র // রামেন্দু মজুমদার

রামেন্দু মজুমদার
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু এ দেশের উপযোগী করে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন। বড় বড় কল-কারখানা, ব্যাংক ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ত করে সমাজ থেকে অসাম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিই ছিল তার সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য। দ্বিতীয় বিপ্লব, বাকশাল- সবই তার ধারাবাহিক পদক্ষেপ। কিন্তু দেশি-বিদেশি কায়েমি স্বার্থবাদী তার অগ্রযাত্রাকে চিরতরে থামিয়ে দিল।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময় বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতাকে নির্ধারণ করেন। সংবিধানে সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি সম্পর্কে লেখা হয়: ‘মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।’

৪ নভেম্বর খসড়া সংবিধান অনুমোদন উপলক্ষ্যে সংসদে প্রদত্ত ভাষণে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি ব্যাখ্যা করে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন:

‘আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি; এবং বিশ্বাস করি বলেই আমরা ঐগুলি (ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, কাপড়ের কল, পাটকল ইত্যাদি) জাতীয়করণ করেছি। যারা বলে থাকেন, সমাজতন্ত্র হলো না, সমাজতন্ত্র হলো না, তাদের আগে বুঝা উচিত, সমাজতন্ত্র কী? সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েত রাশিয়ার ৫০ বছর পার হয়ে গেল, অথচ এখনও তারাও সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্র গাছের ফল নয় অমনি চেখে খাওয়া যায় না। সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুর। সেই বন্ধুর পথ অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রে পৌঁছা যায় এবং সেজন্য পহেলা স্টেপ যাকে প্রথম পদক্ষেপ বলা হয়, সেটা আমরা গ্রহণ করেছি; শোষণহীন সমাজ। আমাদের সমাজতন্ত্র মানে শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। এক এক দেশ এক এক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্রের মূল কথা হলো শোষকহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সেই দেশের কী আবহাওয়া, কী ধরনের অবস্থা, কী ধরনের মনোভাব, কী ধরনের আর্থিক অবস্থা, সবকিছু বিবেচনা করে ক্রমশ এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে এবং তা আজকে স্বীকৃত হয়েছে।’

বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন বিদেশ থেকে ধার করে কোনদিন সমাজতন্ত্র হয় না। সমাজতন্ত্রের জন্যে চীন বা রাশিয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করলে চলবে না। সমাজতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে শোষণহীন সমাজ এবং সম্পদের সুষম বণ্টন। দেশের সকল মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা দিতে পারে সমাজতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলাদেশ হবে একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র।

১৯৫২ সালের অক্টোবরে চীনের পিকিংয়ে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে তরুণ রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে কারাগারে রাজবন্দি থাকাকালে তিনি তার সেই চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করেন। সম্প্রতি তা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।

এ গ্রন্থের ভূমিকায় বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন:

‘বিপ্লবের পর সামাজিক ক্ষেত্রে যে একটা পরিবর্তন আসে তা নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে দেশ কীভবে পরিচালিত করা যায় তা তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। একটা ধর্মান্ধ জাতিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে দেশকে সকল শ্রেণি-পেশার উন্নয়নে অংশগ্রহণ, দেশপ্রেম, কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সচেতন করা এবং মৌলিক চাহিদা পূরণ করে নিজেদের মাতৃভূমিকে গড়ে তোলার দৃষ্টান্ত এ লেখায় পাওয়া যাবে।

সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, তাদের জীবনযাত্রা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদাগুলো মিটাবার জন্য চীন সরকার বিপ্লবের পর কীভাবে উন্নতি করেছে এবং পরিবর্তন এনেছে মানুষের আচরণে তাও জানা যায়। তিনি শুধু সম্মেলনেই অংশগ্রহণ করেননি, তিনি এই দেশকে খুব গভীরভাবে দেখেছেন। কৃষকের বাড়ি, শ্রমিকের বাড়ি, তাদের কর্মসংস্থান, জীবনমান সবই তিনি দেখেছেন। ছোট ছোট শিশু ও ছাত্রছাত্রীদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। শিশু বয়স থেকেই দেশপ্রেম ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত করার যে প্রচেষ্টা ও কর্মপন্থা তাও অবলোকন করেছেন। তিনি মুক্তমন নিয়ে যেমন ভ্রমণ করেছেন, আবার তীক্ষ্ন দৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন। প্রতিটি বিষয় গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন। আমরা যেমন চীন দেশকে জানতে পারি আবার চমৎকার একটা ভ্রমণকাহিনি যা সে দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নদীতে নৌকা ভ্রমণ, রিকশায় ভ্রমণ, ট্রেনে ভ্রমণ আর আকাশপথ তো আছেই। সকল ভ্রমণে তাঁর হাস্যরসিকতা, প্রবীণ নেতাদের প্রতি দায়িত্ববোধ সবই জানা যায়।

এই ভ্রমণকাহিনি যতবার পড়েছি আমার ততবারই মনে হয়েছে যে তিনি গভীর পর্যবেক্ষণ করেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রে। তার কারণ হলো তাঁর ভিতরে যে সুপ্ত বাসনা ছিল বাংলার মানুষের মুক্তির আন্দোলন ও স্বাধীনতা অর্জন সেটাই বার বার ফুটে উঠেছে আমার মনে, এ-কথাটাও অনুভব করেছি।’

বঙ্গবন্ধু কম্যুনিস্ট ছিলেন না। তথাপি তিনি এ সম্মেলনে যোগদান করতে উৎসাহী ছিলেন এ কারণে যে, ‘দুনিয়ায় আজ যারাই শান্তি চায়’ তাদের সম্মেলনে তিনি ‘যোগদান করতে রাজি’। যে-ই শান্তির জন্য সংগ্রাম করবে তাদের সঙ্গে, বঙ্গবন্ধু সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলে বলতে রাজি ‘আমরা শান্তি চাই’।

তাইতো খুব সঙ্গতভাবেই ১৯৭৩ সালে বিশ্বশান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদকে সম্মানিত করে। বিশ্বশান্তির এক উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে তাঁকে অভিহিত করা হয়। পদক প্রদান অনুষ্ঠানে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সেসময়ের সেক্রেটারি জেনারেল রমেশ চন্দ্র বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব কেবল বঙ্গবন্ধু নন, তিনি আজ থেকে বিশ্ববন্ধু।’

‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থটি পাঠ করলে আমরা দেখতে পাব বঙ্গবন্ধু কী গভীর আগ্রহ নিয়ে বিপ্লবোত্তর চীনের পরিবর্তনগুলো লক্ষ করেছেন। তার কল্পনায় নিশ্চয়ই ছিল যে, বাঙালি যদি কোনোদিন নিজের স্বাধীন দেশ হয়, তবে কেমন করে সমাজে অর্থনৈতিক সমতা আনা যাবে, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো যাবে, সকল নাগরিকের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করা যাবে।

চীন যাওয়ারর পথে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলকে হংকং হয়ে যেতে হয়েছিল। সেখানে এক পাকিস্তানি দোকানদারের যুবক ছেলে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনি কম্যুনিস্ট?’ জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন:

‘না। আমাদের স্বতন্ত্র দল আছে, দলের নাম তাকে বললাম এবং বললাম আমাদের প্রোগ্রাম আছে, ম্যানিফেস্টো আছে। আমাদের দলের নেতা জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। আইন করে কারও কণ্ঠরোধ করার উদ্দেশ্য আমাদের দলের নাই। আমরা দেশের সম্পদ এবং ন্যায়ভিক্তিক আদর্শ দিয়ে দেশ গড়তে চাই। ভাড়া করে কোনো আদর্শ আমরা গ্রহণ করতে প্রস্তুত নই। আবার মিছামিছি কোনো আদর্শকে লোকের চোখে হেয় করতে চাই না। মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাস করি।’

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু এ দেশের উপযোগী করে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন। বড় বড় কল-কারখানা, ব্যাংক ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ত করে সমাজ থেকে অসাম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিই ছিল তার সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য। দ্বিতীয় বিপ্লব, বাকশাল— সবই তার ধারাবাহিক পদক্ষেপ। কিন্তু দেশি-বিদেশি কায়েমি স্বার্থবাদী তার অগ্রযাত্রাকে চিরতরে থামিয়ে দিল। ১৯৭৫ সালে নিষ্ঠুর ঘাতকেরা পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আমাদের সৌভাগ্য তার দুই কন্যা— শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। আজ শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজকে সম্পূর্ণ করতেই নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পিতার মতোই তার বিশেষ দৃষ্টি গরিব জনগোষ্ঠীর উন্নতির দিকে।

আজ আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে তাকালে বার বার বঙ্গবন্ধুর কথা মনে হয়। তিনি চেয়েছিলেন দেশের সকল নাগরিক ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে প্রয়োজনে চিকিৎসার সমান সুযোগ পাবে। কিন্তু আমাদের দেশের সবচেয়ে অনুন্নত সম্ভবত স্বাস্থ্য খাত। বছরের পর বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করেও সরকার স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন করতে পারছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে দুর্নীতি। যে সীমাহীন দুর্নীতি যুগ যুগ ধরে এ খাতে বিরাজ করছে, তা একটু একটু করে এখন প্রকাশিত হচ্ছে। শাহেদের মতো অনেক শাহেদই সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজস করে মানুষের দুর্দশাকে পুঁজি করে তাদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে।

করোনা অতিমারি আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে বিপদের সময় আমরা কত অসহায়। রাজধানীতে বিত্তবান বা মধ্যবিত্তদের চিকিৎসার সুযোগ থাকলেও জেলা-উপজেলায় সাধারণ মানুষের জন্যে তা হয় অপ্রতুল অথবা পুরোপুরি অনুপস্থিত। তাই সরকারের আশু কর্তব্য হবে স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানো, সকল মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা। সঙ্গে সঙ্গে জোর দিতে হবে কৃষি খাতে- যা আমাদের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন চলছে। উদযাপন পালন তখনই অর্থবহ হবে, যখন তার ভাবনাগুলোকে আমরা বাস্তবে রূপান্তরিত করতে পারব। জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের অনেক আড়ম্বর সংক্ষিপ্ত করে যদি একটা জন্মশতবার্ষিকী হাসপাতাল করা হতো, তবে আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায়, যুগ যুগ ধরে মানুষ তার সুফল ভোগ করত এবং স্মরণ করত কোন উপলক্ষ্যে এ হাসপাতাল তৈরি হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু আমাদের জীবনের ধ্রুবতারা। দিন দিন তিনি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় যে সমাজতন্ত্র ছিল, তা একদিন বাংলাদেশে কায়েম হবেই। ধনী, দরিদ্রের ত্রমবর্ধমান ব্যবধানের অবসান হবে।

# লেখাটি ২০ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে নিউজবাংলায় প্রকাশিত হয়েছে।


লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাম্মানিক সভাপতি, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট (আইটিআই)।